ধর্ষণের পাশাপাশি বলাৎকার বর্তমান খুব আলোচিত ইস্যু। ইদানীং ছেলে শিশু যৌননিগ্রহ আশঙ্কাজনক হারেবেড়ে যাওয়ায় বিষয়টি আবারো আলোচনায় এসেছে। এমতাবস্থায় পুরুষ ধর্ষণসহ অন্যান্য ধর্ষণকে নারী ধর্ষণের মতো অপরাধ হিসেবে যুক্ত করতে দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় সংশোধন চেয়ে হাইকোর্টে একটি রিট একটি আবেদনও করা হয়েছে। প্রচলিত আইনে বলাৎকার ও ধর্ষণের তফাৎ আছে কিনা এবং এর আইনগত বিষয়গুলো নিয়ে লিখেছেন অঁজিষ্ণু অভি
♦ বলাৎকার কি ধর্ষণ?
টেলিভিশন বা সংবাদপত্র খুললেই নারী বা কন্যাশিশু ধর্ষণের খবরের পাশাপাশি আরেকটি খবর আশঙ্কাজনকহারে আসছে তা হলো ছেলেশিশুরাও যৌননিগ্রহ বা বলাৎকার এর শিকার হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হলো কন্যাশিশু বা মহিলারা যৌন নিপীড়নের শিকার হলে ধর্ষণের মোকদ্দমা আনা হচ্ছে কিন্ত ছেলে শিশুদের বলাৎকারের ক্ষেত্রেও কি একই আইন প্রজোয্য হচ্ছে?
ধর্ষণ বলতে কি বোঝায় তা আমরা সকলেই বুঝি। তাই এর সংজ্ঞা প্রদান আমার আলোচ্য বিষয় নয়, আমার আলোচ্য বলাৎকার বা পুরুষে পুরুষে সঙ্গম কে কোথায় অপরাধ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে? বলাৎকার ধর্ষণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে কিনা? হলে কখন বলাৎকারকে ধর্ষণ বিবেচনা করে অভিযোগ গঠন করা যায়?
♦ বলাৎকার
বলাৎকার এবং সমকামিতা আমাদের দেশে বিদ্যমান আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্ত আমাদের দন্ডবিধিতে বলাৎকার এবং সমকামিতাকে অপরাধ হিসেবে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়নি। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে বলাৎকার এর অভিযোগ আসলে দন্ডবিধির কোন ধারার অপরাধ বলে গণ্য হয়? ইংরেজ শাসনামল হতে আমাদের দেশে বলাৎকার এবং সমকামিতাকে দন্ডবিধির ৩৭৭ ধারার অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। যেখানে অস্বাভাবিক যৌন সম্পর্ক স্থাপনকে অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আইনপ্রণেতাগণ থেকে শুরু করে এদেশের সিংহভাগ মানুষই একজন নারী এবং পুরুষের মধ্যে যৌনসম্পর্ককেই স্বাভাবিক সম্পর্ক বলে গণ্য করে থাকে। সুতরাং এর বাইরে পুরুষ-পুরুষ বা নারী-নারী বা পশুর সাথে মানুষ যৌনসম্পর্ককে অস্বাভাবিক যৌনসম্পর্ক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কোনো ব্যক্তি যদি এরুপ অস্বাভাবিক যৌনসম্পর্কের অভিযোগ অভিযুক্ত হয় তবে তিনি যাবজ্জীবন বা দশবছর পর্যন্ত দন্ড পেতে পারে।
♦ ধর্ষণ এবং বলাৎকার প্রায় একই ধরণের কার্য হবার পরও কেনো পৃথক ধারায় অভিযোগ আনা হচ্ছে?
দন্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। সংজ্ঞায় কোন পুরুষ কতৃক কোন নারী বা স্ত্রীলোকের সাথে শব্দগুলো ব্যবহারের কারনে কোন পুরুষের সাথে পুরুষের মধ্যে সঙ্গম সেটা সম্মতিতে বা বলপূর্বক যা-ই হোক না কেন বা কোন স্ত্রীলোক কর্তৃক কোন পুরুষের সাথে জোরপূর্বক সঙ্গমকে ধর্ষণ বলে গণ্য করার সুযোগ থাকছে না। তাই এ ধরণের অভিযোগ আসলে তাকে ৩৭৭ ধারার অপরাধ বলে গণ্য হচ্ছে।
♦ বলাৎকার কি ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হতে পারে?
