শাকিল মাহমুদ (মিতুল): আধুনিক সভ্যতার এই যুগে পশু-পাখির মত মানুষ বিবাহবহির্ভূত অবাধ যৌনাচার তথা ব্যভিচার মত নিকৃষ্ট কাজ এই দেশের ফৌজদারি আইনে কোনো অপরাধ নয়। নিঃসন্দেহে এটি একটা সভ্য জাতির জন্যে লজ্জাকর। পৃথিবীর প্রায় সব ধর্মে, সভ্যতায় ব্যভিচার ছিলো একটি ঘৃণিত পাপ, শাস্তিযোগ্য দণ্ডনীয় অপরাধ। ইসলাম, খৃষ্টান, ইহুদি ধর্মে ব্যভিচার শাস্তি “মৃত্যুদণ্ড” বিধান আছে। হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্মেও ব্যভিচার নিন্দনীয় পাপ মনে করে। বর্তমানে আমাদের সমাজে মহামারীর মত পরকিয়া, ব্যভিচার ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যভিচারের কারণে হত্যাসহ নানা নিষ্ঠুরতার বলি হচ্ছে সন্তান, স্ত্রী, স্বামীসহ আপনজন। এ ঘৃণ্য ঘটনা বিভিন্নমুখী বিশৃঙ্খলা, অশান্তি, কলহ-বিবাদের সূত্রপাত করে, এমনকি দাম্পত্য সম্পর্কের তিক্ততাপূর্ণ অবসান ঘটাচ্ছে।
বাংলাদেশ দণ্ডববিধি ১৮৬০ এর ৪৯৭ ধারায় ব্যভিচার যে সংজ্ঞা, শাস্তি উল্লেখ্য আছে তা অসাংবিধানিক, অযৌক্তিক, এই ধারা নারীদের ব্যভিচার করতে আরো বেশি প্রশ্রয় দিয়েছে। দণ্ডবিধি ধারা ৪৯৭ ধারায় বলা আছে,
“যদি কোনও ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির স্ত্রী অথবা যাকে সে অপর কোনও লোকের স্ত্রী বলে জানে বা তার অনুরূপ বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে এমন কোনও নারীর সঙ্গে উক্ত নারীর স্বামীর সম্মতি বা সমর্থন ব্যতিরেকে এরূপ যৌন সম্পর্ক করে যা নারী ধর্ষণের শামিল নহে, সে ব্যক্তি ব্যভিচারের অপরাধে দোষী এবং যেকোনো বিবরণে কারাদণ্ডে যার মেয়াদ পাঁচ বছর পর্যন্ত হতে পারে অথবা অর্থ দণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। তবে ব্যভিচারে অংশগ্রহণকারী নারী দুষ্কর্মের সহায়তাকারিণী হিসেবে দণ্ডিত হবে না।”
উপরোক্ত ধারা বিশ্লেষণ করে কিছু আইনগত অসংগতি, সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক অংশ নিয়ে আজকের আলোচনা। সাধারণত, ব্যভিচার হয় নারী-পুরুষ উভয়ের সম্মতিতে। কিন্তু এই ধারায় ব্যভিচারের জন্যে শুধুমাত্র পুরুষকে সাজা দেয়ার বিধান রয়েছে, ব্যাভিচারীনি স্ত্রীলোককে সাজা থেকে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। এমনকি পুরুষটি যদি নারী দ্বারা প্ররোচিতও হয়ে থাকে তবুও দায় কেবল পুরুষের! শুধুমাত্র ব্যাভিচারীনি স্ত্রীলোকের স্বামীকে পরপুরুষের বিরুদ্ধে মামলা করার অধিকার দেয়া হয়েছে। স্বামী-স্ত্রী পরস্পর, পরস্পরের বিরুদ্ধে অথবা অন্য কোন ব্যক্তিকে ব্যভিচার মামলা দায়ের অধিকার দেয়া হয়নি।
বাংলাদেশ সংবিধান, তৃতীয় ভাগের (মৌলিক অধিকার) অনুচ্ছেদ ২৭ অনুযায়ী সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। অনুচ্ছেদ ২৮(১) এ বলা আছে,- কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবেন না। অনুচ্ছেদ ৩১ অনুযায়ী আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার দেয়া হয়েছে।
এছাড়া অনুচ্ছেদ ২৬ মতে সংবিধানের তৃতীয় ভাগের (মৌলিক অধিকার) বিধানাবলীর সহিত অসমঞ্জস সকল প্রচলিত আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, এই সংবিধান-প্রবর্তন হতে সেই সকল আইনের ততখানি বাতিল হয়ে যাবে। সুতরাং দণ্ডবিধি এই ধারা সাংবিধানিকভাবেই বাতিলযোগ্য বা সংশোধনযোগ্য।
