মোঃ জাকির হোসাইন: বাংলাদেশে নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা অত্যন্ত বেশী। বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতার (Violence against Women) কারণে প্রতি বছর বহু নারীকে স্বামী বা শ্বশুড় বাড়ির আত্মীয় হত্যা করে। নির্যাতনের কারণে অনেক নারীর সংসার বিচ্ছেদ ঘটে ও শিশুরা অভিভাবকহীন অবস্থায় বড় হয়।
বর্তমানে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর অধীন বিচারাধীন মামলার সংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ ৭০ হাজার হয়, যার প্রায় ৮০% মামলার উৎপত্তি মূলত পারিবারিক সহিংসতা (Domestic Violence) থেকে। এই বিপুল সংখ্যক মামলার পরিসংখ্যানই প্রমাণ করে দেশে পারিবারিক সহিংসতা অনেক বেশী। এমনকি করোনাকালে সারাবিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বেসরকারী সংস্থা ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ গত মে, ২০২০ মাসে প্রকাশিত জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ২৭টি জেলায় এপ্রিল ২০২০ মাসে ৪২৪৯ জন নারী এবং ৪৫৬ টি শিশু পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন।জরিপে অংশ নেয়া এক হাজার ৬৭২ জন নারী এবং ৪২৪ টি শিশু আগে কখনো নির্যাতনের শিকার হয়নি।
আইন ও সালিশকেন্দ্র এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ১৭০৩ জন নারীকে ধর্ষণ করা হয় এবং ৭৭ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। আগস্ট ২০২০ পর্যন্ত ৮৮৯ জন নারী কে ধর্ষণ করা হয় ও ৪১ জন কে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম এর তথ্যমতে, ২০১৯ সালে ১০০৮ জন শিশু এবং আগস্ট ২০২০ পর্যন্ত ৩২৪ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়।
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলায় গত ২ সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাতে এলাকার সন্ত্রাসী দ্বারা ধর্ষণের চেষ্টা ও তাকে উলঙ্গ করে যৌনাঙ্গে আঘাত ও মারধর করা এবং এই পৈচাশিক আচরণের ভিডিও ধারণ করা হয়। ৩২ দিন পর গত ৪ অক্টোবর, ২০২০ ঐ ভিডিও ফেসবুকে প্রকাশ হলে তা ভাইরাল হয় ও সারাদেশের মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। ভিকটিম জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে জানায়, ইতিপূর্বেও ধর্ষক দেলোয়ার তাকে জোরপূর্বক ০২ বার ধর্ষণ করে। এর আগে সিলেটের এম.সি কলেজ ও খাগড়াছড়িতে উপজাতীয় নারীকে গণধর্ষণ আমাদের সমাজ ব্যবস্থা কে প্রচন্ড ঝাকুনি দেয় নারীর নিরাপত্তা নিয়ে।
‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’এর মতে, বর্তমান করোনাকালে পারিবারিক সহিংসতা ৬৫% বৃদ্ধি পেয়েছে এবং শিশুর প্রতি সহিংসতা ৩১% বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশে করোনাকালে নারী নির্যাতনে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ও নিষ্ঠুর ঘটনা সংগঠিত হয়। করোনাকালে বিভিন্নস্থানে পুলিশ পরিচয়ে ডাকাতিকালে অনেক নারীকে ধর্ষণ করা হয়। ফেনীতে ফেসবুক লাইভে গৃহবধুকে তার স্বামী গত ১৫ এপ্রিল ২০২০ তারিখে নিমর্মভাবে হত্যা করে। বাংলাদেশের নারীর প্রতি নির্যাতন ও সহিংসতার অন্যতম মুল কারণ, পুলিশ ও আদালতের নিকট অভিযোগ না করা। একটি জরিপে দেখা যায়, ৮০% নারী কোন না কোন সহিংসতার শিকার। এদের ৭২% উক্ত সহিংসতার বিষয় প্রকাশ করেন না।
বাংলাদেশের যৌন নির্যাতন, নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ২০০৯ সালে গবেষণা করে। সিপিডি এর গবেষণা ছিলো মূলত পারিবারিক সহিংসতা নিয়ে। তবে নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক সংস্থা কেয়ার (CARE) গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতার কারণে বাৎসরিক আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ২৩০ কোটি ডলার বা প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। এই অর্থ মোট দেশজ উৎপাদনের (GDP) ২.১ শতাংশ। [প্রথম আলো, ৯ অক্টোবর, ২০২০]
