শরিফুল রুমি

করোনাকালীন সময়ে শ্রম আইন

শরিফুল রুমি: কর্ম হচ্ছে কর্মক্ষম প্রত্যেক নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু করোনাকালীন এই সংকটময় সময়ে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লোকসান ঘোচানোর পরিলক্ষ্যে বেসরকারি খাতসমূহে শ্রমিক অপসারণের হিড়িক পড়েছে। শুধুমাত্র নিম্নপদস্থ শ্রমিকই এই অপ্রত্যাশিত ছাঁটাই বা অপসারণের শিকার হচ্ছে তা নয় বরং বিভিন্ন বাণিজ্যিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের উচ্চ-মধ্যম পদস্থ শ্রমিকও এর ছাঁটাইয়ের শিকার হচ্ছেন।

বাংলাদেশ সোসাইটি ফর হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট এর তথ্যমতে দেশে বেসরকারি বিভিন্ন খাতে ৭০-৮০ লক্ষ কর্মী রয়েছে। এই করোনাকালীন সময়ে বেসরকারি খাত ব্যয় হ্রাস করে রাজস্ব ক্ষয়কে মেটানোর চেষ্টা করছে। যার ফলে সব থেকে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কর্মীরাই। বেসরকারি খাতের লক্ষাধিক কর্মচারী আকস্মিক চাকরি হারানো, বেতন কর্তন, অবৈতনিক জোরপূর্বক ছুটিসহ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তাদের জীবন হুমকির মুখে পড়েছে। এর ফলে সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত নাগরিকের জীবনের অধিকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। সেই সাথে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে অনুচ্ছেদ ১৪, ১৫ ও ২০ এ প্রদত্ত অধিকার সমূহও।

এই লেখায় আলোচ্য বিষয়সমূহ হচ্ছে- বাংলাদেশ শ্রম আইনের পরিধি, মালিক-শ্রমিকের সংজ্ঞা ও সম্পর্ক, মহামারী কালীন সময়ে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক সংক্রান্ত বিধান, চাকরীচ্যুত বিভিন্ন মাধ্যম ও শ্রমিকের প্রাপ্য এবং আইনসম্মত চাকরীচ্যুত না ঘটলে শ্রম আইনের সুরক্ষা।

বাংলাদেশ শ্রম আইনের পরিধি
করোনাকালীন এই সংকটময় সময়ে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি সকল ধরণের প্রতিষ্ঠান, কারখানা বা শিল্প বা বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান এর উচ্চ-মধ্যম পদস্থ কর্মীগণের চাকরি হারানোর যৌক্তিকতা, আইনি অধিকার ও সুরক্ষা এবং এর প্রতিকার সম্বলিত এই আলোচনার প্রথমেই জানার বিষয় আমাদের দেশে বেসরকারি পর্যায়ে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক ও তাদের অধিকার, শ্রম-নিয়ন্ত্রণ এবং চাকরি সংক্রান্ত বিষয়াদি বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এবং বিধিমালা ২০১৫ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত। বাংলাদেশে অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্মীদের চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োগ প্রদান করে থাকেন। যার ফলে চাকরী-দাতার সাথে চুক্তিতে কতটা দর-কষাকষি করা সম্ভব তার উপর নির্ভর করে চাকরী যাওয়ার পর কতটা সুবিধা পাওয়া যাবে বা চাকরী যাওয়ার ক্ষেত্রে নিয়মকানুন গুলো কি হবে।

তবে বাংলাদেশ শ্রম আইনের ২৮(৪) ধারায় বর্ণিত অবসর গ্রহণকারী কোন শ্রমিককে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ প্রদান ব্যতীত অন্য কোন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ সংক্রান্ত কোন বিধানের উল্লেখ নেই। বরং ধারা ৩(১) এ বলা আছে কোন প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক নিয়োগ সংক্রান্ত নিজস্ব চাকুরী বিধি থাকলেও তা বাংলাদেশ শ্রম আইনে নিয়োগ ও চাকরীর শর্তাবলি সংক্রান্ত প্রদত্ত সুরক্ষা থেকে কম অনুকূল হতে পারবে না। এমনকি যে সকল প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এই আইন প্রযোজ্য না সেসকল প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও এই বিধিনিষেধ প্রযোজ্য। এই বিষয়ে মাননীয় উচ্চা আদালতের অনেক নজীর রয়েছে তার মধ্যে Managing Director, Sonali Bank and others vs. Md. Jahangir Kabir Mollah (1996) 48 DLR 395 এ বলা হয়-

“Sonali Bank may have its Service Regulations but that will not take it outside the ambit of the Empoyment of Labour (Standing Orders) Act 1965.”

অন্যভাবে ব্যাখ্যা করলে দেখা যায়, ধারা ১(৭) মতে কারখানা বলতে যেখানে বছরে কোন দিন সাধারণত কমপক্ষে ৫ জন শ্রমিক কর্মরত থাকে এমন বুঝায়। ধারা ১(৩১) ও ১(৪১) একসাথে পড়লে দেখা যায় প্রতিষ্ঠান বলতে কোন কারখানা বা শিল্প বা বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের করণিক বিভাগ, এমন কোন ব্যক্তির অফিস-প্রতিষ্ঠান যিনি কোন শিল্প বা বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পাদিত চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য শ্রমিক নিযুক্ত করেন, কোন যৌথ কোম্পানির কোন ইউনিট, কোন বীমা কোম্পানি, ব্যাংকিং কোম্পানি বা ব্যাংক, কোন দালালের অফিস, কোন স্টক এক্সচেঞ্জ, কোন ক্লাব, হোটেল, রেস্তোরা বা খাবারের ঘর, কোন সিনেমা বা থিয়েটার, সরকার কর্তৃক, সরকারী গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, এই আইনের উদ্দেশ্যে বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান বলিয়া ঘোষিত অন্য কোন প্রতিষ্ঠানসমূহও এর অন্তর্ভুক্ত হবে। আবার ধারা ৬০ মতে শিল্প অর্থ যে কোন ব্যবসা, বাণিজ্য, উৎপাদন, বৃত্তি, পেশা, চাকুরী বা নিয়োগ এবং ধারা ৬১ শিল্প-প্রতিষ্ঠান কোনগুলো তা সংজ্ঞাপন করেছে। ধারা ২৩৩ এর ১(ছ) মতে মুনাফার উদ্দেশ্যে পরিচালিত যে কোন প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিল্প, কারখানা, ব্যাংক, অর্থ লগ্নী-কারী প্রতিষ্ঠান বা বীমা কোম্পানির কাজ-কর্ম ‘‘শিল্প সম্পর্কিত কাজ-কর্ম’’ বলে বিবেচিত হবে।

