কামরুজ্জামান পলাশ: সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, “প্রেম গাছ থেকে পড়া অন্ধ তালের মতো, কার ঘাড়ে গিয়ে যে কখন পড়ে তা আগেভাগে বলা যায় না”। যদিও তিনি তালটি ঘাড়ে পড়ার পরবর্তী অবস্থার কথা বলেন নি, তবে আন্দাজ করা যায়, যার ঘাড়ে পড়বে তার অবস্থা বেশ সুখকর হবে বলে মনে হয় না।
সেই আদিকাল হতেই ভালবাসার আদান-প্রদান হয়ে আসছে। আজও রয়েছে সেই ঐতিহ্য কিন্তু পাল্টে গেছে ভালবাসা প্রকাশের ধরন। আগেরকার সময়ে হাতে লেখা চিঠি বিনিময়ের মাধ্যমে ভাব ও ভালবাসা প্রকাশ করা হত আর একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা ব্যবহার করতে শুরু করি ডিজিটাল যোগাযোগ মাধ্যম। তারই এক বহুল আলোচিত ও সমালোচিত মাধ্যম হল ইন্টারনেট ভিত্তিক কিছু ফেসবুক পেইজ “ ক্রাশ এন্ড কনফেশন”।
আজকাল স্কুল, কলেজ থেকে শুরু করে ভার্সিটি পড়ুয়া তরুণ-তরুণীদের প্রেম নিবেদনের মাধ্যম হয়ে উঠেছে এই সব অনলাইন ভিত্তিক পেইজ। যেইখানে তারা সহজেই নিজের পরিচয় গোপন রেখে অপরচিত একজনের ছবি দিয়ে কাব্যিক ভাষায় বা কখনও আবেগময় কথার বাচন ভঙ্গি দিয়ে নিজের ভাষাগত দক্ষতা দেখিয়ে তার প্রিয় মানুষটিকে তার মনের কথা জানাতে চায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে বাস্তব ও আইনগত দিক দিয়ে কতটুকু যুক্তিযুক্ত এই ধরনের প্রেম নিবেদন বা প্রচলিত আইন কতটুকু সমর্থন করে এই অনলাইন ভিত্তিক রোমিও-জুলিয়েটদের?
“ক্রাশ এন্ড কনফেশন” কথাটির সাথে কম বেশি সবাই পরিচিত। অনেকেই এই জাতীয় পেইজ এ পোস্ট করার মাধ্যমে তাদের প্রিয়জনকে প্রেম নিবেদন করে থাকে। এই ধরনের পোস্ট করার কারনে অনেকের গোপনীয়তা নষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া কখনও কখনও এইসব পোস্টের মাধ্যমে কারোর সম্মান হানিও ঘটে। নিম্নে দুটি উদাহরণ উল্লেখ করছি-
পত্রিকায় “ফেসবুকে যৌন হয়রানি, রাবি ছাত্রীর জিডি” নামীয় একটি সংবাদের হেডলাইন ছিল। উক্ত সংবাদের বিবরনীতে বলা হয়, “মধ্যরাতে ‘আর ইউ ক্রাশ এ্যান্ড হেইট কনফেশন’ নামক ফেসবুক পেজে তার ছবিসহ একটি পোস্ট দেয়া হয়। পোস্টে ওই ছাত্রীর সম্মানহানি করে আপত্তিকর ও বিব্রতকর কথাবার্তা লেখা হয়। এ বিষয়ে পেজটির কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর পরও পোস্ট সরিয়েনা নেয়ায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য থানায় জিডি করেন রাবি ছাত্রী।”[1]
আরেকটি অনলাইন ভিত্তিক নিউজ পোর্টালে “চবিতে কনফেশন পেজের নামে নোংরামি” হেডলাইন সংবলিত সংবাদ প্রকাশিত হয়। উক্ত সংবাদেও কনফেশন পেইজের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের হয়রানির কথা তুলে ধরা হয়। উলেখ্যযে “১৯ অক্টোবর, শনিবার প্রাণীবিদ্যার এক শিক্ষার্থী সম্পর্কে ব্যক্তিগত তথ্য তুলে ধরে তার সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করা হয়। এরপর থেকেই এই পেজগুলো নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হতে থাকে ক্যাম্পাসে। পেজটি বন্ধের জন্য প্রশাসনের কাছে দাবিও জানান তারা।”[2]
