বাংলাদেশের সামাজিক ও বাস্তব অবস্থার অজুহাত দেখিয়ে নারীরা নিকাহ রেজিস্ট্রার বা বিয়ের কাজি হতে পারবেন না মর্মে হাইকোর্টের যে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পেয়েছে, তা নারীর প্রতি অবমাননাকর এবং সংবিধান পরিপন্থী বলে মনে করে নারী সংহতি। মধ্যযুগের অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজের মতো পশ্চাদপদ এই নির্দেশনার নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়েছে সংগঠনটি।
নারী সংহতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তাসলিমা আখতার ও সাধারণ সম্পাদক অপরাজিতা চন্দ এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, এই কথা বলাই বাহুল্য যে, মহামান্য হাইকোর্টের এ নির্দেশনা সংবিধান পরিপন্থী এবং একই সঙ্গে নারীর মানবাধিকারকে লঙ্ঘন।
তা ছাড়া নারীর প্রতিমাসের স্বাভাবিক শারীরবৃত্তিক প্রক্রিয়া মেন্সট্রুয়েশন বা মাসিককে ‘ফিজিক্যাল ডিসকোয়ালিফেশন’ বলা অত্যন্ত দুঃখজনক। প্রাকৃতিক এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নারীর সন্তান পুনরুৎপাদন এবং মানব প্রজাতি টিকে থাকে।
গত ১০ জানুয়ারি দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনের খবর শোনার পরে বুধবার (১৩ জানুয়ারি) নারী সংহতির কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক কানিজ ফাতেমার পাঠানো বার্তায় এমন কথা জানানো হয়।
এতে বলা হয়, এই প্রক্রিয়াকে নারীর ‘অযোগ্যতা’ বলা মানবজাতিকে হেয় করার সামিল। এটি পুরোপুরি অবৈজ্ঞানিক একটি নির্দেশনা। তা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন দেশের সংবিধানের সঙ্গেও আদালতের রায়টি সাংঘর্ষিক।
তারা বলেন, দেশের সংবিধানের ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান। অনুচ্ছেদ ২৯ (১) অনুযায়ী, প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকবে। (২) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের অযোগ্য হবেন না কিংবা সেক্ষেত্রে তার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাবে না।
সংবিধান স্বীকৃত এসব অধিকারের কোনোটিই মহামান্য আদালতের নির্দেশনায় রক্ষা পায়নি। তা ছাড়া, রায়ের পর্যবেক্ষণে মুসলিম বিবাহকে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং দেশে বেশির ভাগ বিয়ের অনুষ্ঠান হয় মসজিদে- বলাও পর্যবেক্ষণ ঠিক নয় বলে আমরা মনে করি। কারণ মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী নারী-পুরুষের বিয়ে একটি সামাজিক চুক্তি এবং এ চুক্তি মসজিদেও অনুষ্ঠিত হয় না।
নারী সংহতির নেতারা বলেন, দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছেন একজন নারী। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নারীরা কাজ করছেন। দেশের সরকারি-বেসরকারি যেকোনো কর্মস্থলে নারীরা শীর্ষপদে থেকে দায়িত্ব পালন করছেন।
উন্নত, সভ্য হিসেবে পরিচিত দেশগুলোতে নারীদের কোনো শারীরিক অবস্থাকে নারীর অযোগ্যতা বলা হয় না। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও নারীরা বিয়ের কাজী হতে পারেন। এতো সব উদাহরণ থাকার পরও বাংলাদেশে নারীর মাসিক প্রক্রিয়াকে তার সীমাবদ্ধতা মনে করা ও ধর্মীয়ভাবে অযোগ্যতা মনে করা মধ্যযুগের পশ্চাদপদ ধারণা বলে মনে করে নারী সংহতি।
নারী সংহতির পক্ষ থেকে দাবি জানানো হয়, অবিলম্বে আদালতের এ নির্দেশনা বাতিল করে বিয়ে রেজিস্ট্রেশনসহ সব ধরনের সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয় ও আইনগত কাজে নারীর অংশগ্রহণে বিদ্যমান সব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে।
এর আগে কাজী হতে পারবেন না নারীরা মর্মে দেয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি গত শনিবার (৯ জানুয়ারি) প্রকাশ করেন হাইকোর্ট। দেশের সামাজিক ও বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যেকোনো নারী বিবাহ রেজিস্ট্রার (কাজী) পদে আসীন হতে পারবেন না মর্মে নির্দেশনা দিয়ে রায় ঘোষণা করেছেন আদালত।
১০ জানুয়ারি রায় প্রকাশের বিষয়টি সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেন রিটকারীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. হুমায়ুন কবির।
তিনি বলেন, আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, নারীরা মাসের একটি নির্দিষ্ট সময় ফিজিক্যালি সমস্যায় থাকেন। মুসলিম বিবাহ হচ্ছে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং আমাদের দেশে অনেক বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা হয় মসজিদের ভেতরে। ওই সময় নারীরা মসজিদে প্রবেশ করতে পারেন না এবং সে সময় তারা নামাজও পড়তে পারেন না। এ বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে নারীদের দিয়ে বিবাহ রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন সম্ভব নয়। এই পর্যবেক্ষণ দিয়ে আদালত রুল খারিজ করে দেন।
এদিকে ফাউন্ডেশন ফর ল’ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের পক্ষ থেকে হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল আবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে বলে জাগো নিউজকে নিশ্চিত করেন সংস্থার চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট ফাউজিয়া করিম ফিরোজ। তিনি বলেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, নারীরা বিমানের পাইলট হচ্ছেন, সশস্ত্র বাহিনীতে কাজ করছেন, তাহলে কেন নারীরা কাজী হতে পারবেন না?
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়িয়া পৌরসভার ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাজী হিসেবে তিনজন নারীর নাম প্রস্তাব করে উপদেষ্টা কমিটি। তিন সদস্যের এই প্যানেল আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ওই বছরের ১৬ জুন আইন মন্ত্রণালয় ‘বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নারীদের দ্বারা বিবাহ রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়’ মর্মে চিঠি দিয়ে তিন সদস্যের প্যানেল বাতিল করেন।
পরে আইন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন বিবাহ রেজিস্ট্রারের প্যানেলে এক নম্বর ক্রমিকে থাকা আয়েশা সিদ্দিকা। রিটের শুনানি নিয়ে আদালত আইন মন্ত্রণালয়ের চিঠি কেন বাতিল করা হবে না এই মর্মে রুল জারি করেন। পরে ২০১৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের সামাজিক ও বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নারীরা বিবাহ রেজিস্ট্রার হতে পারবে না মর্মে আইন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত বহাল রেখে রায় দেন হাইকোর্ট।