বিদেশে থাকাকালীন সময়ে জমি কেনার যেমন প্রয়োজন হয় তেমনি প্রয়োজন হয় জমি বিক্রয়ের। আবার দেখা দিতে পারে এজমালি সম্পত্তির কোনো অংশীদার প্রবাসে থাকায় জমি বিক্রয় করা যাচ্ছে না। এসব সমস্যা সহজেই সমাধান করা যায়। আইন অনুযায়ী প্রবাসে থেকেই যে কেউ দেশের সম্পত্তি বিষয়ক এসব সমস্যার সমাধান করতে পারেন। বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন অ্যাডভোকেট রীনা পারভিন মিমি।
বিদেশে থেকে কি জমি ক্রয় করা যায় কি?
ভালো পরিবেশে বসবাস করা এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও পরিবারকে অর্থনৈতিক ভাবে সাবলম্বী করার আশায় বাংলাদেশীরা প্রবাসে পাড়ি জমায়। কিন্তু এত ভালকিছু পাবার পরেও প্রবাসীদের মন পড়ে থাকে নিজের দেশের উপর। আর তাই কিছু টাকা আয় করতে পারলে চিন্তা করে দেশে একটুকরো জমি কেনার। কিন্তু বিদেশে থেকে জমি কেনার কোন উপায় এখন আর নেই। ২০০৫ সালের ১ জুলাই থেকে জমির যেকোনো হস্তান্তরযোগ্য দলিল রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ফলে বিক্রেতার পাশাপাশি ক্রেতাকেও দলিল করার সময় উপস্থিত থাকতে হবে। তাই বিদেশে বসে কিংবা অপ্রাপ্ত-বয়ষ্ক ছেলে মেয়ের নামে জমি কেনা এখন আর সম্ভব হয় না।
বিদেশ থেকে জমি বিক্রয় করা যায় কি?
বিদেশ থেকে যে কেউ তার দেশে রেখে যাওয়া যেকোনো সম্পত্তি বিক্রয় করতে পারবেন। এই বিক্রয় করতে হলে তাকে একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে পাওয়ার দিতে হবে। শুধু জমিজমা-সংক্রান্ত নয়, যেকোনো কাজ আপনার অনুপস্থিতিতে সম্পাদনের ক্ষমতা অর্পণ করতে পারেন।
কি কি কারনে বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তি দেশে থাকা কোন বিসস্ত ব্যক্তিকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিতে পারবে?
- দেশে যদি তার জমি বিক্রেয় করার প্র্যজন হয় তখন জায়গা জমি বিক্রয়ের জন্য।
- ব্যাংক থেকে লোন নেবার বিপরীতে স্থাবর সম্পত্তি বন্ধক প্রদানের জন্য।
- জায়গা জমি দেখাশুনা, তত্ত্বাবধায়ন করার জন্য কাউকে দায়িত্ব প্রদানের জন্য।
- বিদেশে অবস্থাঙ্কালে তার যদি কোন মামলা পরিচালনার প্র্যজন হয় টা ব্যক্তির পক্ষে কোন মামলা পরিচালনার জন্য। তবে এক্ষেত্রে আদালতের অনুমতি নিতে হবে।
আমমোক্তারনামা বা পাওয়ার অব অ্যাটর্নি কি?