২০১৮ সালের ৪৬ নং আইন ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন- ২০১৮ এর মাধ্যমে বর্ণিত সকল সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে। উক্ত আইনের এর ধারা ২৬ এ অনুমতি ব্যতিত পরিচিতি তথ্য সংগ্রহ ও ব্যবহার ইত্যাদির দন্ড সম্পর্কে বলা হয়েছে। ধারা ২৬ এর উপধারা-১ এ বলা হয়েছে, যদি কোন ব্যক্তি আইনগত কর্তৃত্ব ছাড়া অন্যকোন ব্যক্তির পরিচিতি তথ্য সংগ্রহ, বিক্রয়, দখল, সরবরাহ বা ব্যবহার করেন তাহলে উক্ত ব্যক্তি উপধারা ২ অনুসারে অনধিক ৫ (পাঁচ) বছরের কারাদন্ড বা ৫ (পাঁচ) লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয়দন্ডে দন্ডিত হবেন।
তাছাড়া উপধারা-৩ এ বলা হয়েছে, যদি কোন ব্যক্তি উপধারা-১ এ উল্লিখিত অপরাধ দ্বিতীয়বার সংঘটন করে তাহলে তিনি অনধিন ৭ (সাত) বছরের কারাদন্ডে বা অনধিক১০(দশ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয়দন্ডে দন্ডিত হবেন।
উল্লেখ্য যে উক্ত আইন ২০১৮ এর ধারা ২৬ এ “পরিচিতি তথ্য” বলতেঃ নাম, ছবি, ঠিকানা, জন্ম তারিখ ইত্যাদি বোঝানো হয়েছে।
এই আইনের ধারা ২৯ এ মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, প্রচারের শাস্তি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। ধারা ২৯ এর উপধারা-১ এ বলা হয়েছে যদি কোন ব্যক্তি ওয়েবসাইট কিংবা কোন ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে পেনাল কোড-১৮৬০ এর ধারা ৪৯৯ এ বর্ণিত মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করে তাহলে উক্ত ব্যক্তি অনধিক ৩ (তিন) বছর কারাদন্ডে বা অনধিক ৫ (পাঁচ) লক্ষ টাকা অর্থদন্ডে বা উভয়দন্ডে দন্ডিত হবেন। তাছাড়া উপধারা-২ এ বলা হয়েছে যেকোন ব্যক্তি উপধারা-১ এ বর্ণিত অপরাধ পুনঃরায় সংঘটন করেন তাহলে উক্ত ব্যক্তি অনধিক ৫ (পাঁচ) বছর কারাদন্ডে বা অনধিক ১০(দশ) লক্ষ টাকা অর্থদন্ডে বা উভয়দণ্ডে দন্ডিত হবেন।
উক্ত আইন ২০১৮ এর ধারা ৩৫ এ অপরাধ সংঘটনে সহায়তার শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ধারা ৩৫ এর উপ ধারা ১ ও ২ এ বলা হয়েছে যে, যদি কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করেন, তাহলে উক্ত কাজটি আইনের চোখে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে এমনকি শাস্তির ক্ষেত্রে মূল অপরাধটির জন্য যে দন্ড নির্ধারিত রয়েছে, সহায়তাকারী ব্যক্তি সেই দন্ডে দন্ডিত হবেন।
তাই ক্রাশ এন্ড কনফেশনের নামে বিনা অনুমতিতে অপরিচিত কারোর নাম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি বা অন্যান্য তথ্য দেয়া আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। এই ক্ষেত্রে শুধু পোস্টদাতা নয় উক্ত পোস্ট শেয়ার করতে সহায়তাকারীকেও সমানভাবে দোষী হিসেবে গণ্য করা হবে। এইক্ষেত্রে পোস্টদাতা ও পোস্টদানে সহায়তাকারী ক্রাশকে নিয়ে নয় বরং নিজেদের ক্রাইম সম্পর্কে স্বীকারোক্তি দিচ্ছেন।
পরিশেষে বলা যায় প্রেম নিয়ে “নেপোলিয়ান”ই যথার্থ বলেছেন –“ প্রেমের ব্যাপারে যদি কেউ জয়ী হতে চায়, তাহলে সেক্ষেত্রে জয়ী হওয়ার একমাত্র অস্ত্র হলো পলায়ন করা”। নেপোলিয়ানের কথা মেনে পালালে হয়ত সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের মতে ব্যাখ্যা করা ঘাড়ে গাছ থেকে পড়া অন্ধ তাল থেকে বাঁচা যাবে।
কামরুজ্জামান পলাশ: শিক্ষার্থী; আইন বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি
[1]The DailyCampus; 5thApril 2019.
[2]বাংলা; ২২ অক্টোবর ২০১৯