অর্থাৎ বেসরকারি সকল ধরণের প্রতিষ্ঠান, কারখানা বা শিল্প বা বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান, বীমা কোম্পানি, ব্যাংকিং কোম্পানি বা ব্যাংক ইত্যাদি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত সকল শ্রমিকই এই আইনের আওতায় সুরক্ষা পাবে। যে সকল প্রতিষ্ঠানসমূহ বা শ্রমিকগণের উপর শ্রম আইন প্রযোজ্য হবে না তা ১(৪) ধারায় আলোচনা করা হয়েছে।

মালিক-শ্রমিকের সংজ্ঞা ও সম্পর্ক
শ্রম আইনের দুটি পক্ষ মালিক ও শ্রমিকের সংজ্ঞা আইনের ধারা যথাক্রমে ২(৪৯) ও ২(৬৫) এ দেওয়া আছে। মালিক (Employer) হচ্ছেন এমন এক ব্যক্তি যিনি প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক (Worker) নিয়োগ দেন। এক্ষেত্রে প্রশ্ন আসে কর্মচারী (Employer) তাহলে কে? মূলত যে সকল কর্মচারী শ্রমিকের সংজ্ঞায় পড়ে তারাও এই আইনের আওতায় শ্রমিক।

ধারা ২(৬৫) অনুসারে শ্রমিক অর্থ শিক্ষাধীনসহ কোন ব্যক্তি, যার চাকরির শর্তাবলী প্রকাশ্য বা উহ্য যে ভাবেই থাকুক না কেন, যিনি কোন প্রতিষ্ঠানে (Establishment) বা শিল্পে (Industry) সরাসরিভাবে বা কোন ঠিকাদার এর মাধ্যমে মজুরী বা অর্থের বিনিময়ে কোন দক্ষ, অদক্ষ, কায়িক, কারিগরি, ব্যবসা উন্নয়নমূলক অথবা কেরানীগিরির কাজ করার জন্য নিযুক্ত। কিন্তু প্রশাসনিক, তদারকি কর্মকর্তা বা ব্যবস্থাপনামূলক কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তি এর অন্তর্ভুক্ত হবে না।

উপরে বর্ণিত ধারা ২(৬৫), ২(৭), ২(৩১), ২(৪১), ২(৬০), ২(৬১) ও ২৩৩(১)(ছ) ধারা সমূহ ও আলোচনার মাধ্যমে বলা যায় মালিক নিয়োগকারী এবং শ্রমিক ও কর্মচারী তার মাধ্যমে নিযুক্ত (Employed)। অর্থাৎ এই আইনের আওতাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের মালিক কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত যে কোন ব্যক্তিই শ্রমিক। ধারা ২(৪৯) মতে মালিকের বলতে উক্ত প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক বা উহার ব্যবস্থাপনা বা নিয়ন্ত্রণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তিও অন্তর্ভুক্ত। আবার ২(৬৫) মতে কোন ঠিকাদারের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিও শ্রমিক হিসেবে গণ্য।

ধারা ২(৬৫) তে আলোচিত শ্রমিকের সংজ্ঞায় প্রশাসনিক, তদারকি কর্মকর্তা বা ব্যবস্থাপনামূলক কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তি এর অন্তর্ভুক্ত হবে না। বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা ২০১৫ এ তদারকি কর্মকর্তা ও প্রশাসনিক বা ব্যবস্থাপনামূলক কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তি এর সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।

বিধি ২(ছ) মতে তদারকি কর্মকর্তা অর্থ মালিক বা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক লিখিতভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত এমন কোন ব্যক্তি যিনি উক্ত ক্ষমতাবলে কারখানা বা প্রতিষ্ঠানের কোন শাখার কোন কাজের বা সেবার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ, কাজের পরিধি নিয়ন্ত্রণ, বাস্তবায়ন কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ, কাজের মূল্যায়ন বা পর্যালোচনা, শ্রমিকদের দিক নির্দেশনা প্রদান বা তদারকি করেন।

