ফাহমিদা আক্তার লাভলী: ‘গ্রেফতারি পরোয়ানা’ শব্দটা শুনলেই সাধারণত যে কেউ কিছুটা আঁতকে উঠেন। বর্তমান সময়ে এই শব্দের সাথে কমবেশি সবাই পরিচিত। বাস্তবে সবার অভিজ্ঞতা না হলেও এই শব্দ সম্পর্কে না জানা ব্যক্তির সংখ্যা খুবই নগণ্য। তবু আরও একবার স্মরণ করিয়ে দিতে বলি, সহজ কথায় যেকোন অপরাধী বা মামলার আসামীকে গ্রেফতারের জন্য আদালত কর্তৃক ইস্যুকৃত পরোয়ানার নামই ‘গ্রেফতারি পরোয়ানা’।
আমলযোগ্য অপরাধের বেলায় পুলিশ যে কাউকে পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেফতার করতে পারবে। কিন্তু আমল অযোগ্য অপরাধে কাউকে গ্রেফতার করতে হলে অবশ্যই আদালতের আদেশ ও অনুমতি লাগবে। সেক্ষেত্রে আদালত থেকে জারি করা গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রাপ্ত হয়ে তা হাতে নিয়েই পুলিশ সংশ্লিষ্ট আসামিকে গ্রেফতার করতে যায় এবং তা প্রদর্শন করেই তাকে গ্রেফতার করে।
তদন্ত কার্যক্রম চালাতেও পুলিশের আদালতের অনুমতি লাগে। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৫ ধারায় আমল অযোগ্য অপরাধের বিষয়ে পুলিশের করণীয় সম্পর্কে বলা হয়েছে। সাম্প্রতিককালে আমাদের প্রায় দৈনন্দিন জীবনের আলোচনার বিষয় এই গ্রেফতারি পরোয়ানা। সমসাময়িক রাজনীতির মাঠেও রয়েছে তার ব্যাপক পরিচিতি ও আতংক ।
আইনানুযায়ী কোন ব্যক্তিকে আদালতে উপস্থিত করার লক্ষে এ আদালত কর্তৃক জারীকৃত লিখিত আদেশ, যা প্রিসাইডিং অফিসার কর্তৃক বা ম্যাজিস্ট্রেট বেঞ্চের ক্ষেত্রে বেঞ্চের যেকোন সদস্য কর্তৃক সইকৃত এবং আদালতের সীলমোহরকৃত যে আদেশনামা দেওয়া হয় তাকে গ্রেফতারি পরোয়ানা বলে।
ফৌজদারী কার্যবিধি ১৮৯৮ এর ধারা ৭৫(১) অনুযায়ী, গ্রেফতারি পরোয়ানা অবশ্যই আদালত কর্তৃক লিখিত এবং প্রিসাইডিং অফিসার বা ম্যাজিস্ট্রেট বেঞ্চের ক্ষেত্রে বেঞ্চের যেকোন সদস্য কর্তৃক স্বাক্ষরিত ও আদালতের সীলমোহরযুক্ত হতে হবে।
ফৌজদারী কার্যবিধির ধারা ৭৫(২) অনুযায়ী, প্রতিটি গ্রেফতারি পরোয়ানা ততক্ষণ পর্যন্ত বলবৎ থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত প্রদানকারী আদালত কর্তৃক উক্ত পরোয়ানা বাতিল বা অকার্যকর করা না হয়।
গ্রেফতারী পরোয়ানা পুলিশের হাতে পৌছার পর পুলিশ আসামীকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করে। আর গ্রেফতার করতে না পারলেও আদালত কর্তৃক উক্ত পরোয়ানা বাতিল বা অকার্যকর না করা পর্যন্ত উক্ত পরোয়ানা জারী থাকে। যদি আসামী আত্মসমর্পণ পূর্বক জামিন লাভ না করে তবে একটা সময় তার অবর্তমানেই বিচার কার্য শুরু হয় । আর যদি সে দোষী সাব্যস্থ হয় তবে তার সাজা পরোয়ানা ইস্যু হয়। তাকে যেদিন গ্রেফতার করা হবে সেদিন থেকেই তার সাজা শুরু হবে।
আর গ্রেফতার করতে না পারলে উক্ত পরোয়ানা জারি থেকে যায়। তবে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়ার পর যদি কেউ আত্মসমর্পণ পূর্বক জামিন লাভ করে থাকে তবে আদালত থেকে রিকল গ্রহণ করে তা তার থানায় জমা দিতে হয়, কেননা তার গ্রেফতারী পরোয়ানা গ্রেফতার না হওয়া পর্যন্ত বলবৎ থাকে। সেক্ষেত্রে আত্মসমর্পণ পূর্বক জামিন লাভ করার পর রিকল জমা দিলে তাকে আর গ্রেফতারী পরোয়ানার জন্য পুলিশি হয়রানীর শিকার হতে হয় না। তবে পুলিশ কর্তৃক উক্ত পরোয়ানা মূলে গ্রেফতার হয়ে কারান্তরীণ হলে বা আদালত থেকে হাজতি আসামী বা গ্রেফতারকৃত আসামী হিসেবে জামিন লাভ করলে তার আর রিকলের প্রয়োজন হয় না ।
