মুসলিম ফরায়েজ নিয়ে তিন পর্বের ধারাবাহিকের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বে মুসলিম ফরায়েজে সম্পত্তি বণ্টন প্রক্রিয়া, ফরায়েজ যোগ্য সম্পত্তির পরিমাণ, মৃতব্যক্তির সম্পত্তি কার কত অংশ প্রাপ্য, ওয়ারিশের শ্রেণীবিভাগ, আউল ও রাদ নীতি সহজ ভাষায় আলোচনার করার চেষ্টা করা হয়েছে। আজকে তৃতীয় ও শেষ পর্বের আলোচনার বিষয় বিবিধ ফরায়েজ। এ অংশে মুসলিম ফরায়েজে প্রতিবন্ধী, হিজড়া, শিয়া, গুমের শিকার, নাস্তিক, অমুসলিম, সমকামী, হত্যাকারী ইত্যাদি ওয়ারিশের অবস্থান নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। লিখেছেন অ্যাডভোকেট সাব্বির এ মুকিম।
বিবিধ ফরায়েজ: এবার আমরা আরোচনা করবো ফরায়েজের সম্বন্ধীয় বিবিধ বিষয়গুলোতে। এসব বিষয় বস্তুর বেশীরভাগই যতোটা না প্রায়োগিক তারচেও বেশী মুখরোচক।
প্রতিবন্ধী সন্তানের মুসলিম ফরায়েজ: এই আলাপ তোলাটাই ইসলামের অবমাননা। কেননা প্রতিবন্ধীদেরকে আলাদা করার কোনো সুযোগ মুসালিম ফরায়েজ বিধানে রাখা হয়নি। তাঁরা স্বাভাবিক ওয়ারিশের মতো সমান সমান হারে হকদার।
পালিত বা দত্তক সন্তানের মুসলিম ফরায়েজ: মুসলিম আইনে দত্তক বা পালিত সন্তান বলে কিছু নাই। ফলে মুসলিম ফরায়েজে পালিত বা দত্তক সন্তান কোনো সম্পত্তি পাবে না।
টেস্ট টিউব সন্তান, সারগোসি সন্তানের ক্ষেত্রে মুসলিম ফরায়েজ: এই বিষয়টি একেবারেই হাল যামানার বিধায় এখনও এই বিষয় সংক্রান্ত মুসলিম ফরায়েজের বিধান নিয়ে কোনো উপসংহার দেখা যায়নি। বিদ্যমান টেক্সটের আলোকে শুধু এটুকুই বলা যায় একটি টেস্ট টিউব সন্তান বা সারগোসি সন্তানের মুসলিম ফরায়েজে অবস্থান জানার জন্য ৩টি প্রশ্ন বিবেচ্য:
(১) শুক্রানু দাতা, এবং
(২) ডিম্বানু দাতা এবং
(৩) উভয় দাতার মধ্যে বৈবাহিক বৈধতা
ধর্ষণের ফলে জন্মানো সন্তানের মুসলিম ফরায়েজ: ধর্ষণের ফলে জন্ম নেয়া সন্তানের উত্তরাধীকার কোনো ব্যক্তিগত আইনেই দেয়া হয় নাই। তবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী ২০২০)-এর নীচের কয়টি ধারা এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক-
ধর্ষণের ফলশ্রুতিতে জন্মলাভকারী শিশু সংক্রান্ত বিধান
[ধারা ১৩ (১) অন্যকোন আইনে ভিন্নতর যাহা কিছুই থাকুক না কেন, ধর্ষণের কারণে কোন সন্তান জন্মলাভ করিলে-
(ক) উক্ত সন্তানকে তাহার মাতা কিংবা তাহার মাতৃকুলীয় আত্মীয় স্বজনের তত্ত্বাবধানে রাখা যাইবে;
(খ) উক্ত সন্তান তাহার পিতা বা মাতা, কিংবা উভয়ের পরিচয়ে পরিচিত হইবার অধিকারী হইবে;
(গ) উক্ত সন্তানের ভরণপোষণের ব্যয় রাষ্ট্র বহণ করিবে;
(ঘ) উক্ত সন্তানের ভরণপোষণের ব্যয় তাহার বয়স একুশ বৎসর পূর্তি না হওয়া পর্যন্ত প্রদেয় হইবে, তবে একুশ বত্সরের অধিক বয়স্ক কন্যা সন্তানের ক্ষেত্রে তাহার বিবাহ না হওয়া পর্যন্ত এবং পঙ্গু সন্তানের ক্ষেত্রে তিনি স্বীয় ভরণপোষণের যোগ্যতা অর্জন না করা পর্যন্ত প্রদেয় হইবে।