১৯৭৯ সালে নারীর প্রতি নির্যাতন ও বৈষম্য দূর করার উদ্দেশ্যে নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও) জাতিসংঘ কর্তৃক স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশ উক্ত সনদের সদস্য রাষ্ট্র। এছাড়া ১৯৮৯ সালে শিশু অধিকার সনদ কার্যকর করা হয়। বাংলাদেশ উক্ত সনদেরও সদস্য রাষ্ট্র। উক্ত আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সরকার নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা রোধকল্পে ও সুরক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যে ‘পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০’ও ‘বিধি ২০১৩’ প্রণয়ন ও কার্যকর করে।
এই আইন নারী ও শিশুকে পারিবারিক সহিংসতা থেকে রক্ষার মূল আইন। কিন্তু দু:খজনক বিষয় হচ্ছে, এই আইনটি বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রয়োগ ও বাস্তবায়িত হচ্ছে না। উক্ত আইনের ২(১২) ও ৩ ধারায় পারিবারিক সহিংসতার ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। উক্ত ব্যাখ্যাটি প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইনের সহিত সঙ্গতিপূর্ণ।
আইনের ৩ ধারা অনুযায়ী পারিবারিক সহিংসতা বলতে, পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে এমন কোন ব্যক্তি কর্তৃক পরিবারের অপর কোন নারী বা শিশু সদস্যের উপর শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন অথবা আর্থিক ক্ষতিকে বুঝাবে। উক্ত চার ধরনের নির্যাতন ও ক্ষতিকে আলাদাভাবে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে।
এই আইনের বাস্তবায়নকারী হলো পুলিশ অফিসার, প্রয়োগকারী কর্মকর্তা (মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা), সেবাপ্রদানকারী কর্মকর্তা এবং জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। উক্ত আইনের ১০-১৪ ধারা অনুযায়ী সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি তার অভিযোগ যেকোন থানায় পুলিশ অফিসার(ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা), মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা বা সরাসরি আদালতের নিকট সুরক্ষার জন্য অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন। আদালতে অভিযোগ দায়ের করা হলে আদালত আসামী পক্ষকে প্রথমে কারণ দর্শানোর নির্দেশ দিবেন ও সাত কার্যদিবসের মধ্যে উক্ত অভিযোগ শুনানীর জন্য ধার্য করবেন।
এই আইনের ধারা ১৪ অনুযায়ী বিজ্ঞ আদালত চাইলে অভিযোগপ্রাপ্তির সাথে সাথে ভিকটিমের সুরক্ষা আদেশ (Protection Order) বা ভিকটিমের নিরাপত্তার জন্য বিশেষব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন। আইনের ধারা ১৫ অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট আদালত ভিকটিমের নিরাপত্তা ও স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ভিকটিমকে নিরাপদে বসবাসের সুযোগ, প্রতিপক্ষকে ভিকটিমের আবাসস্থলে যাতায়াতের নিষেধাজ্ঞা, ভিকটিমের জমি বা সম্পত্তিতে ভোগদখলের নিশ্চয়তা ও বেদখলের বিষয়ে প্রতিপক্ষকে নিষেধাজ্ঞা প্রদানের আদেশ ও সুরক্ষার আদেশ (Protection Order) দিতে পারেন। এই আইনের ১৬ ধারা অনুযায়ী ভিকটিমকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের আদেশ আদালত দিতে পারবেন। এছাড়া ভিকটিমের ও তার সন্তানের ভরণ পোষণ প্রদানের আদেশ আদালত দিতে পারবেন।
পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০ এর ২০ ধারা অনুযায়ী আদালত এই আইনের অধীন অভিযোগ বা যে কোন দরখাস্ত ষাট (৬০) কার্যদিবসের মধ্যে নিষ্পত্তি করবেন। অভিযোগের সত্যতা নিরূপণ করার জন্য আদালত চাইলে সরাসরি তদন্ত এর আদেশ দিতে পারবেন। এছাড়া অভিযোগ সংক্ষিপ্ত বিচার পদ্ধতিতে (Summary Trial) নিষ্পত্তি করতে হবে। আদালত চাইলে উভয়পক্ষকে নিয়ে রুদ্ধদার কক্ষে (Camra Trial) বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবেন।