বিধি ২(ঞ) মতে প্রশাসনিক বা ব্যবস্থাপনামূলক কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তি অর্থ মালিক বা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক লিখিতভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত এমন কোন ব্যক্তি যিনি উক্ত ক্ষমতাবলে কারখানা বা প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক বা কর্মচারীদের নিয়োগ, বেতন ও ভাতাদি নির্ধারণ, চাকরির অবসান বা চাকরি হতে অপসারণ, চূড়ান্ত পাওনাদি পরিশোধ এবং প্রতিষ্ঠানের ব্যয় অনুমোদন বা নিয়ন্ত্রণ কাজে নিয়োজিত।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে প্রশাসনিক, তদারকি কর্মকর্তা বা ব্যবস্থাপনামূলক কাজে নিয়জিত ব্যক্তিগণের অবস্থান ও অধিকার সম্পর্কে। উত্তর হচ্ছে পরোক্ষভাবে তারাও শ্রমিক এবং তাদের অব্যাহতি, ছাঁটাই, বরখাস্তের ক্ষেত্রেও শ্রম আইনে প্রদত্ত সুরক্ষা পেয়ে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশে বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকর্তাদের শ্রম সংশ্লিষ্ট আর কোন বিধিবদ্ধ আইন নেই। এই সকল ব্যক্তিগণের নিয়োগ সংক্রান্ত বিধান প্রতিষ্ঠান ভেদে নিয়োগ ও অপসারণ সংক্রান্ত নিজস্ব বিধিমালা রয়েছে। প্রতিষ্ঠান-ভেদে উক্ত বিধিমালা থাকলেও এই ক্ষেত্রেও শ্রম আইনের ধারা ৩(১) প্রযোজ্য অর্থাৎ বাংলাদেশ শ্রম আইনে নিয়োগ ও চাকরীর শর্তাবলি সংক্রান্ত প্রদত্ত সুরক্ষা থেকে কম অনুকূল করে সেই বিধিমালা প্রণয়ন করা যাবেনা।

এই সম্পর্কিত মাননীয় উচ্চ আদালতের অনেক রায় রয়েছে।  “Senior Manager, Messrs Dost Textile Mills Ltd. and another vs. Susansu Bikash Nath, 8 BLD (AD) 66” মামলায় মাননীয় সুপ্রিম কোর্ট দুটি বিষয় তুলে ধরেন:

● পদবী দেখে মালিক ও শ্রমিক ইঙ্গিত করে না বরং তার কাজের ধরণের উপর নির্ভর করবে সে মালিক নাকি শ্রমিক।
● এমনকি তত্বাবধানমূলক দায়িত্বে থাকলেই শ্রমিক বলে গণ্য করা হবেনা তা নয়।

এমন আরও অনেক রায় রয়েছে মাননীয় উচ্চ আদালতের যা উপরোক্ত বিষয়সমূহ সমর্থন করে। [Mujibur Rahman Sarkar vs. Labour Court, Khulna (1981) 31 DLR 301] [Tozammel Hossain Akonda vs. Deputy General Manager, Rupali Bank, 5 BLC (AD) 114 (2000)]

অপর একটি মামলা [Managing Director, Rupali Bank Limited vs. Nazrul Islam Patwary and others, 48 DLR (AD) 62] এ মাননীয় উচ্চ আদালত রায় দেন, কেবলমাত্র উৎপাদন মূলক কাজে যুক্ত থাকলেই কেউ শ্রমিক হবেন তা নয় বরং নিযুক্ত হয়ে এবং পারিশ্রমিকের বিনিময়ে দক্ষ, অদক্ষ, কায়িক, কারিগরি, ব্যবসায় উন্নয়নমূলক কাজ করলেই তিনি শ্রমিক।

মহামারী-কালীন সময়ে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক সংক্রান্ত বিধান

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের এই ভয়াবহতায় প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বেসরকারি খাতে বেতন-ভুক্ত শ্রমিকগণ। এই মহামারী প্রত্যক্ষভাবে যেমন জীবনের ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে ঠিক তেমনই এই মহামারী-কালীন সময়ে বেসরকারি খাত ব্যয় হ্রাস করে রাজস্ব ক্ষয়কে মেটানোর চেষ্টা করার লক্ষ্যে লক্ষাধিক কর্মচারীর চাকরী ঝুঁকিতে ফেলে পরোক্ষভাবে জীবনের ঝুঁকির দিকেই ঠেলে দিচ্ছে। প্রসঙ্গত-ভাবে চলে আসে আমাদের শ্রম আইন এই মহামারী-কালীন সময়ে কি নির্দেশ প্রদান করেছেন এবং তা এই অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এ কতটুকু আমলযোগ্য।

মহামারি-কালীন সময়ে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক সংক্রান্ত দুটি বিধান বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এ আলোচনা করা হয়েছে:

● ধারা ১২ – কাজ বন্ধ রাখা।
● ধারা ২৮(ক) – নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত বিপর্যয় বা ক্ষতির কারণে মালিক শ্রমিক সম্পর্ক।

ধারা ১২ মতে মহামারী-কালীন সময়ে প্রতিষ্ঠানের কোন শাখা বা শাখাসমূহ আংশিক বা সম্পূর্ণ বন্ধ রাখার একটি বিধান উল্লেখ আছে। তবে কাজ বন্ধের মেয়াদ তিন কর্ম দিবসের বেশী হবে না। বেশী হলে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকগণকে ধারা ১৬ এর বিধান অনুযায়ী লে-অফ করার সুযোগ থাকে।

বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ধারা ২৮(ক) এবং বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা ২০১৫ এর বিধি ৩২ এ নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত বিপর্যয় বা ক্ষতির কারণে মালিক শ্রমিক সম্পর্কের বিষয় আলোচনা করা হয়েছে। ২০১৩ সালে শ্রম আইন সংশোধনে এই ধারাটি সংযুক্ত করা হয় এবং ২০১৫ সালে বিধিমালায় এর পদ্ধতি দেওয়া আছে যা বর্তমান করোনা সংকটময় সময়ের জন্যেও প্রযোজ্যতা পায়। তবে এই বিধান উৎপাদন-মুখি কারখানা শিল্প প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য।

ধারা ২৮(ক) এ বলা হয়েছে আকস্মিক প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা মানুষের নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত বিপর্যয় বা জরুরী প্রয়োজনে কোন শিল্প স্থানান্তর বা কোন শিল্প প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন কার্যক্রম স্থায়ীভাবে বন্ধ হলে সেই ক্ষেত্রে মালিক ও শ্রমিকের সম্পর্ক, সরকার, বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে, নির্ধারণ করতে পারবে। অপরদিকে বিধি ৩২ এ দুটি ক্ষেত্রের পদ্ধতি আলোচনা করা হয়েছে-