(২) সরকার বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে উপ-ধারা (১) এ উল্লিখিত সন্তানের ভরণপোষণ বাবদ প্রদেয় অর্থের পরিমাণ নির্ধারণ করিবে।
ভবিষ্যত্ সম্পত্তি হইতে অর্থদণ্ড আদায়
ধারা ১৫: এই আইনের ধারা ৪ হইতে ১৪ পর্যন্ত ধারাসমূহে উল্লিখিত অপরাধের জন্য ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক আরোপিত অর্থদণ্ডকে, প্রয়োজনবোধে, ট্রাইব্যুনাল অপরাধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির জন্য ক্ষতিপূরণ হিসাবে গণ্য করিতে পারিবে এবং অর্থদণ্ড বা ক্ষতিপূরণের অর্থ দণ্ডিত ব্যক্তির নিকট হইতে বা তাহার বিদ্যমান সম্পদ হইতে আদায় করা সম্ভব না হইলে, ভবিষ্যতে তিনি যে সম্পদের মালিক বা অধিকারী হইবেন সেই সম্পদ হইতে আদায়যোগ্য হইবে এবং এইরূপ ক্ষেত্রে উক্ত সম্পদের উপর অন্যান্য দাবী অপেক্ষা উক্ত অর্থদণ্ড বা ক্ষতিপূরণের দাবী প্রাধান্য পাইবে।
অর্থদণ্ড বা ক্ষতিপূরণ আদায়ের পদ্ধতি
ধারা ১৬: এই আইনের অধীনে কোন অর্থদণ্ড আরোপ করা হইলে, ট্রাইব্যুনাল সংশ্লিষ্ট জেলার কালেক্টরকে, বিধিদ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে বা অনুরূপ বিধি না থাকিলে, ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক নির্ধারিত পদ্ধতিতে, অপরাধীর স্থাবর বা অস্থাবর বা উভয়বিধ সম্পত্তির তালিকা প্রস্তুত ক্রমে ক্রোক ও নিলাম বিক্রয় বা ক্রোক ছাড়াই সরাসরি নিলামে বিক্রয় করিয়া বিক্রয়লব্ধ অর্থ ট্রাইব্যুনালে জমা দিবার নির্দেশ প্রদান করিতে পারিবে এবং ট্রাইব্যুনাল উক্ত অর্থ অপরাধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে প্রদানের ব্যবস্থা করিবে।
(৩) এই ধারার অধীন কোন সন্তানকে ভরণপোষণের জন্য প্রদেয় অর্থ সরকার ধর্ষকের নিকট হইতে আদায় করিতে পারিবে এবং ধর্ষকের বিদ্যমান সম্পদ হইতে উক্ত অর্থ আদায় করা সম্ভব না হইলে, ভবিষ্যতে তিনি যে সম্পদের মালিক বা অধিকারী হইবেন সেই সম্পদ হইতে উহা আদায় যোগ্য হইবে।]
জারজ সন্তান
(১) কোনো সন্তান তার জারজ বাবার ওয়ারিশ নন।
(২) কোনো পুরুষ তার জারজ সন্তানের ওয়ারিশ নন।
(৩) জারজ সন্তান কেবলমাত্র তার মা এর পক্ষের স্বজন হতে সম্পদ পাবে।
(৪) জারজ সন্তানের মা এবং মা এর পক্ষের স্বজনরাই কেবল সে জারজ সন্তানের ওয়ারিশ হতে পারেন। তবে মা এর বৈধ সন্তান ও অপর জারজ সন্তান এই স্বজন শ্রেণী হতে বাদ দেয়া হয়েছে। তার মানে হলো একই পিতার বৈধ সন্তানের পরস্পর পরস্পরের আপন সহোদর হিসেবে সম্পত্তি পাবার সুযোগ দেয়া থাকলেও একই পিতার জারজ সন্তানেরা পরস্পর পরস্পরের আপন সহোদর হিসেবে সম্পত্তি পাবার সুযোগ নাই।
(৬) একজন জারজ সন্তান তার মায়ের বৈধ সন্তান এর উত্তরাধিকার পায়না।
(৭) একজন জারজ সন্তান তার মায়ের অপর জারজ সন্তান এর উত্তরাধিকার পায়না।