উক্ত পাওয়ার দেবার আগে আপনাকে প্রথমে জেনে নিতে হবে এই পাওয়ার কি বা কীভাবে দিতে হয়। আইনের ভাষায় একে বলা হয় আমমোক্তারনামা বা Power Of Attorney (আমমোক্তারনামা একটি আইনগত দলিল)। স্ট্যাম্প অ্যাক্ট ১৮৯৯-এর ২(২১) উপ-ধারা অনুসারে যে দলিল দিয়ে কোনো ব্যক্তিকে অন্য কোনো ব্যক্তির পক্ষে হাজির হয়ে যেসব কার্যাবলি সম্পাদন করার ক্ষমতা দেয়া হয় তাকে আমমোক্তারনামা দলিল বলে। যাকে আমমোক্তার নিয়োগ করা হলো তিনি মূল মালিকের পক্ষে সম্পত্তির দান, বিক্রি, হস্তান্তর, রক্ষণাবেক্ষণ, বন্ধক রাখা, খাজনা প্রদান ইত্যাদি করে থাকেন। তবে আমমোক্তারনামা দলিলে স্পষ্ট করে লেখা থাকতে হবে যাকে পাওয়ার বা ক্ষমতা দেয়া হলো তিনি কী কী করতে পারবেন, কিংবা কি কি করতে পারবেন না।
সাধারণত আমমোক্তারনামা দুই প্রকার। ক) জেনারেল পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি বা সাধারণ আমমোক্তারনামা এবং খ) স্পেশাল পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি বা খাস আমমোক্তারনামা
জেনারেল পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি বা সাধারণ আমমোক্তারনামা
যে মোক্তারনামা মোক্তার দাতার পক্ষে জমি-জমা ক্রয়, বিক্রয় রক্ষণা-বেক্ষণ, চুক্তিপত্র করা, মামলা-মোকদ্দমা পরিচালনা করাসহ যাবতীয় কাজের ক্ষমতা মোক্তারকে দেয়া হয় তাকে জেনারেল পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি বলে।
স্পেশাল পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি বা খাস আমমোক্তারনামা
অন্যদিকে একটি নির্দিষ্ট বা কোনো বিশেষ কাজের ক্ষমতা মোক্তারকে দিয়ে তৈরি মোক্তরনামা হলো স্পেশাল পাওয়ার অব।
তবে ২০১২ সালের পাওয়ার অব অ্যাটর্নি আইন অনুসারে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দুই প্রকার। (১) প্রত্যাহারযোগ্য পাওয়ার অব অ্যাটর্নি এবং (২) অপ্রত্যাহারযোগ্য পাওয়ার অব অ্যাটর্নি।
অপ্রত্যাহারযোগ্য পাওয়ার অব অ্যাটর্নি
স্থাবর সম্পত্তি বিক্রির উদ্দেশ্যে, বিক্রয়চুক্তি সম্পাদনের বা ঋণ নেয়ার বিপরীতে স্থাবর সম্পত্তি বন্ধক প্রদানের জন্য প্রদত্ত পাওয়ার অব অ্যাটর্নিকে ‘অপ্রত্যাহারযোগ্য পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বলে। এই পাওয়ার অব অ্যাটর্নিতে মোক্তারের ক্ষমতা মূল মালিকের মতোই থাকে। অপ্রত্যাহারযোগ্য পাওয়ার অব অ্যাটর্নির ক্ষেত্রে মোক্তারের মৃত্যু হলে বা আইনগতভাবে দলিল সম্পাদনে অক্ষম হলে ওই মৃত বা অক্ষম মোক্তারের বৈধ ওয়ারিশ বা স্থলবর্তীর ওপর দলিল থেকে সৃষ্ট দায় বা অধিকার স্বয়ংক্রিয়ভাবে থাকবে।
বিদেশ থেকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বানানোর প্রক্রিয়া
পাওয়ার অব অ্যাটর্নি সাদা কাগজে অব্যশই লিখিত হতে হবে। কারণ এটি একটি আইনগত দলিল। এই দলিল লিখাতে হবে কোন দলিল লেখক দ্বারা। অত্র দলিলে সকল বিষয় বা শর্ত সঠিকভাবে উল্লেখিত আছে কিনা তা একজন বিজ্ঞ আইনজীবীকে দেখিয়ে পরীক্ষা (চেক) করে নিলে ভালো। এই দললটি করতে হবে উপযুক্ত স্ট্যাম্পের উপর যা একটি আমমোক্তারনামা দলিল। তারপর ডাকযোগে বা অন্য কোন মাধ্যমে আমমোক্তার দাতার কাছে দলিলটি পাঠাতে হবে। আমমোক্তার দাতা দলিলটি পাওয়ার পর যেদেশে তিনি বসবাস করছেন (হতে পারে আমেরিকা, লন্ডন, কানাডা…যে দেশেই থাকুন না কেন) দাতা দলিলটি পাওয়ার পরে আমমোক্তারনামা দলিলটা নিয়ে বাংলাদেশর দূতাবাসে গিয়ে কনস্যুলারের সামনে দলিলটি স্বাক্ষর করতে হবে। কনস্যুলার মহোদয় নিজেও উক্ত দলিলটিতে স্বাক্ষর করবেন।