ক) কারখানা ও প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন কার্যক্রম স্থায়ীভাবে বন্ধ হবার ক্ষেত্রে।
খ) কারখানা ও প্রতিষ্ঠানের স্থান্তরের ক্ষেত্রে।

কারখানা ও প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন কার্যক্রম স্থায়ীভাবে বন্ধ হবার ক্ষেত্রে মালিক শ্রমিকদের ছাঁটাই করতে পারবে এবং শ্রমিকদের আইনানুগ পাওনাদি পরিশোধ করবেন। কিন্তু যে ক্ষেত্রে উক্ত কারখানা ও প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন কার্যক্রম পুনরায় চালু হবার সম্ভাবনা থাকলে ছাঁটাই না করে লে-অফ ঘোষণা করতে পারবেন। শ্রমিকদের আইনানুগ পাওনাদি পরিশোধে কোন আপত্তি বা বিরোধ দেখা দিলে ট্রেড ইউনিয়ন বা ১২৪ক অনুসারে শ্রমিকের পাওনা পরিশোধ করতে হবে।

চাকরি-চ্যুতির বিভিন্ন মাধ্যম ও শ্রমিকের প্রাপ্য
করোনা-কালীন এই দুর্যোগে ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান, কারখানা বা শিল্প বা বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান সমূহে বেতন কর্তন, লে-অফ, ছাঁটাই (Entrenchment) ও বরখাস্ত (Termination) শব্দ সমূহ সবথেকে জনশ্রুত হয়ে উঠছে। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সরকার প্রদত্ত দীর্ঘ সাধারণ ছুটিতে বিভিন্ন ব্যক্তি মালিকানাধীন শিল্প বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে নিজেদের লোকসান ঘোচাতে নিন্মপদস্থ শ্রমিকগণের পাশাপাশি উচ্চ-মধ্যম পদস্থ কর্মচারীদেরও বেতন কর্তনসহ লে-অফ ঘোষণা, ছাঁটাই (Entrenchment) ও বরখাস্ত (Termination) করণে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যা সম্প্রতি সময়ে বিভিন্ন মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে। তবে এই বেতন কর্তন, লে-অফ ঘোষণা, ছাঁটাই (Retrenchment) ও বরখাস্ত (Termination) কতটুকু যৌক্তিক এবং কতটুকু আইননানুগভাবে হচ্ছে সেই প্রশ্ন রয়েই যায়। সেই ক্ষেত্রে উক্ত কর্মচারী বা শ্রমিকের অধিকার ও প্রাপ্য সম্পর্কে এই অনুচ্ছেদে আলোচনা করা হলো।

বেতন কর্তন
এই করোনা সংকটময় সময়ে অনেক সুনাম-ধন্য প্রতিষ্ঠানসহ বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মচারীদের বেতন কর্তন করারা দিকে ছুটেছে এবং ছুটছে। কোথাও ৫০ শতাংশ, কোথাও ৬০ শতাংশ মজুরী কর্মচারীদের মাসিক বেতন থেকে কেটে নিয়েছে। হাতে গোনা কিছু ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বাদে প্রায় সকল প্রতিষ্ঠানেই এই বেতন কর্তনের ঘটনা দেখা যায়। কিন্তু আমাদের শ্রম আইনের ১২৫ ধারায় স্পষ্ট করে বলা আছে যে নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্র ব্যতীত অন্য কোন ক্ষেত্রে কোন শ্রমিকের মজুরী থেকে কিছুই কর্তন করা যাবে না। এই বিষয়ে ভারতের বিভিন্ন উচ্চ আদালতের বহু রায় রয়েছে যা নজীর হিসেবে আমাদের আইন আদালতে প্রায়ই অনুসরণ করা হয়। যেখানে আদালত রায় দেন আইনের ধারায় অনুমিত ক্ষেত্র ব্যতীত অন্য কোন ক্ষেত্রে মজুরী কর্তন করা যাবে না [Ganeshi Ram vs. District Magistrate, Jodhpur (1961) 2 LLJ 690] [Manager, Hindustan Journals Pvt. Ltd. Indore vs. Govind Ram Swami Ram of Indore, AIR 1963 MP 25: (1962) 4 LR 520]।

প্রসঙ্গত, শ্রম ও কর্ম সংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে ১০ মে এক আদেশ জারি করেন, এপ্রিল-২০২০ মাসে যে সকল শ্রমিকরা সম্পূর্ণ মাস কাজ করেছেন তারা পূর্ণ মাসের বেতন-ভাতা পাবেন। যারা কাজ করেননি তারা মোট বেতন ভাতার ৬৫ শতাংশ পাবেন। উক্ত আদেশও আমাদের শ্রম আইনের ১২৫ ধারার লঙ্ঘন ও পরিপন্থী।