(৮) একজন জারজ সন্তান এর সম্পত্তিতে তার মায়ের বৈধ সন্তান উত্তরাধিকার পায়না।
(৯) একজন জারজ সন্তান এর সম্পত্তিতে তার মায়ের অপর জারজ সন্তান উত্তরাধিকার পায়না।
(১০) একজন জারজ সন্তান তার মায়ের বৈধ সন্তান এর সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার পায়না।
তবে আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে, জারজ সন্তানের বাস্তবতায় দায়ী পুরুষকে কিছুটা বা একধরণের দায়মুক্তি দেয়া আছে কারণ জারজ সন্তান কেবলমাত্র মা এর ওয়ারিশ, পিতার নয়। নির্ণয়ের পথ না থাকায় হয়তো সে নিয়ম, কিন্তু হালের ডিএনএ আইনে সে ধাঁধা সমাধানের পথ খোঁজা যায়। ইসলাম এর আদি আমলে চেহারা বিশেষজ্ঞ এর মতামত গ্রহনযোগ্য ছিলো। ইসলামের আদি আমলে ফরায়েজে প্রাপ্যতার জন্য বৈধ বিয়ে বাধ্যতাবধকতার সাথে সাথে কেবল বৈধ বিবাহের সবগুলো উপকরণ নেই এমন ক্ষেত্রেও উত্তরাধীকার প্রদান করা হয়েছিলো, পরে তা ইসলামী আইন বিশারদগণ সম্পূর্ণ রদ রহিত করেন।
সম্পদে অধিকার একটি গুরুত্ববহ প্রতিক্রিয়া তৈরী করে। ইসলামী আইনে কখনোই ন্যায়বিচারকে লংঘন করার চিন্তা কল্পনাও করা যায় না। তাই ইসলামী আইনের ন্যায় বিধানগুলোর আলোকেই জারজ সন্তানের ক্ষেত্রে দায়ী নারীর পাশাপাশি দায়ী পুরুষের সম্পত্তিকেও কীভাবে সংযুক্ত করা যায় তা অন্তত খোঁজা যেতে পারে।
মৃত্যুর পরে জন্ম নেয়া সন্তান: সাক্ষ্য আইনের ১১২ ধারা মতে স্বামীর মৃত্যুর ২৮০ দিনের মধ্যে জন্ম নেয়া সন্তান বিবাহকারী পুরুষের সন্তান হিসেবে সে পুরুষের ওয়ারিশ হয়। তবে হানাফি আইনে স্বামীর মৃত্যুর ২ বছরের মধ্যে সন্তান হলেও সে সন্তানকে মৃত পুরুষের বৈধ সন্তান ধরে সে পুরুষের ওয়ারিশ গণ্য করা হয়। উভয় আইনে অবশ্য আরও কিছু শর্ত আরোপ আছে। যথা, সে নারী আর কোনো পুরুষের সাথে শারিরীক সম্পর্ক করতে পারবে না সে নির্ধরিত সময়ের মধ্যে।
তুলনামূলক আলোচনায় দেখা যায়, স্বামীর মৃত্যুর ২৪১তম দিনে সন্তান হলে তা হানাফি আইনে বৈধ কিন্তু সাক্ষ্য আইনে অবৈধ। বৈধতার সিদ্ধান্ত নেয়া হলে এবং একটি সন্তান বৈধ ঘোষণা হওয়া মাত্র সে তার বাবার ওয়ারিশ হয় এবং বাবাও তার ওয়ারিশ হয়।
গর্ভের সন্তানের এবং প্রসবকালীন মৃত সন্তানের উত্তরাধীকার:
এ সংক্রান্ত আলোচনা মোল্লার বইয়ের আলোচ্য অধ্যায়ে তথা ফরায়েজ সংক্রান্ত অধ্যায়ে পাওয়া যায়না।তবে ফরায়েজের আলোচনা করতে মোল্লার বইয়ে যে বইয়ের সহায়তা নেয়া হয়েছে, ১৭৯২ সালে স্যার উইলিয়াম জোন্স এর অনুবাদ আল সিরাজিয়াহ অর দি মোহামেডান ল অব ইনহেরিটেন্স বইয়ে এ সংক্রান্ত আলাপ তোলা হয়েছে। সে আলাপের সারসংক্ষেপ হলো:
(১) মৃত ব্যক্তি মারা যাওয়ার সময় যদি তার স্ত্রী গর্ভবতী থাকে এবং বৈধ সন্তানের মা হিসেবে গ্রহণ করা হয়, তবে মৃত ব্যাক্তির সম্পদ ভাগের সময় গর্ভস্থ শিশুর জন্য বরাদ্দ রেখে বাকী সম্পদ ভাগ করতে হবে। বরাদ্দ কতটুকু রাখা হবে তা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত আছে।ইমাম আবু হানিফার মত হলো হয় ৪ ছেলে প্রাপ্য নয় ৪ মেয়ের প্রাপ্যতা হিসেব করে যেটি বেশি সেটি বরাদ্দ রেখে বাকী অংশ ভাগ হবে।