হ্যাঁ, বলাৎকার ও ধর্ষণ হিসেবে গন্য হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে এক্ষেত্রে যিনি বলাৎকারের শিকার হবেন তাকে অবশ্যই ১৬ বছরের কম বয়স্ক কোনো ছেলে শিশু হতে হবে।সেক্ষেত্রে দন্ডবিধির ৩৭৫-৩৭৬ ধারায় ধর্ষণের মামলা নয় বরং নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ২০০০ এর ৯ ধারার অপরাধ হিসেবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করতে হবে। কিন্ত বলাৎকারের শিকার শিশুটির বয়স যদি ১৬ বছরের বেশি হয় তাহলে আর তার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধকে ধর্ষণ হিসেবে মামলা করার সুযোগ থাকবে না।এক্ষেত্রে ঐ অপরাধটি তখন দন্ডবিধির ৩৭৭ ধারার অপরাধ হিসেবে দায়রা/ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দায়ের করতে হবে।
♦ ছেলে শিশু বলাৎকারকে ধর্ষণ বলার আইনগত ব্যখ্যা
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ একটি বিশেষ আইন যা নারী এবং শিশুদের অধিকতর সুরক্ষা প্রদান এবং তাদের ওপর সংঘটিত কতিপয় অপরাধ যেমন ধর্ষণ, যৌনহয়রানি, অপহরণ, যৌতুকের জন্য যখম বা মৃত্যু ঘটানো প্রভৃতি অপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া দ্রুততম সময়ে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে করা হয়েছে। অসুন একটু এই আইনের ৯ ধারায় যেখানে ধর্ষণকে অপরাধ গণ্য করে সাজা দেওয়া হয়েছে তা জেনে নিই-
* ধারা – ৯(১): যদি কোন পুরুষ কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন তাহলে তিনি মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন।
এবার উপরের শিশু শব্দটির ওপর মনোনিবেশ করেন। ওখানে শিশু বলা হয়েছে, কন্যা শিশু বা মেয়ে শিশু নয়। শিশু একটি উভয়লিঙ্গবাচক শব্দ। যা ছেলে বা মেয়ে উভয় শিশুকে বোঝায় এমনকি এর বাইরে তৃতীয় লিঙ্গের শিশুদের ও বুঝায়। এ আইনের নামকরণও এই সাক্ষ্য দেয় যে এটি সমগ্র নারী এবং ছেলে বা মেয়ে উভয় শিশুর সুরক্ষা কল্পে করা হয়েছে। সুতরাং ১৬ বছরের কম বয়স্ক কোনো ছেলে শিশুদের বিরুদ্ধে হওয়া যৌন নির্যাতন এ ধারানুযায়ী ধর্ষণ বলে গণ্য হবে এবং শিশু বলাৎকারের সাজাও মৃত্যুদন্ড হতে পারে। এরপরও যাদের সন্দেহ থেকে যায় তাদের জন্য উচ্চ আদালতের একটি সিদ্ধান্ত তুলে ধরছি-
“ABDUS SALAM VS STATE, 9 BLC, 2014” হাইকোর্ট স্পষ্ট সিদ্ধান্ত দেন ১৬ বছরের নিচে যে কোন ছেলে শিশুর বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা ‘ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ ধারায় হবে, দন্ডবিধিতে নয়। এমনকি যদি সেটি ঐ ছেলে শিশুর সম্মতিতে হয় তারপরও।
বিচারপ্রক্রিয়ার সাথে যারা একটু পরিচিত তারা সকলেই জানেন উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত নিম্ন আদালতের জন্য ঐ একই বিষয়ে অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক। এ সিদ্ধান্তটি বাতিল বা স্থগিত হয়নি। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল উচ্চ আদালতের অধস্তন হওয়ায় তারাও এটি অনুসরণ করতে বাধ্য। শিশু বলতে ১৮ বছর জানলেও উপরে ১৬ বছরের কম বয়স বলার কারণ এ আইনটির ৯ (১) ধারার ব্যাখ্যায় ১৬ বছর বয়স উল্লেখ আছে।
সুতরাং, এ থেকে বলা যায় ১৬ বছরের কম বয়স্ক ছেলে শিশুর সম্মতিতেও যদি বলাৎকার বা পায়ুসঙ্গম করা হয় তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর ৯ ধারা অনুযায়ী যার সাজা মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড হতে পারে। নিজে সচেতন হোন, অন্যদের মধ্যেও এই বার্তা ছড়িয়ে দেন ‘শিশু বলাৎকার ও ধর্ষণ বলে গণ্য হবে এবং এর সাজা মৃত্যুদন্ডও হতে পারে।
অঁজিষ্ণু অভি: শিক্ষানবিশ আইনজীবী, ঢাকা জজকোর্ট