শ্রম আইনের ১২৫ ধারায় মোট ১২ টি ক্ষেত্র রয়েছে যার মধ্যে এই ক্রান্তিকালীন সময়ে বা মালিকের লোকসান ঘোচাতে কর্মচারীর মজুরী কর্তন এর কোন বিধান নেই। কর্মচারী তার কর্তব্য কাজে অননুমোদিত অনুপস্থিত থাকলে বা মালিক কর্তৃক সরবরাহকৃত বাসস্থানের জন্য বা কোন অগ্রিম বা কর্জ আদায়ের জন্য মূল মজুরী থেকে কর্তন করার মত ১২টি ক্ষেত্র রয়েছে। মালিক এর বাইরে গিয়ে কোন শ্রমিক বা কর্মচারীর মজুরী থেকে কোন কিছুই কর্তন করতে পারবেন না। প্রসঙ্গত মালিক কর্তৃক সরবরাহকৃত বাসস্থান বা সুবিধা সমূহের জন্য মজুরী থেকে কর্তন করা যাবে তখনই যখন সেই সুবিধাদি সংশ্লিষ্ট শ্রমিক কর্তৃক গৃহীত হয় [ধারা ১২৮]। কর্মে নিয়োগের চুক্তির সময়ই মালিক কর্তৃক সরবরাহকৃত বাসস্থান বা যাতায়াতের জন্যে গাড়ি ইত্যাদি দিলে তার জন্যেও মূল মজুরী থেকে কোন কর্তন করার সুযোগ নেই। সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই করোনা-কালীন দুর্যোগে কর্মচারীর বেতন থেকে মালিক কর্তৃক কর্তন অমানবিক এবং আইনসংগতও নয়।

লে-অফ
ধারা ২(৫৮) মতে লে-অফ হচ্ছে কয়লা, শক্তি বা কাঁচা মালের স্বল্পতা, অথবা মাল জমিয়া থাকা অথবা যন্ত্রপাতি বা কল-কব্জা বিকল বা ভাঙ্গিয়া যাওয়ার কারণে কোন শ্রমিককে কাজ দিতে মালিকের যে ব্যর্থতা, অস্বীকৃতি বা অক্ষমতা।

লে-অফ এর সংজ্ঞা আলোচিত ক্ষেত্রসমূহ অথবা পূর্ববর্তী আলোচিত ধারা ১২ এর উপধারা ৮ অনুযায়ী কাজ বন্ধের মেয়াদ তিন কর্ম দিবসের বেশী হলে বা বিধিমালা ২০১৫ এর ৩২(ক) অনুযায়ী কোন প্রতিষ্ঠানে লে-অফ কার্যকর হয়। লে-অফ এর প্রথম মেয়াদকাল ৪৫ দিন এবং তার পরবর্তী মেয়াদকাল/একাধিক মেয়াদকাল ১৫ দিন বিশিষ্ট হয়।

আইনে প্রদত্ত মালিক কর্তৃক লে-অফ ঘোষণা করার অধিকার থেকে শ্রমিকের অধিকার সুরক্ষা দেওয়ার বিষয় নিয়ে মাননীয় উচ্চ আদালতে অনেক নজীর রয়েছে। যেখানে নজীর উপস্থাপন করা হয় যে মালিক খারাপ উদ্দেশ্যে বা দূরবর্তী অভিপ্রায়ে (mala fide or ulterior motive) লে-অফ ঘোষণা করতে পারবেন না। [Virgina Tobacco Co. vs. Labour Court (1994) 45 DLR 233] [Tata Nagar Foundary Co. Ltd vs. Their Workmen, AIR 1962 (SC) 1633]

বর্তমানে অনেক ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানই সরকারের বিধিনিষেধ ও অনুরোধ অপেক্ষা করে লে-অফ ঘোষণা করেছেন। শ্রমিক ছাঁটাই করার সবথেকে সহজ উপায় লে-অফ ঘোষণা করা। কেননা বাংলাদেশ শ্রম আইনের ধারা ১৬(৭) এর অধীন বলা আছে কোন শ্রমিক কোন পঞ্জিকা বছরের লে-অফকৃত প্রথম পঁয়তাল্লিশ দিনের পরও আবার অবিচ্ছিন্ন পনের দিন বা তদূর্ধ্ব সময়ের জন্যে লে-অফ করার পরিবর্তে ছাঁটাই করতে পারেন। লে-অফকৃত শ্রমিকের ছাঁটাইয়ের ক্ষেত্রে কোন নোটিশের প্রয়োজন হয় না [ধারা ২০(৩)]। এই সহজ উপায়ের পাঁয়তারায় অনেক ব্যক্তি মালিক লে-অফ ঘোষণা দিচ্ছেন যা উপরে বর্ণিত মাননীয় উচ্চ আদালতের নজীরের আলোকে শ্রমিকের অধিকার সুরক্ষা পায় না।

লে-অফ কৃত শ্রমিকের প্রাপ্য [ধারা ১৬]

✔ বদলী বা সাময়িক শ্রমিক না এমন কোন শ্রমিককে, যার নাম কোন প্রতিষ্ঠানের মাস্টার রোলে অন্তর্ভুক্ত আছে এবং যে মালিকের অধীন অন্তত: এক বছর চাকরী সম্পূর্ণ করেছেন তার ক্ষেত্রে সাপ্তাহিক ছুটির দিন ব্যতীত তাহার লে-অফের সব দিনের জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে।

✔ কোন পঞ্জিকা বছরের লে-অফকৃত ৪৫ দিনের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ হবে শ্রমিকের মোট মূল মজুরী এবং মহার্ঘ ভাতা এবং এড-হক বা অন্তর্বর্তী মজুরী (যদি থাকে) এর অর্ধেক এবং যদি আবাসিক ভাতা থাকে, তার সম্পূর্ণের সমান।

✔ কোন পঞ্জিকা বৎসরে লে-অফকৃত ৪৫ দিনের পরবর্তী প্রত্যেক ১৫ বা তদূর্ধ্ব দিনসমূহের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ হবে শ্রমিকের মোট মূল মজুরী এবং মহার্ঘ ভাতা এবং এড-হক বা অন্তর্বর্তী মজুরী (যদি থাকে) এর এক-চতুর্থাংশ এবং যদি আবাসিক ভাতা থাকে, তার সম্পূর্ণের সমান।