(২) যদি গর্ভস্ত সন্তান জীবিত অবস্থায় জন্ম নেয়, তবে তার প্রাপ্য তাকে দিয়ে বাকীটুকু পুনরায় ভাগ করতে হবে।
(৩) প্রসবকালীন সময়ে কোনো শিশু মৃত্যুবরণ করলে, শিশুটিকে জীবিত ধরা হবে না-কি মৃত তা নিয়ে ১৭৯২ সালের বইয়ে যা বলা রয়েছে তা হলো:
(ক) যদি প্রসবের পর বাচ্চা কেঁদে ওঠে, হাঁছি দেয়, হাত বা পা নাড়ায়, হেসে ওঠে তবে সে বাচ্চা জীবিত বাচ্চা হিসেবে জন্ম নিয়েছে ধরতে হবে।প্রসবের পরপরই জীবনের চিহ্ন দেখিয়ে বাচ্চাটি মারা গেলেও তার উত্তরাধিকার কার্যকর হবে।
(খ) যদি বাচ্চার সামান্য অংশ বের হওয়ার পর বাচ্চা মারা যায় তবে সে বাচ্চার জন্য উত্তরাধিকার বলবৎ হয়না।
(গ) যদি বাচ্চার মাথা হতে শুরু করে বুক পর্যন্ত বের হওয়ার পর বাচ্চা মারা যায় তবে বাচ্চা জীবিত বলে গণ্য হবে এবং বাচ্চার জন্য উত্তরাধিকার বলবৎ হয়।
(ঘ) যদি বাচ্চার পা হতে শুরু করে নাভী পর্যন্ত বের হওয়ার পর বাচ্চা মারা যায় তবে বাচ্চা জীবিত বলে গণ্য হবে এবং বাচ্চার জন্য উত্তরাধিকার বলবৎ হয়।
ছোটে একটি উদাহরণ আলাপ করা যাক: মৃত ব্যক্তির ২ মেয়ে, স্ত্রী আর আপন সহোদর ভাই রয়েছে, সম্পত্তি ১০০ টাকার। ছক-৩ মোতাবেক ২ মেয়ে ৬৬.৬৭ টাকা (প্রত্যেক মেয়ে ৩৩.৩৩ টাকা করে) আর স্ত্রী ১২.৫০ টাকা আর বাকী ১২.৫০ টাকা ভাগশেষভোগী হিসেবে আপন সহোদর ভাই পেয়ে যাবার কথা। কিন্তু গর্ভস্ত শিশুটি যদি ছেলে শিশু হয় আর সে যদি জীবিত হিসেবে জন্ম নিয়েছে মর্মে ঘোষিত হয় তবে সেই আপন সহোদর ভাই কিছুই পাবেনা। সেই ছেলে শিশুটি জীবিত ঘোষণা হওয়া মাত্র সে নিজে ৪৩.৭৫ টাকা পেয়ে যায় মৃত ব্যক্তির স্ত্রীর ১২.৫ টাকা ভাগ দেয়ার পর ভাগশেষভোগী ছেলে হিসেবে আর ভাগশেষভোগী মেয়ে ২টি প্রত্যেকে ২১.৮৭৫ টাকা করে পায়।এরপর শিশুটি স্বল্পসময়ের মধ্যে মারা গেলেও তার মা শিশুর সম্পদ হতে ওয়ারিশ হতে পারার পর বাকী সম্পদ ভাগশেষভাগী হিসেবে তার বোন তথা সেই ২ মেয়ে পেয়ে যায়। অর্থাৎ মূল মৃতব্যক্তির আপন সহোদর ভাইয়েরা মৃত ব্যক্তির সম্পত্তিতে সম্পূর্ণরূপে উত্তরাধিকারহীন হয়ে যায়।
হত্যাকারীর ফরায়েজ অবস্থান: একজন হত্যাকারী তার দ্বারা হত্যার শিকার ব্যক্তি হতে স্বাভাবিকভাবে মুসলিম ফরায়েজে সম্পত্তি পাওনা হলেও হত্যাকান্ড সংঘটনের কারণে তা আর পায় না। প্রণিধানযোগ্য বিষয় হচ্ছে কেবল ইচ্ছাকৃত হত্যাকান্ডই নয় এমনকি ভুলক্রমে বা অবহেলা জনিত কারণে বা দূর্ঘটনাজনিত কারণেও যদি হত্যাকান্ড সংঘটিত হয় তবে নিহত ব্যক্তির সম্পদ বন্টনে হত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তির জন্য একই বিধান প্রযোজ্য। যেমন বহুল আলোচিত ঐশি রহমান যেহেতু নিজে তার বাবা ও মা এর হত্যাকান্ডে জড়িত ছিলো তাই ইসলামী ফরায়েজ মতে সে তার বাবা ও মা থেকে কিছু পাবে না।