উক্ত আইনের ২৯ ধারা অনুযায়ী এই আইনের অধিন সংগঠিত অপরাধ আমলযোগ্য, জামিনযোগ্য ও আপোষযোগ্য। এই আইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সুরক্ষা আদেশ। আইনের ৩০ ধারা অনুযায়ী প্রতিপক্ষ যদি আদালতের কোন সুরক্ষা আদেশ বা আদেশে উল্লেখিত কোন শর্ত লংঘন করে, তাহলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। উক্ত অপরাধের জন্য প্রতিপক্ষকে ৬ মাস কারাদন্ড বা ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত করা যাবে। যদি কোন প্রতিপক্ষ উক্ত অপরাধ পুনরাবৃত্তি করেন, সেক্ষেত্রে উক্ত প্রতিপক্ষকে ২ বৎসর পর্যন্ত কারাদন্ড বা ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড বা উভয়দন্ডে দন্ডিত করা যাবে।
আইনটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পারিবারিক সহিংসতা রোধে এবং নারী ও শিশু কে সুরক্ষা প্রদানের একটি প্রগতিশীল ও ইতিবাচক আইন। কিন্তু সারাদেশের তথ্য পর্যালোচনায় ও বাস্তবতা বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, এই আইনের প্রয়োগ খুবই কম ক্ষেত্রে হচ্ছে। বেশিরভাগ জেলায় বছরে ১-১০টির বেশি মামলা রুজু হয় না।
এই আইনের প্রয়োগ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুদা ২০১৬ সালে বগুড়া, যশোর, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরগুনা ও দিনাজপুর জেলার জানুয়ারী ২০১১- মে ২০১৫ পর্যন্ত সময়কালের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, এনজিও এর প্রজেক্টের সহায়তায় ৮টি উপজেলায় এই আইনের অধিন ১৭১ টি মামলা রুজু হয় এবং প্রজেক্ট বহির্ভূত ৫৭ টি উপজেলায় ৪৮টি মামলা রুজু হয়। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় গত ৩ বছরে ফেনী জেলায় আমি একটি মামলার দায়িত্ব পাই ও ভিকটিমের প্রতি সুরক্ষা আদেশ দিয়ে দ্রুত ইতিবাচক নিষ্পত্তি করি।
যেহেতু এই আইনের অভিযোগ জামিনযোগ্য এবং প্রতিপক্ষকে শুরুতে জেলে পাঠানোর বা হয়রানির সুযোগ কম থাকে, তাই এই আইনে অপরাধ হলেও, বাস্তবে যৌতুক নিরোধ আইন ১৯৮০(পরবর্তীতে প্রণীত আইন ২০১৮) এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর অধীন মামলা দায়ের করা হয়। এই আইনের সঠিক প্রয়োগ হলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ ও যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮ এর অধিন রুজুকৃত মিথ্যা ও হয়রানী মামলা অনেকাংশে কমে যাবে।
এই আইনটিকে অধিকতর কার্যকর করার লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োগকারী কর্মকর্তা হিসেবে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারকে (District Legal Aid Officer) অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। কারণ গরীব, অসহায় ও নির্যাতিত মহিলারা সাধারণত আইন ও আদালতের আশ্রয় লাভের উদ্দেশ্যে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে এসে থাকেন। জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার, যিনি একজন বিজ্ঞ বিচারক (Senior Assistant Judge), তিনি অভিযোগের প্রকৃতি বুঝে ভিকটিমের সুরক্ষার উদ্দেশ্যে উক্ত অভিযোগ আদালতে দায়ের করার তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। এছাড়া অভিযোগ যেহেতু আপোষযোগ্য, তিনি উভয়পক্ষের সাথে আলোচনা করে অভিযোগ মিমাংসা (ADR) করে দিতে পারেন।
আইনটিকে বাস্তবিক অর্থে প্রয়োগ করার লক্ষ্যে ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ ও মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তাকে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান করা প্রয়োজন। আইনের প্রয়োগ নিয়েও মনিটরিং করা প্রয়োজন। আইনটিকে অধিকতর কার্যকর ও প্রয়োগ করার লক্ষ্যে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার প্রয়োজন। স্থানীয় এনজিও কে এই আইনে সহায়তা করার লক্ষ্যে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। এছাড়া প্রতিটি থানা, মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার অফিস ও জেলা লিগ্যাল এইড অফিসকে এই আইনের অধীন সহায়তা প্রদান ও ব্যবস্থা গ্রহনের লক্ষ্যে কার্যকরকেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলা হলে এই আইনের কার্যকারিতা ও সুষ্ঠু প্রয়োগ বৃদ্ধি পাবে।
মোঃ জাকির হোসাইন: সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, ফেনী।