জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মহসিন হাসানের সঙ্গে কুষ্টিয়া পুলিশ সুপার (এসপি) এসএম তানভীর আরাফাতের এমন আচরণ ও শব্দচয়ন গুরুতর আদালত অবমাননার শামিল এবং পুলিশ সুপারের এই ধরনের আচরণ বিচার প্রশাসন তথা বিচার বিভাগের ওপর মারাত্মক আক্রমণ বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট।
এই ঘটনাকে হালকাভাবে নেয়ারও সুযোগ নেই জানিয়ে এমন কর্মকাণ্ডকে আদালত এড়িয়ে যেতে পারে না বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন উচ্চ আদালত।
জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মহসিন হাসানের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের কারণে কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপারকে তলবের বিষয়ে দেয়া আদেশের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেছেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা ও আইনানুযায়ী ভোটকেন্দ্রে বিচারিক দায়িত্ব পালন করছিলেন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মহসিন হাসান। কিন্তু দায়িত্বরত একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে ওই পুলিশ সুপার যে আচরণ করেছেন তা আদালত অবমাননার শামিল।
পুলিশ সুপারের এমন কর্মকাণ্ড শুধু বিচার প্রশাসনে হস্তক্ষেপই নয় বরং পুরো বিচার বিভাগের প্রতি আক্রমণ বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট।
আদালত বলেন, সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মহসিন হাসানের প্রতি তার (এসপি) এই আচরণ এড়িয়ে যাওয়া যায় না এবং এটি হালকাভাবে নেয়া যায় না। কারণ তিনি (এসপি) শুধু আদালত অবমাননাই করেননি তিনি তার কথা ও আচরণের মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে বিচার বিভাগের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করেছেন।’
আদালত আরও বলেন, তাঁর সঙ্গে পুলিশ সুপারের এমন আচরণ ও শব্দচয়ন গুরুতর আদালত অবমাননার শামিল। তার এই ধরণের আচরণ বিচার প্রশাসন তথা বিচার বিভাগের ওপর মারাত্মক আক্রমণ।
‘উনার এমন কর্মকাণ্ডকে আমরা (আদালত) এড়িয়ে যেতে পারি না। এছাড়া এটাকে হালকাভাবে নেয়ারও সুযোগ নেই। উনি শুধু গুরুতর আদালত অবমাননাই করেননি, বিচার বিভাগের ভাবমূর্তিকেও ক্ষুণ্ণ করেছেন।’
হাইকোর্টের বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ লিখিত আদেশে বুধবার (২০ জানুয়ারি) এমন পর্যবেক্ষণ দেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন নজরে আসার পরে সেটি আমলে নিয়ে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ স্ব-প্রণোদিত হয়ে এমন আদেশ দেন।
একইসঙ্গে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মহসিন হাসানের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের ব্যাখ্যা জানার জন্যে কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার এসএম তানভীর আরাফাতকে তলব করেছেন হাইকোর্ট। আগামী ২৫ জানুয়ারি ওই এসপিকে সশরীরে আদালতে হাজির হয়ে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে।
এর আগে ১৬ জানুয়ারি কুষ্টিয়া ভেড়ামারা পৌরসভা নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকালে কুষ্টিয়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মহসিন হাসানের সঙ্গে পুলিশ সুপার এসএম তানভীর আরাফাতের দুর্ব্যবহারের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে লিখিতভাবে আবেদন করেন।
বিষয়টি অবগত করার জন্যে ওই আবেদনের কপি সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ে পাঠানো হয়। ওই একই অনুলিপি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজির) দফতরেও পাঠানো হয়েছে।
আবেদনে কুষ্টিয়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মহসিন হাসান বলেছেন, ‘কুষ্টিয়া ভেড়ামারা পৌরসভা নির্বাচনে ১৪ জানুয়ারি হতে ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রথম শ্রেণির জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হই। এরপর ১৬ জানুয়ারি দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় সকাল ১০টায় ভেড়ামারা পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে অবস্থানকালে এক ভোটারের অভিযোগের ভিত্তিতে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করি। সেখানে কতিপয় ব্যক্তিকে ভোটকেন্দ্রের বুথের ভেতর লম্বা বেঞ্চে পোলিং এজেন্টদের সঙ্গে বসে থাকতে দেখি। তখন তাদের পরিচয়পত্র দেখাতে বললে তারা পরিচয়পত্র না দেখিয়ে প্রিজাইডিং অফিসার স্বাক্ষরিত এ ফোর সাইজের কাগজ দেখান। আমি সংশ্লিষ্ট প্রিজাইডিং অফিসারকে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য বুথের বাইরে ডাকি। কথা বলা শুরু করতেই ভোটকেন্দ্রে ৪০/৫০ জন ফোর্সসহ কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার এস এম তানভীর আরাফাত প্রবেশ করেন।’
‘তিনি প্রবেশ করেই প্রিজাইডিং অফিসারকে উচ্চস্বরে তলব করেন। তাৎক্ষণিকভাবে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমানসহ কয়েকজন ফোর্স প্রিজাইডিং অফিসারকে আমার সঙ্গে কথা বলতে না দিয়েই তাকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন এবং তাদের চাপাচাপি করেন। তখন আমি নিজের পরিচয় দিয়ে বলি প্রিজাইডিং অফিসারের সঙ্গে একটি বিষয়ে কথা বলছি। কথা শেষ হলে উনাকে নিয়ে যান।’
‘এরপরেও এএসপি মোস্তাফিজুর রহমান ধমক দিয়ে প্রিজাইডিং অফিসারকে আমার সামনে থেকে নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ সুপার তানভীর আরাফাত আমার দিকে অগ্রসর হন এবং আমাকে জিজ্ঞেস করেন আপনি কে? কি করেন এখানে? আমি আমার পরিচয় দিলে তিনি আরও ক্ষিপ্তস্বরে বলেন, আপনি এখানে কি করেন? বেয়াদব, বের হয়ে যান এখান থেকে। আমি পুলিশ সুপার ও তার ফোর্সদের আক্রমণাত্মক, চরম অসৌজন্যমূলক ও মারমুখী আচরণে হতচকিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকি।’
‘এরপর এসপিসহ তার সঙ্গীয় ফোর্স আমার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় আমাকে উদ্দেশ্যে করে একাধিকবার বলেন, এসব লোককে কে পাঠায়? বেয়াদব ছেলে। এখানে কাজ কি আপনার? বের হয়ে যান এখান থেকে। তারা কেন্দ্র থেকে চলে যাওয়ার পর আমি বিষয়টি ভেড়ামারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবহিত করি।’
আবেদনে বলা হয়েছে, ‘পুলিশ সুপার ও তার সঙ্গীয় ফোর্সদের আচরণ স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিধিমালা ২০১০-এর ৬৯, ৭০, ৭৪, ৮০ ও ৮১ বিধির সরাসরি লঙ্ঘন। তাই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রার্থনা করছি। এরপর ১৯ জানুয়ারি রাতে কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের অভিযোগ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।’
ওই প্রতিবেদন আদালতের নজরে আসার পরে সেই এসপিকে তলব করেন হাইকোর্ট। ‘অসৌজন্যমূলক আচরণ’ এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিধিমালা ‘লঙ্ঘনের’ অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে হবে পুলিশ সুপার এস এম তানভীর আরাফাতকে।