তৃতীয় লিঙ্গের উত্তরাধিকার: তৃতীয় লিঙ্গের উত্তরাধিকার নিয়ে ইসলামের বিধান হলো-
(১) আলোচ্য ৩য় লিঙ্গের ব্যক্তি যদি পুরুষ প্রবণ হন তবে তিনি একছেলের সমান অংশ পাবেন।
(২) আলোচ্য ৩য় লিঙ্গের ব্যক্তি যদি নারী প্রবণ হন তবে তিনি একমেয়ের সমান অংশ পাবেন।
একজন ৩য় লিঙ্গের ব্যক্তি পুরুষ প্রবণ না-কি নারী প্রবণ তা যাচাইয়ে কিছু পন্থা বাতলানো হয়েছে।এ প্রসঙ্গে জানার জন্য আগ্রহীগণ এই লিংকের Simplify inheritance rights in Islamic law Hermaphrodite right to inheritance and Married (khuntha) online reading শিরোনামের লেখাটি পড়ে দেখতে পারেন। (লিংক: http://www.ajbasweb.com/old/ajbas/2016/Special%20IPN%20Feb/104-110.pdf)
তৃতীয় লিঙ্গের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আলোচনাও মোল্লার বইয়ের আলোচ্য অধ্যায়ে তথা ফরায়েজ সংক্রান্ত অধ্যায়ে পাওয়া যায়না।তবে ফরায়েজের আলোচনা করতে মোল্লার বইয়ে যে বইয়ের সহায়তা নেয়া হয়েছে, ১৭৯২ সালে স্যার উইলিয়াম জোন্স এর অনুবাদ সেই আল সিরাজিয়াহ অর দি মোহামেডান ল অব ইনহেরিটেন্স বইয়ে এ সংক্রান্ত আলাপও তোলা হয়েছে। সে আলাপের সারসংক্ষেপ হলো:
যখন একজন ৩য় লিঙ্গের ব্যক্তি নারী প্রবণ নাকি পুরুষ প্রবণ তা নির্ণয় করা দুরূহ হয়ে যায় তখন তাকে একছেলে ও ১ মেয়ের মোট অংশের অর্ধেক অংশ প্রদান করতে হবে। উদাহণ স্বরূপ, মৃতব্যক্তির একছেলে সন্তান যদি ১০ টাকা পায় আর মেয়ে সন্তান যদি ৫ টাকা পায় তবে মৃতব্যক্তির ৩য় লিঙ্গের সন্তান (১০+৫)= ১৫ টাকার অর্ধেক ৭.৫ টাকা পাবে।
[বিশেষ দ্রষ্টব্য: তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়া আল্লাহর সৃষ্টি। কিন্তু অসাবধান অসংবেদনশীল আচরণে আমরা হিজড়া শব্দটিকে গালি বানিয়ে ফেলেছি। খোদার সৃষ্টিকে অবমানা খোদাকে অবমাননারই আরেকটা রূপমাত্র।তাই কোনো প্রকার অসন্মান না থাকা সত্ত্বেও খোদার ক্রোধ হতে বাঁচার সাবধানতায় এই আলোচনায় হিজড়া শব্দটির বদলে তৃতীয় লিঙ্গ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।]
অন্য ধর্ম হতে ইসলামে ধর্মান্তরিত ব্যক্তির সম্পত্তির ফরায়েজ: অন্য কোনো ধর্ম হতে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত ব্যক্তির মারা গেলে তাঁর সকল সম্পত্তি মুসলিম ফরায়েজ বিধান মোতাবেক বিলি বন্টন হবে। উদাহরণ স্বরূপ, একজন বিবাহিত হিন্দু ধর্মাবলম্বী ব্যক্তি তাঁর হিন্দু স্ত্রী, সন্তানকে রেখে ইসলাম গ্রহণ করে মুসলিম হলেন এবং আরেকজন মুসলিম নারীকে বিয়ে করলেন, মুসলিম সন্তান এর জনক হলেন। তাঁর মৃত্যুতে মুসলিম ফরায়েজ মতে তাঁর মুসলিম ওয়ারিশগণই তার বৈধ ওয়ারিশ, হিন্দু স্ত্রী, সন্তানগণ তার ওয়ারিশ হবে না।