স্বাক্ষরের কাজ শেষে উক্ত দলিলটি ডাকযোগে বা অন্য কোন মাধ্যমে যাকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দেওয়া হচ্ছে তার কাছে পাঠাতে হবে। উক্ত পাওয়ার অব অ্যাটর্নি পাওয়ার পর বাংলাদেশের ফরেন মিনিস্ট্রি (পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়) সহকারী সচিব, কনস্যুলার কর্তৃক সত্যায়িত করতে হবে। পরবর্তীতে তা জেলা প্রশাসকের রাজস্ব কার্যালয়ে জমা দিতে হবে।
এরপর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে বিদেশে সম্পাদিত আমমোক্তার নামা দলিলে প্রদত্ত বর্ণিত সম্পত্তিতে সরকারী স্বার্থ জড়িত আছে কিনা তার তথ্যসহ সকল দাগের তথ্য সম্বলিত প্রতিবেদন প্রেরণ করতে সহকারী কমিশনার (ভূমি) বরাবর চিঠি প্রেরণ করবেন এবং আরেকটি চিঠি প্রেরণ করবেন সহকারী সচিব (কনস্যুলার) পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় বরাবর। সকল তথ্যসমগ্র জেলা প্রশাসকের রাজস্ব কার্যালয়ে আসার পর ২,০০০/- টাকার চালান প্রদানের পর নির্দিষ্ট একটি সময়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ইহা ৫০০ এর অপর পাতায় ৫০০ টাকার দুটি স্ট্যাম্প লাগাবে। তখন অত্র পাওয়ার অব এ্যাটর্নি দলিল নম্বর এবং এই নম্বর দিয়েই পাওয়ার অব এ্যাটর্নির সঠিকভাবে হয়েছে কিনা যাচাই বাছাই করা থাকে।
ফরেন পাওয়ার অব অ্যাটর্নি কি রেজিস্ট্রেশন করতে হয়?
সব পাওয়ার অব অ্যাটর্নি রেজিস্ট্রেশন করতে হয় না, যে পাওয়ারের মাধ্যমে সম্পত্তি বিক্রয়ের অধিকার দেওয়া হয় সেগুলো রেজিস্ট্রেশন করতে হয়।
পাওয়ার অব অ্যাটর্নি কখন বাতিল করা যায়?
পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দলিলটি রেজিস্ট্রি করার পর দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি আইনত সেই সমস্ত কাজ করতে পারবেন যা আপনি করতে পারতেন। তবে মোক্তারনামা যে কোনো সময় বাতিল করা যায়। যে রেজিস্ট্রি অফিসে রেজিস্ট্রি করা হয়েছিল সে জেলায় রেজিস্ট্রারের বরাবর মোক্তারনামা বাতিলের জন্য আবেদন করতে হবে। রেজিস্ট্রার এটি রদ করবেন নির্ধারিত পদ্ধতিতে এবং তার জেলার রেজিস্ট্রি অফিসে নোটিশের মাধ্যমে জানিয়ে দেবেন। যদি রেজিস্ট্রি করা না হয়ে থাকে তাহলে আমমোক্তার বাতিল ঘোষণা করে নির্ধারিত স্ট্যাম্পে দলিল সম্পন্ন করা যেতে পারে। তবে স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত মোক্তারনামা স্বার্থপূর্ণ বা পরিত্যক্ত না হওয়া পর্যন্ত বাতিল করা যায় না। এ ছাড়া মোক্তারনামা বাতিলের পদ্ধতিগুলো নিম্নরূপ-
ক) মোক্তারনামা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য করা হলে মেয়াদ শেষে আপনা-আপনিই বাতিল হয়ে যায়।
খ) মোক্তারনামা নির্দিষ্ট কোনো কার্যের জন্য করা হলে ওই কাজ সমাপ্তিতে তা বাতিল বলে গণ্য হবে।
গ) যৌথ ক্ষমতার মোক্তারনামার পক্ষদের একজনের মৃত্যুতে তা বাতিল বলে গণ্য হবে।
পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দেশে থেকে দেওয়া হোক আর বিদেশ থেকেই হোক না কেন অত্র পাওয়ার দেবার আগে তাকে অবশ্যই, অর্থাৎ যাকে পাওয়ার দেওয়া হবে তার সম্পর্কে জানতে হবে যে সে কতটা বিশ্বস্ত। কারণ অনেক সময় দেখা যায়, মোক্তার নিজের নামে কিংবা প্রতারণামূলকভাবে জায়গা জমি হস্তান্তর বা বিক্রি করে দেন, তখন মূল মালিক বিপদে পড়েন। এ নিয়ে মামলা-মোকদ্দমাও কম হয় না, তাই এ সকল ঝামেলায় পড়ার আগে সতর্ক থাকা উচিৎ। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে এ বিষয়ে আইনজীবীর পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।
রীনা পারভিন মিমি : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও সহযোগী সম্পাদক- ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম। Email- rinaparvinmimi18@gmail.com