ছাঁটাই (Retrenchment)
শ্রম আইনের ধারা ২(১১) ও ২০ মতে ছাটাই বলতে বুঝায় অপ্রয়োজনীয়তার কারণে মালিক কর্তৃক শ্রমিকের চাকুরীর অবসান। ছাঁটাই কোন অপরাধ জনিত কারণ হতে সৃষ্ট শাস্তি নয় বরং কোন প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকের সংখ্যা প্রয়োজনের অতিরিক্ত হলে মালিক ছাঁটাই করতে পারেন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে একজন শ্রমিক কখন শ্রমিকের সংখ্যা প্রয়োজনের অতিরিক্ত বলে বিবেচিত হবে। এই করোনা-কালীন পরিস্থিতিতে সৃষ্ট সমস্যার কারণেই কি একজন শ্রমিক কোন প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনের অতিরিক্ত বলে গণ্য হওয়ার যোগ্য কিনা বা একটি প্রতিষ্ঠানে কতদিন সময় কাজের স্বল্পতা থাকলে একজন শ্রমিক অতিরিক্ত বলে গণ্য হবে তা এখন আইনগত প্রশ্ন।

Kumpulan Perubatan (Johor) Sdn Bhd vs. Mohd Razi Haron (2000) এ শ্রম আদালত এই মর্মে রায় দেন মালিক কর্তৃক ছাঁটাই একটি মৌলিক পদক্ষেপ ছিল এবং কর্মীদের ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য কোনও পূর্ববর্তী উদ্দেশ্য হিসাবে এটি করা হয়নি তা লক্ষ রাখতে হবে।

মালিক কর্তৃক কোন শ্রমিককে ছাঁটাই করার ক্ষেত্রে কিছু শর্তাবলি অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে।

● ছাঁটাইয়ের কারণ উল্লেখ করে এক মাসের লিখিত নোটিশ দিতে হবে, অথবা নোটিশ মেয়াদের জন্য নোটিশের পরিবর্তে মজুরী প্রদান করতে হবে।

● নোটিশের একটি কপি প্রধান পরিদর্শক অথবা তৎকর্তৃক নির্ধারিত কোন কর্মকর্তার নিকট প্রেরণ করতে হবে এবং আরেকটি কপি প্রতিষ্ঠানের যৌথ দর কষাকষি প্রতিনিধিকে (যদি থাকে) দিতে হবে।

● ছাঁটাইয়ের ক্ষেত্রে সর্বশেষ নিয়োগ প্রাপ্ত শ্রমিককে প্রথম ছাঁটাই করতে হবে।

কোন ছাঁটাই আইন সম্মত হতে হলে উপরের শর্তসমূহ একজন মালিকের প্রতিপালন করতে হবে। [M/S Caltex Oil (Pak) Ltd. vs. Second Labour Court, East Pak and others (1967) 19 DLR 264]

ছাঁটাই-কৃত শ্রমিকের প্রাপ্য:

✔ ন্যুনতম যে সকল শ্রমিকদের কাজের বয়স ১ বছর পূর্ণ হয়েছে সে সকল শ্রমিকদের ১ মাসের লিখিত নোটিশ প্রদান বা নোটিশের পরিবর্তে ১ মাসের মজুরী প্রদান। ন্যুনতম যে সকল শ্রমিকদের কাজের বয়স ১ বছর পূর্ণ হয়েছে তাদের প্রতি বছর চাকরীর জন্য ক্ষতি পূরণ বাবদ ৩০ দিন হারে মজুরী বা গ্রাচ্যুইটি যদি প্রদেয় হয়, এদের মধ্যে যা বেশী তা প্রদান করতে হবে।

✔ ৩০ ধারা মতে শ্রমিকের চাকরীর ছেদ ঘটার পরবর্তী সর্বোচ্চ ৩০ কর্ম দিবসের মধ্যে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক উক্ত শ্রমিকের প্রাপ্য সকল পাওনা পরিশোধ করতে হবে। ১২৩ ধারা মতে চলতি মাসের সকল মজুরী ৩০ কর্ম দিবসের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে।

✔ ১৬(৭) ধারায় লে-অফকৃত শ্রমিককে ছাঁটাই করা হলে ক্ষতিপূরণ বাবদ তার প্রত্যেক বছর চাকুরীর জন্য ৩০ দিনের মজুরী বা গ্রাচ্যুইটি যদি প্রদেয় হয়, এদের মধ্যে যা বেশী তা প্রদান করতে হবে এবং প্রদেয় ক্ষতিপূরণ বা গ্রাচ্যুইটির অতিরিক্ত হিসাবে আরোও ১৫ দিনের মজুরী দিতে হবে।

✔ যাবতীয় ওভারটাইমের বকেয়া, নিয়োগের শর্তানুযায়ী কোন প্রকার বোনাস বা অন্য কোন পাওনা যদি প্রাপ্য থাকে তবে তা পরিশোধ করতে হবে। শ্রমিককে তার সার্ভিস বই ফেরত দিতে হবে এবং চাকরীর প্রত্যয়ন-পত্র প্রদান করতে হবে।

অন্যভাবে চাকরীর অবসান (Termination)
Termination হচ্ছে কোন কোন প্রতিষ্ঠান মালিকের এক বিশেষ ক্ষমতা যা শ্রম আইনের ২৬ ধারায় দেওয়া হয়েছে। মূলত বরখাস্ত (অসদাচরণের কারণে মালিক কর্তৃক কোন শ্রমিকের চাকরীর অবসান) বা ডিসচার্জ (শারীরিক বা মানসিক অক্ষমতার কারণে অথবা অব্যাহত ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে মালিক কর্তৃক কোন শ্রমিকের চাকুরীর অবসান) এর ক্ষেত্রে মালিককে আইনে প্রদত্ত নিয়মে কারণ উল্লেখ করে চাকরী ছেঁদ করতে হয়। কিন্তু এই ক্ষেত্রে মালিক কোন কারণ বা ব্যাখ্যা ছাড়া কোন শ্রমিককে চাকরীচ্যুত করতে পারেন যা Termination বা চাকরী অবসান বলে পরিচিত।

এই বিষয়ে U.B. Datt & Co. vs. Workmen, AIR 1953 SC 411 এ উচ্চ আদালত রায় দেন-

“If the termination of service was a colourable exercise of the power or as a result of victimisation or unfair labour practice, the labour court or tribunal would have jurisdiction to intervence and set aside such termination. The form of the order in such a case is not conclusive and the labour court and tribunal can go behind the order to find the reasons which led to the order and then consider for itself whether the termination was colorable ecercise of power or as a result of victimisation or unfair practice.”