মুসলিম ফরায়েজে ইসলাম ধর্ম পরিবর্তনকারীর অবস্থান: ধর্ম পরিবর্তনকারীর মুসলিম ফরায়েজে কোনো ওয়ারিশ অধিকার নেই। ধর্ম পরিবর্তন করার সাথে সাথে ওয়ারিশ অধিকার চলে যায়। মুসলিম বা পুনরায় মুসলিম না হওয়া পর্যন্ত কোনো ব্যক্তি মুসলিম ফরায়েজে সম্পত্তি পাবে না। মুসলিম আইনের আলোচনায় আমরা ৩ শ্রেণীর ধর্ম বিভাগ পাই। যথা:
(১) ইসলাম
(২) কিতাবী ধর্ম অর্থাৎ ইসায়ী ধর্ম ও ইহুদী ধর্ম
(৩) মুশরিক তথা অগ্নি পূজক ও মূর্তি পূজকের ধর্ম
বৈশিষ্টগত কারণে প্রকৃতি পূজারীগণ ৩য় শ্রেণীতে পড়েন। প্রতিক্রিয়াগত কারণে নাস্তিকগণও ৩য় শ্রেণীতে পড়েন।
ইসলাম ধর্মে মুসলিম পুরুষদের জন্য শুধু এবং কেবলমাত্র কিতাবী ধর্মীয় নারীদের বিয়ে করতে পারবে- সে বিয়ে হবে অনিয়মিত- স্ত্রী মুসলিম হলেই কেবল তা সম্পূর্ণ বৈধ হবে।
এই বিষয়ে মোল্লা এবং সিরাজির মধ্যে পরস্পর বিপরীত মতামতের উপস্থিতি দেখা যায়।
সংক্ষেপে তার চিত্রায়ন হলো মোল্লা মনে করেন ধর্ম ত্যাগ করলেই মুসলিম ফরায়েজ হতে বঞ্চিত হয়ে না কিন্তু সিরাজি মনে করেন ধর্ম ত্যাগ করার সাথে সাথেই মুসলিম ফরায়েজ অকার্যক হয়ে যায়। এ সংক্রান্ত কোনো স্পষ্ট সিদ্ধান্ত চোখে পড়ে না।
সিরাজির বইয়ের আলোকে কিতাবী ধর্মের বা মুশরিকী ধর্মের প্রেক্ষিতে মুসলিম ফরায়েজ: মৃতব্যক্তির হতে সম্পত্তি বন্টনে ধর্মান্তরিত কিতাবী বা মুশরিক ব্যক্তির অবস্থান-
(১) কোনো মুসলমান কিতাবী বা মুশরিক হয়ে গেলে, ধর্মান্তরিত কিতাবী বা মুশরিক ব্যাক্তি কোনো মুসলিম হতেমুসলিম ফরায়েজ মোতাবেক কোনো সম্পত্তি পাবে না। এমনকী ধর্মান্তরিত ব্যাক্তি অপর ধর্মান্তরিত ব্যাক্তি হতেও মুসলিম ফরায়েজ মোতাবেক সম্পত্তি পাবে না।
(২) কোনো মুসলিম হতে ধর্মান্তরিত কিতাবী বা মুশরিক ব্যাক্তি যদি পুণরায় ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে এরপর আরেকজন মুসলিমের ওয়ারিশ হয় তবে সে মুসলিম ফরায়েজ মোতাবেক এমনভাবেই সম্পদ পাবে ধরে নেয়া যেনো সে কোনো দিন ই ধর্মান্তরিত কিতাবী বা মুশরিক হয়নি।
(৩) মুসলিম হতে ধর্মান্তরিত কিতাবী ব্যাক্তি যদি পুণরায় ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে সে প্রেক্ষাপটে স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রে বিধান আবার ভিন্ন। কারণ মুসলিম দম্পত্তির কেউ ১জন ধর্মত্যাগ করার সাথে সাথে তালাক কার্যকর হয়। ফলে পূণরায় মুসলিম হলেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে তালাক রদ হয় না। আবার এখানে ১টি বিতর্ক মুসলিম দম্পতির মধ্যে স্ত্রী যদি ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে কিতাবী ধর্ম নেয় তাহলে কি হবে। মুসলিম পুরুষের জন্য যেহেতু কিতাবী নারী কে বিয়ে করা বৈধ সে প্রেক্ষিতে উদার ব্যাখ্যা এটাই যে মুসলিম দম্প্তির স্ত্রী কিতাবী ধর্ম গ্রহন করলেও মুসলিম ফরায়েজ হতে বঞ্চিত হবে না।