কোন স্ত্রীলোক তার স্বামীর সম্মতি নিয়ে পরপুরুষের সাথে যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত হলে তা ব্যভিচার হবে না। এই বিধান প্রকারান্তর স্ত্রীকে দিয়ে পতিতাবৃত্তি করানোর সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৮(১) -এ বলা আছে গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। সুতরাং দণ্ডবিধি এই ধারা সাংবিধানিকভাবেই বাতিলযোগ্য বা সংশোধনযোগ্য।
দণ্ডববিধির ৪৯৭ ধারার বিধান পর্যালোচনায় স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়, অবিবাহিত নারীর সঙ্গে, বিধবার সঙ্গে, অথবা স্বামীর সম্মতিপ্রাপ্ত স্ত্রীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক ব্যভিচারের আওতায় পড়বে না। এটি আমাদের দেশের মানুষের মূল্যবোধ, ধর্ম ও প্রচলিত প্রথার পরিপন্থী। এই দেশের অধিকাংশ মানুষ অবৈধ যৌনাচারকে নিকৃষ্ট পাপ মনে করে। এইসব কারণেও এই ধারা সংশোধনযোগ্য।
এই ধারায় স্বামীর সম্মতিতে স্ত্রীর পরপুরুষের সাথে যৌন সংসর্গের বৈধ বিধান থাকায় নারীর মর্যাদা ও স্বাধীন সত্তার প্রতি অবমাননা করা হয়েছে। এখানে স্বামীর সম্মতিতে কোনও একটি অপরাধমূলক কাজ অপরাধ হওয়া, না হওয়া গুরুতর আইনের প্রশ্ন এসে যায়। স্ত্রী, স্বামীর সম্মতির নিয়ে অন্য ব্যক্তিকে আঘাতের হুমকি দিলে বা আঘাত করলে, সামান্য দুইশত টাকার কোনো অস্থাবর সম্পদ চুরি করলে তা অপরাধ হয়, তাহলে ব্যভিচার মত নিন্দনীয় নিকৃষ্ট কাজ করলে তা কেনো অপরাধ হবে না?
কোন কাজ অপরাধ কিংবা অপরাধ নয় তা নির্ণয়ের অধিকার কেবল সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের। স্বামী সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ নয়। তদুপরি একজনের দেহের ব্যাপারে আরেকজনের সম্মতি যদি একটি অপরাধমূলক কাজকে অপরাধ নয় সাব্যস্ত করতে পারে, তাহলে দু’জন অবিবাহিত ছেলেমেয়ে নিজেদের সম্মতিতে শারীরিক সম্পর্ক করলে নারী সঙ্গীর অভিযোগের ভিত্তিতে পুরুষ সঙ্গীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা কেন হবে? সুতারং এই ধারা সংশোধনযোগ্য।
ব্যভিচার ফৌজদারি অপরাধের পাশাপাশি এটি দেওয়ানি অন্যায়। মুসলিম পার্সোনাল ল’ অনুসারে বিবাহ হচ্ছে একটা ‘দেওয়ানি চুক্তি’। স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনের পরস্পর মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক করার বৈধ সিভিল রাইট। সে অধিকার আদায় না হলে স্বামী-স্ত্রীর যে কেউই পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ ১৯৮৫ এর অধীনে ‘দাম্পত্যজীবন পুনরুদ্ধার’ -এর জন্য মোকদ্দমা দায়ের করে প্রতিকার চাইতে পারেন। স্বামী-স্ত্রীর বৈবাহিক সম্পর্কের মাঝে তৃতীয় পক্ষ শারীরিক সম্পর্ক করলে, তিনি ওই বৈধ সম্পর্কের মাঝে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বা অধিকার ভঙ্গকারী হিসেবে বিবেচিত হবেন। ফলে চুক্তি, অধিকার ভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের মামলা করা যাবে।
উপরোক্ত বিশ্লেষণ আলোকে বোঝা যাচ্ছে দণ্ডবিধি ৪৯৭ ধারা সংশোধন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। ব্যভিচার শাস্তিও আরো বৃদ্ধি করতে হবে। একি সাথে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যে শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার। আর তা না হলে এই ধারা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ায় এটি সাংবিধানিকভাবেই বাতিলযোগ্য। আশা করি কর্তাব্যক্তিদের ব্যভিচার প্রতিরোধের জন্যে আইন সংশোধন করতে শুভ বুদ্ধির উদয় হবে।
শাকিল মাহমুদ (মিতুল): শিক্ষানবিশ আইনজীবী, ঢাকা আইনজীবী সমিতি।