সিরাজ প্রামাণিক: এক বুড়ি মা গল্প বলার আগেই তিনি বাচ্চাদের বললেন, সব সময় এক লাইন শেষ হলেই বলবে “তারপর”। বুড়ি বলতে শুরু করলেন। এক জেলে বড় একটা জাল নিয়া মাছ ধরছিল। বাচ্চারা বলল, তারপর? বুড়ি বললো জালের ভিতর অনেক মাছ পরছে। বাচ্চারা এভাবে বলতে লাগলো তারপর? বুড়ি বললো একটা মাছ ছুট করে জাল থেকে পালিয়ে গেল। তারপর? আরেকটি মাছ পালালো, তারপর? আরেকটি মাছ পালালো, এভাবে বাচ্চারা অনেকবার বলতে থাকলো, তারপর? বুড়ি একই কথা বলে যাচ্ছে, আরেকটি মাছ পালালো। বাচ্চারা বলল কত মাছ? বুড়ি বলল অগনিত!
পাঠক! আপনারা নিশ্চয়ই হবু চন্দ্র রাজার নাম শুনেছেন। রাজার চরণ যখন ধুলোয় লেপ্টে যাচ্ছিল তখন তা থেকে পরিত্রাণের উপায় খোঁজা হচ্ছিল। হবু চন্দ্র মন্ত্রীর পরামর্শে একবার ঝাঁটা দিয়ে ধুলো দূর করার চেষ্টা করে রাজ্যকে ধুলোময় করা হয়, আরেকবার পানি দিয়ে ধুলো দূর করতে গিয়ে রাজ্যকে কাঁদাতে ভরপুর করা হয়। তখন এক মুচি এসে রাজাকে পরামর্শ দিল, রাজা মশাই, চামড়া দিয়ে আপনার দুটি চরণ ঢাকুন তবে, ধরণীকে আর ঢাকিবার নাহি হবে। রাজা রাজি হওয়ায় মুচি তাঁর পা দুটোকে চামড়া দিয়ে মুড়িয়ে দিল, মানে তাঁকে জুতো পরিয়ে দিল। রাজার পায়ে আর ধুলো লাগল না। বাঁচিল হবু, রক্ষা পাইল ধরা। হবু রাজারা করোনা থেকে বাঁচতে রীতিরকম পা দুটো চামড়া দিয়ে মুড়িয়ে রেখেছেন। কিন্তু সাধারণ প্রজাদের খবর কি রাখুন?
সূরা আল আছরকে নিয়ে তাফসিরকারকদের আগ্রহ একটুও কমেনি। গত ১৪শ’ বছর ধরে এই ছোট সূরাটি কত লক্ষ-কোটিবার পড়া হয়েছে কিংবা কত আলেম যে এর ব্যাখ্যা করেছেন তা অন্তহীন জগতের মালিক আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। হুজুরে পাক (স.)-এর জমানায় এক সাহাবী অন্য সাহাবীর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হলে বিদায়ের সময় সূরা আল আছর শুনিয়ে দিতেন। এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য এবং গুরুত্ব অনুধাবন করলে ভয়ে মুমিনের শরীরে কাঁপন ধরে যায়। কি সাংঘাতিক কথা- “দ্বীন দুনিয়ার মালিক স্বয়ং সময়ের কসম করছেন এবং তার বান্দাদের হুশিয়ার করে বলছেন, সকল মানুষের জীবন হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত। কেবল তারাই রক্ষা পাবে যারা ইমানদার, সৎ কাজ করে। হক কথা বলে এবং বিপদে সবর অবলম্বন করে।”
হযরত আদম (আ.) থেকে আজ অবধি প্রায় ৯০০০ বছর হতে চললো। এর মধ্যে মানুষের সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করার ইতিহাস প্রায় ৮০০০ বছর। রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ইতিহাসও রয়েছে প্রায় ৭০০০ বছরের। কত রাজা এলো এবং কত রাজা যে গেলো তার নিরন্তর হিসাব কেবল আল্লাহই জানেন। আমাদের সীমিত জ্ঞানে অবশ্য কিছু খন্ডিত ইতিহাসের ইতিবৃত্ত রয়েছে। আমরা যুগ-যুগান্তরের অনেক সফল ও অনেক ব্যর্থ রাজা-বাদশাহদের নাম জানি। যারাই সফল হয়েছেন তারা সবাই হক কথা এবং সবরের ব্যাপারে অতিশয় যত্নশীল ছিলেন। অন্যদিকে এ দুটি মহৎ মানবীয় গুণাবলীকে অস্বীকার করে অনেক প্রতিভাবান শাসক বা ব্যক্তি ধ্বংসের অতল গহ্বরে তলিয়ে গেছেন।
এবার আমি হক কথা বলার একটি বিনম্র উদাহরণ পেশ করে লেখাটি শেষ করব। ভারতে তখন খিলজী বংশের শাসন চলছে। রাজা আলাউদ্দিন খিলজী সিংহাসনে। নিষ্ঠুরতার জন্য তিনি কুখ্যাত ছিলেন। তার সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল অজ্ঞানতা। তিনি একদিকে ছিলেন অক্ষরজ্ঞানহীন। আবার অন্যদিকে জেদী। ফলে বিভিন্ন আমীর-ওমরা, উজির-নাজির সবাই রাজাকে ভয় করতেন যমের মতো। রাজার সামনে দাঁড়িয়ে তারা থরথর করে কাঁপতেন। রাষ্ট্রে তখন শরীয়া আইন প্রচলিত। তাকে সার্বিক সহযোগিতার জন্য প্রধান বিচারপতি বা কাজী উল কুম্মাত সর্বদা দরবারে উপস্থিত থাকতেন এবং প্রয়োজনীয় আইনের ব্যাখ্যা দিতেন।
একদিন একটি বিব্রতকর বিষয় নিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মামলার শুনানি চলছিল। রাজা স্পষ্টতই অন্যায়ভাবে একজনের পক্ষ অবলম্বন করতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু এর জন্যে দরকার ছিল প্রধান কাজীর নিকট থেকে প্রয়োজনীয় কোরআনের আইনি ব্যাখ্যা। রাজা কাজীকে জিজ্ঞাসা করলেন এবং মনে মনে আশা করলেন যে, কাজী রাজার পছন্দমতো আইনের ব্যাখ্যা দেবেন।
কাজী দাঁড়িয়ে রাজাকে কুর্নিশ করলেন এবং বিমর্ষ বদনে বললেন, ‘হুজুর আমার মনে হচ্ছে মৃত্যু আমার গর্দানের ওপর ভর করেছে। নচেৎ মহান রাজা আমাকে এমন প্রশ্ন কেন করবেন।’ কাজীর এই উত্তরে রাজা হেসে দিলেন এবং বললেন, কেন আপনার মৃত্যুর কথা মনে হলো। কাজীর উত্তর, ‘আমি যদি সত্য বলি তবে হুজুর রাগ করবেন। অন্যদিকে মিথ্যা বললে আল্লাহ রাগ করবেন। আমি হুজুরের এজাজত চাচ্ছি-কোনটি আমার করণীয়।’ বিচক্ষণ রাজা সহাস্য বদনে কাজীকে সত্য কথাটি বলার নির্দেশ দিলেন।
সিরাজ প্রামাণিক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন বিশ্লেষক, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email: seraj.pramanik@gmail.com