(৪) মৃত ব্যাক্তির মৃত্যুর আগে ধর্মান্তরিত কিতাবী হতে আবার মুসলমান হতে হবে। মৃত ব্যাক্তির মৃত্যুর পর আবার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও সে আর মৃত ব্যাক্তি হতে ওয়ারিশ সুত্রে কিছু পাবে না।
(৬) ইসলাম ধর্ম পুণরায় গ্রহনের আগেই ছেলে বা মেয়ে মৃত্যুবরণ করলেও ইসলাম ধর্ম পূণঃরায় গ্রহণ করে মৃত্যুবরণকারী ব্যাক্তির সম্পদের ক্ষেত্রে ১৯৬১ এর অধ্যাদেশ মোতাবেক প্রতিনিধিত্ব নীতি প্রযোজ্য হবে। তবে পূর্বেই মৃত ছেলে বা মেয়ের অবশ্যই মুসলিম হয়ে র্মত্যুবরণ করতে হবে।
মৃত ব্যক্তি মুসলিম হতে ধর্মান্তরিত হয়ে মৃত্যুর সময় কিতাবী বা মুশরিক বিদ্যমান থাকলে তার সম্পদ এ ভাগ কি হবে তার ব্যাপারে সিরাজির বইতে নির্দিষ্ট উত্তর দেয়া হয়নি।
ধর্মান্তরিত ব্যক্তি যদি নারী হয় তাহলে স্পষ্টভাবেই বলা আছে তার যেসব ওয়ারিশ মুসলিম কেবল তারাই তাঁর সম্পত্তির ওয়ারিশ হবেন। কিন্তু ধর্মান্তরিত ব্যক্তি যদি পুরুষ হয় তবে-
(১) ইমাম আবু হানিফা মুসলিম হতে ধর্মান্তরিত মৃত ব্যক্তির সম্পত্তিকে ২ ভাগ করেন। তাঁর মতে সে ব্যক্তি যখন মুসলমান ছিলো সে সময়ে অর্জিত সম্পত্তি তার মুসলিম ওয়ারিশগণের কাছে যাবে। আর সে ব্যক্তির ধর্ম ত্যাগের পর অর্জিত সম্পত্তি রাষ্ট্রের কাছে যাবে।
(২) ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মোহাম্মদের মতে ধর্মান্তরিত ব্যক্তির সকল সম্পত্তি তার মুসলিম ওয়ারিশদের কাছে যাবে।
(৩) ইমাম শাফীর মতে ধর্মান্তরিত ব্যক্তির সকল সম্পদ রাষ্ট্রের কাছে চলে যাবে।
নাস্তিকদের জন্য মুসলিম ফরায়েজ: নাস্তিক হওয়াও একধরণের ধর্মত্যাগই, উপরের পটের সাথে ফারাক হচ্ছে উপরের প্রেক্ষায় আরেকটি ধর্ম গ্রহণ করা হয়। তাই সিরাজির বইয়ের আলোকে ধর্ম ত্যাগ এর বিধান নাস্তিকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
বিশেষ বিবাহ আইন ১৮৭২ এ বিবাহের ক্ষেত্রে ফরায়েজ: বিশেষ বিবাহ আইন ১৮৭২ এর আশ্রয় নেয়া মানে ইসলাম ধর্মত্যাগই। তাই সিরাজির বইয়ের আলোকে ধর্ম ত্যাগ এর বিধান বিশেষ বিবাহ আইন ১৮৭২ এর আশ্রয় নেয়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
সমকামীদের জন্য ফরায়েজ: ইসলামে সমকাম অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ। আয়াতের পর আয়াত, হাদিসের পর হাদিস দেয়া হয়েছে সমকামের বিরুদ্ধে। সূরা আলহাজ্জ, সূরা হুদ, সূরা আম্বিয়া, সূরা শোয়ারাহ, সূরা আন নামল, সূরা আনকাবুত, সূরা আসসাফফাত সূরাসমূহে সমকাম এর নিষিদ্ধতা সম্পর্কে উদাহরণ দিতে গিয়ে বারে বারে হজরত লুত (আঃ) পুরুষ উম্মতদের সমকামীতা চর্চার কথা বলা হয়েছে। যদিও নারীদের সমকামীতার কোনো আলাপ খুঁজে পাওয়া যায় না, কিন্তু কোরআনের সামগ্রীক পাঠে বোঝা যায় শিরকের অপরাধ আর ধর্ম না মানার অপরাধের পরই অপরাধ হিসেবে যে কোনো লিঙ্গের সমকামীতাকে স্থান দেয়া হয়েছে।
সমকামীদের মুসলিম ফরায়েজে অবস্থান সংক্রান্ত কোনো স্পষ্ট বিবরণ পাওয়া যায়নি। তবে এটুকু নিশ্চিত
