ভূমি বিরোধ এবং আদালতে এ-সংক্রান্ত মামলাজট কমাতে ভূমি ব্যবস্থাপনা ডিজিটাল করাসহ নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বিদ্যমান ভূমি আইনও যুগোপযোগী করা হচ্ছে। এরই মধ্যে ‘ভূমি আইন ২০২০’-এর একটি খসড়াও চূড়ান্ত করেছে আইন কমিশন।
কৃষির ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তি ও পরিবারকে সর্বোচ্চ ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির জন্য কর দিতে হবে না। তবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল না হলে যেকোনো পরিমাণ জমির জন্য ভূমি উন্নয়ন কর (খাজনা) দিতে হবে। এমন বিধান রেখে করা হচ্ছে নতুন ভূমি উন্নয়ন কর আইন।
‘দ্য ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ট্যাক্স অর্ডিন্যান্স ১৯৭৬’ যুগোপযোগী করে ইতোমধ্যে ‘ভূমি উন্নয়ন কর আইন, ২০২০’ এর খসড়া তৈরি করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়। খসড়া আইন অনুযায়ী, ভূমি উন্নয়ন কর ধার্য হবে অর্থবছর (১ জুলাই থেকে ৩০ জুন) অনুযায়ী। এখন কর ধার্য হয় বাংলা সন অনুযায়ী।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এ সংক্রান্ত পরিপত্র, আদেশ ছাড়াও নতুন নতুন বিষয় যুক্ত করে ভূমি উন্নয়ন কর সংক্রান্ত ১৯৭৬ সালের অধ্যাদেশটি যুগোপযোগী করে নতুন আইনের খসড়া করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মাক্ছুদুর রহমান পাটোয়ারী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘নতুন ভূমি উন্নয়ন কর আইনের প্রাথমিক খসড়া আমরা করেছি। এখন এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের মতামত নিচ্ছি। মতামতগুলো, বাস্তবতা এবং সরকারের সঙ্গতি বিবেচনায় নিয়ে আমরা খসড়াটি চূড়ান্ত করব।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমান অধ্যাদেশটি অনেক পুরোনো। সরকারের, জনগণের, রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। ভূমি উন্নয়ন কর আইনকেও এর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করা দরকার। সেই চিন্তা থেকেই নতুন আইন করা হচ্ছে।’
১২৬ পৃষ্ঠার খসড়া আইনে ব্যক্তিমালিকানাধীন ভূমি জরিপ, রেকর্ড, হস্তান্তর, বিরোধ নিরসন, অবৈধ দখলদার উচ্ছেদসহ ভূমি অধিগ্রহণ, সরকারি সম্পত্তি সংরক্ষণের বিষয়ে নানা বিধান রাখা হয়েছে। তবে মামলাজট কমাতে এসব বিষয়ে জেলা প্রশাসক বা সংশ্নিষ্ট প্রশাসনকেই দেওয়া হয়েছে চূড়ান্ত ক্ষমতা।
এ বিষয়ে প্রচলিত দেওয়ানি আদালতে কোনো ধরনের মামলা করা যাবে না বলেও প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, যা নিয়ে আপত্তি আইনজ্ঞদের। তারা বলছেন, এই বিধান কার্যকর হলে দেওয়ানি আদালতের ক্ষমতা খর্ব হবে। পাশাপাশি সংশ্নিষ্ট নাগরিকের ভোগান্তি ও ব্যয় বাড়বে। কারণ তখন ভূমি-সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিষ্পত্তির জন্য তাদের হাইকোর্টে রিট দায়ের করতে হবে।
খসড়া আইনটি পর্যালোচনায় দেখা যায়, সব মিলিয়ে আইনটিতে ১৬টি অধ্যায় রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ভূমি জরিপ ও রেকর্ড, রেকর্ড সংরক্ষণ ও হালকরণ, ভূমি হস্তান্তর, অর্জন, বন্ধক ও হস্তান্তর-পরবর্তী রেকর্ড, ভূমি উন্নয়ন কর, কৃষি-অকৃষি সুরক্ষা, ভূমি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখল, সিকস্তি ও পয়স্তি জমি, নদী, জলাশয়, উপকূল, সরকারি জমি, খাসজমি, সায়রাতমহল, বনভূমি, অর্পিত সম্পত্তি ও পরিত্যক্ত সম্পত্তি, ওয়াক্ফ, দেবোত্তর, ভূমি মালিকানা বিরোধ, অবৈধ জবরদখল ও উচ্ছেদসহ বিভিন্ন বিষয়।
