আজ থেকে ২৬ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৯৪ সালে জেলা জজ ও জুডিসিয়াল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মাসদার হোসেন দেশের বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার জন্য মামলা দায়ের করেন। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথকীকরণের ওই রিট মামলায় সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগের চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করা হয় ১৯৯৯ সালে। ১২ দফা নির্দেশনা সম্বলিত ওই রায়ের আট বছর পর মূল নির্দেশনাটি বাস্তবায়ন করে ২০০৭ সালের পহেলা নভেম্বর অর্থাৎ আজকের দিনে বিচার বিভাগকে আলাদা করা হয়েছিল।
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার গোড়াপত্তন ঘটে মাসদার হেসেন মামলার রায়ের আলোকে। সে রায়ের ফলে ১৩ বছর আগে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ করা হয়। এরপর থেকে শুরু হয় বিচার বিভাগের স্বাধীন পথচলা।
অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা থাকায় শুরুতে বিচারকদের এজলাস ভাগাভাগি করে কাজ করতে হতো। তবে সময়ের ব্যবধানে সে অবস্থার অনেকটাই উত্তরণ করতে পেরেছে বিচার বিভাগ। গত এক যুগেরও বেশি সময়ে একদিকে বিচার বিভাগের অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, কিন্তু লাগামহীন হয়ে পড়েছে মামলাজট। আর এই মামলা জট স্বাধীন বিচার বিভাগকে শান্তিতে শ্বাস গ্রহণের স্বাদ থেকে বঞ্চিত করছে।
২০০৭ সালে বিচার বিভাগ আলাদা করার সময় দেশের সব আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ১৫ লাখ ৭০ হাজার। বর্তমানে সেই মামলার জট এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০ লাখে। এর মধ্যে অধস্তন আদালতেই বিচারাধীন মামলা প্রায় ৩৫ লাখ।
সুপ্রিম কোর্ট থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টে মোট বিচারপতি রয়েছেন ১০২ জন। আর দেশের অধস্তন আদালতগুলোতে বিচারকের সংখ্যা এক হাজার ৮০১ জন। অথচ সারাদেশে মামলার সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখেরও বেশি।
কয়েকটি সূত্র থেকে জানা গেছে, অধস্তন আদালতে বিচারকদের সংখ্যা এক হাজার ৮০১ জন হলেও আদালতের মূল বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে আছেন প্রায় এক হাজার ৪০০ জন বিচারক। আর অবশিষ্ট বিচারকগণ সুপ্রিম কোর্ট, আইন মন্ত্রণালয়, ট্রাইব্যুনাল, আইন কমিশনসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ডেপুটেশনে (পদায়ন) কর্মরত রয়েছেন। ফলে বিচারকদের কৃত্রিম সংকট মামলাজট নিরসনে ডেকে এনেছে বিপর্যয়।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারক নিয়োগ, যথোপযুক্ত লজিস্টিক সাপোর্ট এবং বিচার সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠান সংস্থার সুসমন্বয় করতে পারলে ক্রমবর্ধমান মামলা জটের অভিশাপ থেকে মুক্ত হবে বিচার বিভাগ।
পৃথক সচিবালয় গঠন না হওয়াটাই স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা। কারণ বিচারকদের পদোন্নতি, বদলি, পদায়নের বিষয়গুলোতে আইন মন্ত্রণালয়ই প্রাধান্য পাচ্ছে বলেও মনে করেন কেউ কেউ।
এছাড়া মামলার সংখ্যা অনুপাতে বিচারকের সংখ্যা কম এবং সময়মতো সাক্ষী আদালতে হাজির না করাও বিচারের দীর্ঘসূত্রতার অন্যতম কারণ। ঢাকার বাইরে আবাসন ও যাতায়াত, নিরাপত্তাসহ কয়েকটি সমস্যাও বিচারকদের নিত্যসঙ্গী। এ নিয়ে বিচারকদের মধ্যে হতাশা রয়েছে।
তবে সীমিত সংখ্যক ম্যাজিস্ট্রেট এবং বিশাল মামলার বোঝা মাথায় নিয়েও বিগত ১৩ বছরে শুধু ম্যাজিস্ট্রেট আদালতসমূহ প্রায় ৯০ লক্ষাধিক মামলা নিষ্পত্তি করেছে যা বিশ্বের যে কোন দেশের তুলনায় আনুপাতিক হারে অনেকগুণ বেশি।
বিচার বিভাগে মামলাজট নিরসন করা না গেলে আদালত অঙ্গনের অনিয়ম ও দুর্নীতিগুলো রোধ করা সম্ভব হবে না। আবার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলেও মামলাজট নিরসন জরুরি। বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ দিবসে প্রত্যাশা এসব বিষয়ে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে সংশ্লিষ্টদের দৃশ্যমান পদক্ষেপ গৃহীত হবে।