ফৌজদারী কার্যবিধির ধারা ৭৭ অনুযায়ী, গ্রেফতারী পরোয়ানা এক বা একাধিক পুলিশ অফিসারের প্রতি নির্দেশিত হবে, সকলে যৌথভাবে, এককভাবে বা একাধিক জন তা কার্যকর করতে পারবে।
ফৌজদারী কার্যবিধির ৭৯ ধারা অনুযায়ী যে নির্দেশিত সে ব্যতীত তার দ্বারা হাওলাকৃত অন্য অফিসার দ্বারাও কার্যকর করা যাবে।
গ্রেফতারি পরোয়ানা বাংলাদেশের যে কোনস্থানে কার্যকর করা যাবে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু ভুয়া গ্রেফতারী পরোয়ানা দ্বারা হয়রানী, অপহরণ ইত্যাদি বিষয়ে অভিযোগ শোনা যায়। ভুয়া গ্রেফতারি পরোয়ানা রোধে ব্যাবস্থা গ্রহণের জন্য সাত দফা নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট।
বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান সমন্বয়ে গঠিত একটি হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ এ নির্দেশনা দেন। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কৃষি বিভাগের প্রোগ্রাম অফিসার মো. আওলাদ হোসেনের ভুয়া পরোয়ানা নিয়ে রিটের প্রেক্ষিতে আদালত এ আদেশ দেন।
ভুয়া গ্রেফতারি পরোয়ানা রোধে হাইকোর্টের নির্দেশনাগুলো হচ্ছে:
১) গ্রেফতারি পরোয়ানা ইস্যুর সময় গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রস্তুতকারী ব্যক্তিকে ফৌজদারী কার্যবিধির ধারা ৭৫ এর বিধান মতে নির্ধারিত ফরমে উল্লেখিত চাহিদা অনুযায়ী সঠিক ও সুস্পষ্টভাবে তথ্যাদী পূরণ করতে হবে। যেমন:
ক) যে ব্যক্তি বা যে সকল ব্যক্তি পরোওয়ানা কার্যকর করবেন, তার বা তাদের নাম এবং পদবী ও ঠিকানা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে।
খ) যার প্রতি পরোয়ানা ইস্যু করা হচ্ছে তার নাম ও ঠিকানা মামলার নম্বর ও সুনির্দিষ্ট ধারাসহ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে।
গ) সংশ্লিষ্ট জজ বা ম্যাজিস্ট্রেটের স্বাক্ষরের নিচে নাম ও পদবীর সীলসহ সংশ্লিষ্ট আদালতের সুস্পষ্ট সীল ব্যবহার করতে হবে।
ঘ) গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রস্তুতকারী ব্যক্তির (অফিস স্টাফ) নাম, পদবী ও মোবাইল নাম্বারসহ সীল ও তার সংক্ষিপ্ত স্বাক্ষর ব্যবহার করতে হবে, যাতে পরোয়ানা কার্যকরকারী ব্যক্তি পরোয়ানার সঠিকতা সম্পর্কে কোনো সন্দেহের উদ্বেগ হলে পরোয়ানা প্রস্তুতকারি সাথে সরাসরি যোগাযোগ করে সঠিকতা নিশ্চিত হতে পারেন।
২) গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রস্তুত হলে স্থানীয় অধিক্ষেত্র কার্যকর করার জন্য সংশ্লিষ্ট পিয়নবহিতে এন্ট্রি করে বার্তা বাহকের মাধ্যমে তা পুলিশ সুপারের কার্যালয় কিংবা সংশ্লিষ্ট থানায় প্রেরণ করতে হবে। পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের বা থানার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কর্তৃক উক্ত পিয়নবহিতে স্বাক্ষর করে তা বুঝে নিতে হবে। গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রেরণ ও কার্যকর করার জন্য পর্যায়ক্রমে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার কাজে লাগানো যেতে পারে।
৩) স্থানীয় অধিক্ষেত্রের বাইরের জেলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা কার্যকর করার ক্ষেত্রে পরোয়ানা ইস্যুকারি কর্তৃপক্ষ গ্রেফতারি পরোয়ানা সীলগালা করে এবং অফিসের সীলমোহরের ছাপ দিয়ে সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে প্রেরণ করবেন।