খসড়ায় শুরুতেই প্রতিটি বিষয়ের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। খসড়ায় বনভূমি অবৈধ দখলকারী-সংক্রান্ত বিষয়সহ একাধিক অধ্যায়ের বর্ণনায় বলা হয়েছে, জেলা প্রশাসক বা জেলা প্রশাসন ভূমির সংশ্নিষ্ট বিষয়ে নিষ্পত্তি করবেন। এক্ষেত্রে ক্ষুব্ধ ব্যক্তি জেলা প্রশাসকের সিদ্ধান্ত ঘোষণার ৩০ দিনের মধ্যে বিভাগীয় কমিশনারের কাছে আপিল করতে পারবেন এবং বিভাগীয় কমিশনার ওই আবেদন গ্রহণের ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করবেন। তবে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি জেলা প্রশাসকের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল না করলে বা বিভাগীয় কমিশনারের কাছে আপিল দায়ের করলে ওই আপিল আদেশ চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।
অন্যদিকে ‘দেওয়ানি আদালতের এখতিয়ারে বাধানিষেধ’ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘এই আইনের আওতায় সংরক্ষিত বা রক্ষিত বনভূমিতে অবৈধ অবকাঠামো বা ইমারত নির্মাণকারী বা অবৈধ চাষাবাদকারী বা অন্য কোনো উপায়ে শ্রেণি পরিবর্তনকারীর বিষয়ে জেলা প্রশাসক কর্তৃক গৃহীত কার্যক্রমের বিরুদ্ধে, দেওয়ানি আদালতে কোনো মামলা গ্রহণযোগ্য হবে না।’
খসড়ায় বলা হয়েছে, কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তি ও পরিবারভিত্তিক কৃষিজমির পরিমাণ ৮ দশমিক ২৫ একর (২৫ বিঘা) পর্যন্ত হলে কোনো ভূমি উন্নয়ন কর দিতে হবে না। মওকুফের অধীন আখ আবাদ, লবণ চাষের জমি এবং কৃষকের পুকুর (বাণিজ্যিক মৎস্য চাষ ছাড়া) অন্তর্ভুক্ত হবে।
কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তি ও পরিবারভিত্তিক কৃষিজমির পরিমাণ ২৫ বিঘার বেশি হলে বা কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল নয় এমন কোনো ব্যক্তি বা পরিবার বা কোনো সংস্থার যেকোনো পরিমাণ কৃষিজমি থাকলে সম্পূর্ণ জমির ভূমি উন্নয়ন কর দিতে হবে বলে খসড়া আইনে উল্লেখ করা হয়েছে।
বর্তমান আইন অনুযায়ী, ব্যক্তি ও পরিবারভিত্তিক কৃষিজমির মোট পরিমাণ ৮ দশমিক ২৫ একর (২৫ বিঘা) পর্যন্ত হলে কোনো ভূমি উন্নয়ন কর দিতে হয় না। ভূমি উন্নয়ন করের হার অর্থপ্রতি ১ শতাংশ জমির এক বছর সময়ের জন্য এ আইন বা এর অধীন প্রজ্ঞাপন দ্বারা নির্ধারিত ভূমি উন্নয়ন কর।
আবাসিক জমি, বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত জমি, শিল্পকাজে ব্যবহৃত জমি, কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তি বা পরিবার, ভূমি মালিকসহ বিভিন্ন বিষয়ে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে খসড়া আইনে।
অকৃষিজমির ভূমি উন্নয়ন করের হার নির্ধারণের জন্য অগ্রসরতার মানদণ্ডে দেশের সব জমি ক, খ, গ, ঘ ও ঙ- এই পাঁচটি এলাকায় শ্রেণিবিভাগ বিবেচিত হবে, যা সরকার গেজেট প্রজ্ঞাপন দিয়ে সময়ে সময়ে খতিয়ানে বর্ণিত অংশ অনুসারে নির্ধারণ করবে।
উত্তরাধিকার বা অন্য কোনো হস্তান্তরের ফলে জমির মালিক একাধিক ব্যক্তি হলে তারা জমা খারিজ করে আলাদা নামজারি না করালে একই দাগভুক্ত হিসেবে জমির ওপর ভূমি উন্নয়ন কর আরোপ করা হবে।
প্রতি বছর জুলাই মাসের ১ তারিখ থেকে জুন মাসের শেষ তারিখ পর্যন্ত অর্থবছর অনুযায়ী ভূমি উন্নয়ন কর জরিমানা ছাড়া আদায় করা যাবে। বকেয়া ও হাল ভূমি উন্নয়ন কর আদায়ের সঙ্গে বা পরে ভূমির মালিক আগ্রহী হলে সর্বোচ্চ তিন বছরের ভূমি উন্নয়ন কর আদায় করা যাবে। অগ্রীম আদায়ের ক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে ভূমি উন্নয়ন করের হার বাড়লে বর্ধিত পরিমাণ সরকারি পাওনা অবশ্যই আদায় করতে হবে বলে খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়, নাগরিকের সুবিধার্থে চলমান পদ্ধতির পাশাপাশি ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতেও সরকার ভূমি উন্নয়ন কর দেয়ার ব্যবস্থা করবে। সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের তফসিলি যেকোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতেও ভূমি উন্নয়ন কর আদায়ের ব্যবস্থা করবে।
