কাজী শরীফ: স্বত্বসাব্যস্তে খাসদখলের মোকদ্দমা আমার আদালতে বিচারাধীন। বাদী রফিক (ছদ্মনাম) দাবি করেছেন ২০১৪ সালের পহেলা জুন তিনি তার ভাই জহিরকে (ছদ্মনাম) নিজের জায়গায় সাময়িক ঘর করার অনুমতি দেন। কারণ ভাই তার পুরনো ঘর সংস্কার করতে চায়৷সংস্কার করার সময় তার থাকার জায়গা না থাকায় অনুমতিসূত্রে ঘর করতে দেয়। জহির ঘর করার পর তাকে জায়গা ছেড়ে দিতে বাদী অনুরোধ করলে তিনি সরে যেতে অস্বীকার করায় রফিক এ মোকদ্দমা আনয়ন করেন।
বিবাদী ছোটভাই জহির দাবি করেন উভয়ের মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ থাকায় স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের মধ্যস্থতায় সালিসি বোর্ড গঠন করা হয় ও উভয়পক্ষের স্বাক্ষরযুক্ত মধ্যস্থতায় বিবাদীকে নালিশী জায়গায় ঘর করার অনুমতি দেয়া হয়। বাদী সে হিসেবে ২০০৩ সালে এ জায়গায় ঘর করে। পুকুর, বাগান নিয়ে তার ছোট বাড়ি।
উভয়ে নিজ নিজ দাবির পক্ষে বক্তব্য উপস্থাপন করেন। দখলের সাক্ষী চিরায়ত নিয়মে তাকে আনীত পক্ষের পক্ষে সাক্ষ্য দেন। আমি দুটো বিষয় বিবেচনা করলাম।
প্রথমত, সালিশে বন্টননামা আদতেই হয়েছে কিনা? দেখলাম হয়েছে। তবে একেবারে সহি শুদ্ধ হয়নি। উভয়ের স্বাক্ষর আছে। রফিক স্বাক্ষর তার না দাবি করলেও এটা যে তারই স্বাক্ষর আরজির স্বাক্ষরের সাথে মেলালেই বোঝা যায়।
দ্বিতীয়ত, ঘরটা কত সালে করা। ২০০৩ এ না ২০১৪ তে? ঘর যদি ২০০৩ এ হয় তাহলে ভাইদের মধ্যে একসময় আপস হয়েছিল আর ২০১৪ সালে হলে রফিকের দাবি সত্য।
ভাবলাম পরিচয় গোপন করে নালিশী জায়গাটা দেখে আসলে কেমন হয়! আরজি ও জবাব পড়ে নালিশী ঠিকানা লিখে নিলাম। আমার সাবেক পেশকার সাইফুর রহমানকে নিয়ে ভোর সাড়ে ছয়টায় যাত্রা শুরু করলাম। প্রায় এক ঘন্টা পর নালিশী জায়গার কাছাকাছি বাজারে পৌঁছলাম। গ্রামের বাজারে মানুষ তখন চা নানরুটি খাচ্ছে। পরিচয় গোপন রেখে মাস্ক পরা অবস্থায় তাদের সাথে গল্প জুড়ে দিলাম। নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষা জানায় ব্যাপারটা খুব সহজ হলো। তারাও আমাকে তাদেরই একজন ভেবে নিলো।
এ কথা সে কথা বলতে বলতে বাদী-বিবাদীদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম। গ্রামের মানুষ সহজ সরল। ফজরের নামাজ পড়ে চা দোকানে এসে বসেছে। তাদের কোন স্বার্থ নেই এ বিষয়ে। বললো ভাইয়ে ভাইয়ে দ্বন্দ্ব বহুদিনের। জহির ঘর করেছে ১৮/২০ বছর হয়েছে। একসময় সালিশ হয়েছিল। এখন রফিক অস্বীকার করে। জহির গরীব। রিকশা চালায়। তাকে ঘর থেকে তুলে দিতে পারলে রফিক জায়গাটা দখল করে ফেলবে!
তাদের মাধ্যমে বাড়িটা চিনে নিলাম। বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়েই বুঝলাম এ বাড়ির গাছপালা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় এটা নতুন বাড়ি নয়। গ্রামের মানুষের বক্তব্য সত্য। নিজ চোখে দেখা ঘটনার সাথে সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও উপস্থাপিত দলিল পর্যালোচনা করে রায় দিলাম বাদীর মোকদ্দমা খারিজ। মোকদ্দমাটি নিষ্পত্তি করেছি আগে। নিষ্পত্তিকৃত বলে কারো নামোল্লেখ না করে লিখলাম।
একটা দিনের দুই ঘন্টা ঘুম বিসর্জন দিয়ে ও গাঁটের কিছু টাকা খরচ করে যদি তুলনামূলক উত্তম বিচার করা যায় তাহলে ঘুম ও অর্থ খরচ করাই যায়! আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ আমাকে এ সুযোগ দিয়েছেন বলে চেষ্টা করছি ন্যায়বিচার করার। আমার এরকম আরও গল্প আছে। সময় সুযোগ হলে হয়তো পরের কিস্তিতেই জানবেন। ততদিনের জন্য বিদায়।
কাজী শরীফ: সহকারী জজ, নোয়াখালী।