৪) সংশ্লিষ্ট পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকতা সীল মোহরকৃত খাম খুলে প্রাপ্ত গ্রেফতারি পরোয়ানা পরীক্ষা করে এর সঠিকতা নিশ্চিত হয়ে পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য ব্যবস্থা নিবেন। তবে কোনো গ্রেফতারি পরোয়ানার ক্ষেত্রে সন্দেহের উদ্বেগ হলে পরোয়ানা প্রস্তুতকারির মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে পরোয়ানার সঠিকতা নিশ্চিত হয়ে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করবেন।
৫) গ্রেফতারি পরোয়ানা গ্রহণকারী কর্মকর্তা পরোয়ানা কার্যকর করার আগে পুনরায় পরীক্ষা করে যদি কোনো সন্দেহ পোষণ করেন সেক্ষেত্রে পরোয়ানা প্রস্তুতকারির মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে সঠিকতা নিশ্চিত হয়ে পরোয়ানা কার্যকর করবেন।
৬) গ্রেফতারি পরোয়ানা অনুসারে গ্রেফতারের পর সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাকে উক্ত আসামি বা আসামিদের আইনে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেট বা জজ আদালতে পরোয়ানাসহ উপস্থাপন করতে হবে। এবং ম্যাজিস্ট্রেট বা জজ গ্রেফতারকৃত আসামি কিংবা আসামিদের জামিন প্রদান না করলে আদেশের কপিসহ হেফাজতি পরোয়ানামুলে জেল হাজতে প্রেরণসহ ক্ষেত্রমত সম্পূরক নথি তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেফতারি পরোয়ানা ইস্যুকারী আদালত বরাবর প্রেরণ করবেন।
৭) সংশ্লিষ্ট জেল সুপার কিংবা অন্য কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হেফাজতি পরোয়ানামুলে প্রাপ্ত আসামী বা আসামিদের গ্রেফতারি পরোয়ানা ইস্যুকারী আদালতে অবিলম্বে এই মর্মে অবহিত করবেন যে, কোন থানার কোন মামলার সূত্রে বা কোন আদালতের কোন মামলায় বর্ণিত আসামিদের পরোয়ানামুলে জেল হাজতে প্রেরন করা হয়েছে। পরবর্তীতে আসামিদের নতুন কোন গ্রেফতারি পরোয়ানা পেলে জেল সুপার পরবর্তী গ্রেফতারী পরোয়ানার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আদালত হতে নিশ্চিত হয়ে পরোয়ানা কার্যকর করবেন।
হাইকোর্টের এই আদেশ বাস্তবায়নে জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন নিরাপত্তা বিভাগের সচিব, সুরক্ষা ও সেবা বিভাগের সচিব, আইন সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, মহা-কারা পরিদর্শক ও সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে বলা হয়েছে। সেই সাথে আদেশটি প্রত্যেক দায়রা জজ ও মেট্রোপলিটন দায়রা জজসহ দেশের সকল ট্রাইব্যুনাল, বিশেষ জজ আদালতের বিচারক, চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটকে অবগত করতে বলা হয়েছে। ইতিপূর্বেও ভুয়া ওয়ারেন্ট কোথায় থেকে ইস্যূ হয় এবং কারা ইস্যু করে তা খুঁজে করতে সিআইডিকে নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট।
তবে আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা ইস্যু করলেও অনেক সময় শোনা যায় তা আদালতের নির্দিস্ট দপ্তর থেকে সংশ্লিষ্ট থানাতে গিয়ে পৌছায়না। কিছু অসাধু ব্যক্তির দ্বারাই এই কার্য ঘটে। অর্থের বিনিময়ে বিলম্বিত করা বা তা ঠিকমতো প্রেরণ না করায় অনেক সময় অনেক অপরাধী অধরাই থেকে যায়।গ্রেফতারি পরোয়ানার ব্যবহার হোক সঠিক ও যথার্থ। আইনের শাসন হোন সুনিশ্চিত।
ফাহমিদা আক্তার লাভলী: আইনজীবী; জেলা আইনজীবী সমিতি, সিলেট।