(১) সমকামী বিবাহ ইসলামে স্বীকৃত নয় স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক ঘটিত কোনো প্রকার সম্পত্তির অধিকার কখনোই মুসলিম ফরায়েজ মোতাবেক তৈরী হয় না।
(২) যদি সমকামীতার মানে ধর্ম হতে সম্পূর্ণ বিচ্যুত হওয়া তবে তার অবস্থান ধর্মত্যাগী বা নাস্তিকের অবস্থান হিসেবে গণণা করা হবে।
হারিয়ে যাওয়া বা গুম: গুম হয়ে যাওয়া বা হারিয়ে যাওয়া নিখোঁজ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ফরায়েজ একটি অমীমাংসাযোগ্য বিষয়। তবে হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তির জন্য তার জন্ম তারিখ হতে কমসে কম ৯০ চন্দ্র বছর অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে।
সুন্নি হতে শিয়া মতান্তর: যদিও সুন্নিগণ শিয়াগণকে এবং শিয়াগণ সুন্নীগণকে অনায়াসে মুসলমান বলে স্বীকার করতে চান না, তবে শিয়া সুন্নী মত বদলে সুন্নী আইনে মুসলিম ফরায়েজে কোনো প্রতিক্রিয়া পড়ে এমন কোনো আলাপ পাওয়া যায়নি।
মুসলিম ফরায়েজের বিকল্প: এই বিবরণে দেখেছি, এমন কিছু পরিস্থিতি উদ্ভব হতে পারে যখন মুসলিম ফরায়েজ মোতাবেক কোনো সম্পদই উত্তরাধিকার সূত্রে কোনো ব্যক্তিকে প্রদান করা যায় না। সেক্ষেত্রে সাকশেসন আইন ১৯২৫ কে বিকল্প পথ হিসেবে নেবার চেষ্টা করা যেতে পারে।
কখন ফরায়েজ আইনে রাষ্ট্র সম্পদ পায়: যখন মৃত ব্যক্তির ভাগীদারশ্রেণীর স্বজন, অবশেষভোগী শ্রেণীর স্বজন এবং দুঃসম্পর্কের আত্মীয় শ্রেণীর স্বজন কাউকেই সম্পত্তি দেয়া যায় না সে পরিস্থিতিতে মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে যায়।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: সবশেষে বিষয়ের সংবেদনশীলতার কারণেই সাবধানতাস্বরূপ এই লেখা কেবলই বিবরণ এবং বিবরণ হিসেবেই লেকাটি গ্রহণের সানুনয় অনুরোধ করা গেলো। লেখকের বা প্রকাশকের কোনোমত এখানে দেয়া হয়নি। এই বিবরণে প্রকাশকের কোনো দায় নেই, সম্পূর্ণ দায় লেখকের।পূর্বে উল্লেখিত মোল্লা এবং সিরাজি এই ২ বই হতে লেখক এই বাংলা বিবরণ তৈরী করেছেন। বাংলা অনুবাদে কারও দ্বিমত থাকলে আলোচনা সাপেক্ষে ভুল ধরা পড়ার সাথে সাথে লেখক তা নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থনা পূর্বক সংশোধন করার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ। বিতর্কিত তথ্য বা বিতর্কিত মতের ক্ষেত্রে উপযুক্ত ব্যক্তি বা পুস্তকের দ্বারস্থ হবার সবিনয় অনুরোধ করা গেলো।
সাব্বির এ মুকীম: অ্যাডভোকেট; জজ কোর্ট, কুমিল্লা। ই-মেইল: samukim1@gmail.com
আরও পড়ুন: মুসলিম ফরায়েজে মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি বণ্টন পদ্ধতির আদ্যোপান্ত (পর্ব-১)
মুসলিম ফরায়েজে মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি বণ্টনে আউল ও রাদ নীতি (পর্ব-২)