অর্থাৎ বিজ্ঞ আদালত termination এর কারণ খুঁজে পেতে উক্ত আদেশ পিছনে গিয়ে দেখতে পারেন উক্ত আদেশ মালিকের ক্ষমতার অপপ্রয়োগ কিনা বা অন্যায় অনুশীলনের ফলাফল কিনা এবং উক্ত আদেশ রদ করতে পারেন। এমন অনেক মামলাই এই প্রকারের রায় দিয়েছেন যা নজীর হিসেবে আদালতে অনুসরণ-যোগ্য। [Bangladesh Tea Estate Ltd. vs. Bangladesh Tea Estate Staff Union (1976), 28 DLR (AD) 190]

Termination বা অবসানকৃত শ্রমিকদের প্রাপ্য:

✔ মাসিক মজুরীর ভিত্তিতে নিয়োজিত স্থায়ী শ্রমিককে ১২০ দিনের, অন্য শ্রমিকের ক্ষেত্রে ৬০ দিনের, আবার অস্থায়ী শ্রমিক কিন্তু মাসিক মজুরীর ভিত্তিতে ৩০ দিন অথবা অস্থায়ী অন্য শ্রমিকের ক্ষেত্রে ১৪ দিনের সময় দিয়ে কর্তৃপক্ষ লিখিত নোটিশ প্রদান করবেন। যদি মালিক বিনা নোটিশে শ্রমিকের চাকুরীর অবসান করতে চান সে ক্ষেত্রে নোটিশের পরিবর্তে নোটিশ মেয়াদের মজুরীর সমপরিমাণ অর্থ প্রদান করবেন।

✔ প্রত্যেক সম্পূর্ণ বছর চাকরীর জন্য ক্ষতিপূরণ বাবদ ৩০ দিন হারে মজুরী যা মূল মজুরী বা গ্রাচ্যুইটি যদি প্রদেয় হয়, এদের মধ্যে যা বেশী তা প্রদান করতে হবে। এ প্রক্রিয়া শুধুমাত্র স্থায়ীদের জন্য প্রযোজ্য হবে।

✔ ৩০ ধারা মতে শ্রমিকের চাকরীর ছেদ ঘটার পরবর্তী সর্বোচ্চ ৩০ কর্ম দিবসের মধ্যে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক উক্ত শ্রমিকের প্রাপ্য সকল পাওনা পরিশোধ করতে হবে। ১২৩ ধারা মতে চলতি মাসের সকল মজুরী ৩০ কর্ম দিবসের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে।

✔ যাবতীয় ওভারটাইমের বকেয়া, নিয়োগের শর্তানুযায়ী কোন প্রকার বোনাস বা অন্য কোন পাওনা যদি প্রাপ্য থাকে তবে তা পরিশোধ করতে হবে। শ্রমিককে তার সার্ভিস বই ফেরত দিতে হবে এবং চাকরীর প্রত্যয়ন-পত্র প্রদান করতে হবে।

আইনসম্মত চাকরীচ্যুত না ঘটলে শ্রম আইনের সুরক্ষা
বাংলাদেশ শ্রম আইন একটি বিশেষ আইন। বিশেষ আইনের চরিত্রগত এখানেই মৌলিক এবং পদ্ধতিগত বিষয়সমূহ আলোচনা করা আছে। এই করোনা-কালীন সময়ে আইন বহির্ভূত চাকরীচ্যুত ঘটছে যার সুরক্ষা এই আইনের দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ একজন শ্রমিকের আইন বহির্ভূত চাকরীচ্যুত হলে কোথায় অভিযোগ করতে হবে ও কিভাবে করতে হবে। আবার কোন শ্রমিকের প্রাপ্য মজুরির জন্যে কি করতে হবে বা বিদ্যমান অধিকার নিশ্চিত করতে কি করতে হবে তা এই আইনের মধ্যেই আলোচনা করা আছে। তবে এই ক্ষেত্রে একজন শ্রমিক বা কর্মচারীকে প্রথমেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে তিনি কি চান। অর্থাৎ যদি কোন কর্মচারী তার চাকরী পুনরুদ্ধারের জন্যে মামলা করতে চান তাহলে তার বাংলাদেশ শ্রম আইনের ৩৩ ধারা অনুসরণ করতে হবে। আবার তিনি যদি তার চাকরীচ্যুত মেনে নিয়ে প্রাপ্য মজুরী-ভাতা ও অন্যান্য উদ্ধার করতে চান তাহলে তাকে ১২৪ক অথবা ১৩২ ধারা অনুসরণ করতে হবে। আবার কোন ক্ষেত্রে যদি কোন কর্মচারীর বিদ্যমান আইনি অধিকার রক্ষা করতে চান তাহলে ২১৩ ধারা অনুসরণ করতে হবে। এই অনুচ্ছেদে এই সকল ধারায় একজন কর্মচারীর পক্ষে আইনি প্রতিকার ও সুরক্ষা সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।