কোনো বছরের ভূমি উন্নয়ন কর সেই বছরের ৩০ জুনের মধ্যে পরিশোধ করা না হলে তা বকেয়া হিসেবে বিবেচিত হবে। বকেয়া ভূমি উন্নয়ন করের ওপর প্রথম বছর বার্ষিক ১০ শতাংশ হারে, দ্বিতীয় বছর ১৫ শতাংশ হারে এবং তৃতীয় বছর থেকে ২০ শতাংশ হারে জরিমানা আদায় করতে হবে। তৃতীয় বছর শেষে ‘দ্য পাবলিক ডিমান্ড রিকভারি অ্যাক্ট, ১৯১৩’ অনুযায়ী সার্টিফিকেট মামলা চালু করতে হবে। সার্টিফিকেট মামলার মাধ্যমে বকেয়া করের ওপরের হার অনুযায়ী জরিমানাসহ আদায় করতে হবে বলে খসড়া আইনে উল্লেখ করা হয়েছে।
কোনো ভূমি মালিকের একই মৌজায় একাধিক খতিয়ানের জমি থাকলে তা একটি জমাবন্দিতে একত্রিত করে ভূমি উন্নয়ন কর নির্ধারণ ও আদায় করতে হবে। ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে একক মালিকের মৌজাভিত্তিক জমাবন্দি বা উপজেলা, জেলা বা পুরো এলাকার জমির তথ্য মন্তব্য কলামে দেখানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এজন্য ভূমি মালিকের তথ্যাদির সঙ্গে মোবাইল নম্বর ও জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক করতে হবে। এই তথ্যের ভিত্তিতে ভূমি উন্নয়ন কর নির্ধারণ ও আদায় করতে হবে।
কোনো ভূমি মালিকের কোনো দাগের জমি শতাংশের ভগ্নাংশ থাকলে তা পরবর্তী পূর্ণ শতাংশে গণ্য করে ভূমি উন্নয়ন কর নির্ধারণ করা হবে।
কোনো সরকারি কবরস্থান, শ্মশান, জামে মসজিদ, ঈদগাহ, মাঠ, সার্বজনীন মন্দির, গির্জা বা সর্বসাধারণের প্রার্থনার স্থান ভূমি উন্নয়ন করের বাইরে থাকবে জানিয়ে খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, ‘তবে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, গোত্রীয়, দলীয় ও সম্প্রদায়ভিত্তিক উপাসনালয় বা সমাধিক্ষেত্র এবং দান ও দর্শনীর অর্থে বা সহায়ক বাণিজ্যিক কার্যক্রমের মাধ্যমে পরিচালিত উপাসনালয় বা সমাধিক্ষেত্র ভূমি উন্নয়ন করের আওতায় থাকবে।’
এতে আরও বলা হয়, ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা প্রতি বছর আগস্ট মাসের মধ্যে তার আওতাধীন এলাকা পরিদর্শন করে জমির ব্যবহারের প্রকৃতি পরিবর্তন হলে তার ভিত্তিতে সব মৌজার জমাবন্দিভিত্তিক ভূমি উন্নয়ন কর নির্ধারণ করে নির্ধারিত ফরমে তালিকা প্রণয়ন করবেন। এরপর তা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) অনুমোদন নিয়ে জনসাধারণের পরিদর্শনের লক্ষ্যে প্রকাশ ও প্রচার করবেন এবং ওয়েবসাইটে দেবেন।
ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে সব জমাবন্দি (নাম, জমি ও খাজনার বিবরণী) অন্তর্ভুক্ত থাকলে ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা জুলাই মাসের মধ্যে ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে নির্ধারিত ফরমে ভূমি উন্নয়ন করের তালিকা প্রণয়ন করবেন। এ বিষয়ে সহকারী কমিশনারের (ভূমি) অনুমোদন নেবেন। এরপর এই তালিকার জমাবন্দি মালিকদের কাছে মোবাইল মেসেজের মাধ্যমে ভূমি উন্নয়ন করের পরিমাণ জানিয়ে দেয়া হবে। এই নোটিফিকেশন ভূমি উন্নয়ন কর নির্ধারণের নোটিশ জারি বলে বিবেচিত হবে।
খসড়ায় বলা হয়, ভূমি উন্নয়ন কর নির্ধারণী তালিকা প্রকাশের পর কোনো ব্যক্তি সংক্ষুব্ধ হলে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে কোর্ট ফিসহ লিখিত আবেদনের মাধ্যমে আপত্তি জানাতে পারবেন। সহকারী কমিশনার (ভূমি) ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে তা নিষ্পত্তি করবেন। সহকারী কমিশনার (ভূমি) ১৫ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে ব্যর্থ হলে সংক্ষুব্ধ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সংশ্লিষ্ট জেলা কালেক্টরের (জেলা প্রশাসক) কাছে আপিল করতে পারবেন।
কালেক্টর আপিল আবেদন পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে নিজে বা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) মাধ্যমে তা নিষ্পত্তি করবেন। এক্ষেত্রে কালেক্টরের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে খসড়া আইনে উল্লেখ করা হয়েছে।