শ্রম আইনের ৩৩ ধারা অনুসারে অভিযোগ

✔ লে-অফ, ছাঁটাই, ডিসচার্জ, বরখাস্ত, অপসারণ অথবা অন্য যে কোন কারণে কোন শ্রমিক বা কর্মকর্তার চাকরীর অবসান হলে তিনি অভিযোগের কারণ অবহিত হওয়ার তারিখ হতে ৩০ দিনের মধ্যে লিখিত আকারে মালিকের নিকট অভিযোগ প্রেরণ করতে পারেন। উক্ত অভিযোগ রেজিস্ট্রি ডাকযোগে বা মালিকের নিকট সরাসরি প্রদান করে লিখিতভাবে প্রাপ্তি স্বীকার করে নিতে হবে। [ধারা ৩৩(১)]

✔ মালিক অভিযোগ প্রাপ্তির ৩০ দিনের মধ্যে অভিযোগ সম্পর্কে তদন্ত করবেন এবং সংশ্লিষ্ট শ্রমিককে শুনানির সুযোগ দিয়ে সেই সম্পর্কে তার সিদ্ধান্ত লিখিতভাবে শ্রমিককে জানাবেন৷ [ধারা ৩৩(২)]

✔ যদি মালিক কোন সিদ্ধান্ত দিতে ব্যর্থ হন, অথবা সংশ্লিষ্ট শ্রমিক যদি উক্ত-রূপ সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট হন, তাহলে তিনি ৩৩(২) ধারায় উল্লিখিত সময় অতিক্রান্ত হওয়ার তারিখ হতে ৩০ দিনের মধ্যে অথবা, ক্ষেত্র-মত, মালিকের সিদ্ধান্তের তারিখ হতে ৩০ দিনের মধ্যে শ্রম আদালতে লিখিতভাবে অভিযোগ পেশ করতে পারবেন যা ফৌজদারি অভিযোগ হিসেবে গণ্য হবে।

এই ধারার ক্ষেত্রে মালিকের নিকট অভিযোগ প্রেরণ, মালিকের সিদ্ধান্ত, আদালতে অভিযোগ দাখিল সংক্রান্ত সময়সীমার অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক। তবে ধারা ২৬ এর অধীন প্রদত্ত চাকরীর অবসানের আদেশের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করা ৩৩(৩) ধারায় করা যাবে না। যদি না অবসানের আদেশটি সংশ্লিষ্ট শ্রমিকের ট্রেড ইউনিয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে অথবা উদ্দেশ্য প্রণোদিত-ভাবে প্রদত্ত হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়, অথবা যদি না তিনি উক্ত ধারার অধীন প্রাপ্য সুবিধা হইতে বঞ্চিত হন।

শ্রম আইনের ১৩২ ধারা অনুযায়ী মজুরী থেকে কর্তন বা মজুরী বিলম্বে পরিশোধের কারণে দরখাস্ত

✔ যে ক্ষেত্রে এই আইনের বিধান খেলাপ করে কোন শ্রমিকের মজুরী থেকে কোন কর্তন করা হয় অথবা কোন শ্রমিকের মজুরী পরিশোধ করা না হয় অথবা তার মজুরী কিংবা কোন বিধির আওতায় প্রদেয় গ্রাচ্যুইটি বা ভবিষ্যৎ তহবিলের প্রাপ্য পরিশোধে বিলম্ব হয়, সে ক্ষেত্রে তিনি, অথবা মৃত হলে তার কোন উত্তরাধিকারী অথবা কোন আইনসংগত প্রতিনিধি কর্তৃক মজুরী ফেরত পাওয়ার জন্য অথবা বকেয়া বা বিলম্বিত মজুরী ও অন্যান্য পাওনা আদায়ের জন্য শ্রম আদালতে দরখাস্ত করতে পারবেন।

✔ এই দরখাস্ত সংশ্লিষ্ট শ্রম আদালতে মজুরী কর্তনের তারিখ হতে অথবা ক্ষেত্র-মত, মজুরী প্রদেয় হওয়ার তারিখ হতে ১২ মাসের মধ্যে পেশ করতে হবে। তবে এই দরখাস্ত উক্ত সময়ের পরেও পেশ করা যাবে যদি আদালতকে যথাযথ কারণ উল্লেখ করে সন্তুষ্ট করা যায়।

অর্থাৎ ১৩২(১) ধারায় কোন শ্রমিক বা কর্মচারী ১২ মাসের মধ্যে তার প্রাপ্য মজুরী চেয়ে শ্রম আদালতে দরখাস্ত করতে পারবেন। এই ক্ষেত্রে ৩৩ ধারার মত ৩০ দিনের হিসেব করতে হবে না।

শ্রম আইনের ২১৩ ধারা মতে শ্রম আদালতে দরখাস্ত

✔ কোন যৌথ দরকষাকষি প্রতিনিধি অথবা কোন মালিক অথবা কোন শ্রমিক এই আইন বা কোন রোয়েদাদ বা কোন নিষ্পত্তি বা চুক্তির অধীন বা দ্বারা নিশ্চিত বা প্রদত্ত বা কোন প্রচলিত প্রথা বা কোন বিজ্ঞপ্তি বা কোন আদেশ বা কোন নোটিফিকেশন বা অন্য কোন ভাবে স্বীকৃত কোন অধিকার প্রয়োগের জন্য শ্রম আদালতে দরখাস্ত করিতে পারিবেন।

অর্থাৎ কোন শ্রমিক বা কর্মচারী চাইলে বিদ্যমান বা স্বীকৃত কোন অধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে যে কোন সময় শ্রম আদালতে দরখাস্ত দাখিল করতে পারবেন। এই ধারায় মামলার ফলে নতুন কোন অধিকার সৃষ্টি হয় না বরং বিদ্যমান স্বীকৃত অধিকারই প্রয়োগে কার্যকারিতা পায়।

শরিফুল রুমি: শিক্ষানবিশ আইনজীবী, ঢাকা জজ কোর্ট।