ঢাকা: ঢাকা জেলার সাভারের গান্ধারীয়া মৌজার কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি দুই ব্যক্তির নামে অবমুক্তি করে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ ট্রাইব্যুনালের রায় বাতিল করেছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে আদালতের সঙ্গে প্রতারণার জন্য এক ব্যক্তিকে কোটি টাকা জরিমানা করেছেন উচ্চ আদালত।
এ বিষয়ে জারি করা রুল চূড়ান্ত করে বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০২০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রায় দেন। যে রায়ের ১২৩ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
উচ্চ আদালতে রিটকারী পক্ষে ছিলেন আইনজীবী হাবিব-উন-নবী। বিবাদীপক্ষে ছিলেন আইনজীবী মো.মনিরুজ্জামান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ওয়ায়েস আল হারুনী।
রায়ে অনুসারে জানা যায়, ঢাকা জেলার সাভারের গান্ধারীয়া মৌজার ২ নম্বর খতিয়ানের এস.এ ৩০ নম্বর দাগের ১৫ দশমিক ২ একর, ৭২ নম্বর দাগের শূন্য দশমিক ১৬ একর, ৭৮ নম্বর দাগের শূন্য দশমিক ৫৬ একরসহ মোট ১৫ দশমিক ৭৪ একর ভূমির মালিক বীরেশ চন্দ্র সাহা পোদ্দার। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ভারতে চলে যান তিনি। ফলশ্রুতিতে নালিশি সম্পত্তি সেনসাস লিস্ট অনুযায়ী শত্রু সম্পত্তি হিসাবে তালিকাভুক্ত হয়। পরবর্তীকালে নালিশি সম্পত্তিকে অর্পিত সম্পত্তি তথা ভেস্টেড প্রপার্টি (ভি.পি) তালিকাভুক্ত হয়। দীর্ঘদিন পর ২০১২ সালে মাধব চন্দ্র সাহা পোদ্দার ও রোহী চন্দ্র সাহা সংশ্লিষ্ট মৌজার এক হাজার ৫৫৬ শতাংশ সম্পত্তির মালিকানা দাবি করে এবং প্রকাশিত গেজেটে ‘ক’ তফসিলভুক্ত অর্পিত সম্পত্তির তালিকা হতে অবমুক্তির জন্য ঢাকার অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ ট্রাইব্যুনালে মামলা (মামলা নম্বর :৪৭৯/২০১২) দায়ের করেন। দরখাস্তকারীর (রিটকারীর) বর্ণনামতে ২ ও ৩ নম্বর প্রতিপক্ষ (মাধব চন্দ্র সাহা পোদ্দার ও রোহী চন্দ্র সাহা) জাল দলিল সৃজন করে মামলাটি করে।
২০১৬ সালে ২৫ অক্টোবর সাভারের সিনিয়র সহকারি জজ আদালত এক রায়ে বাদী পক্ষের আবেদন মঞ্জুর করেন। নালিশি সম্পত্তি অবমুক্তির আদেশ দেন।
এই রায় ও ডিক্রির বিরুদ্ধে আপিল (আপিল নম্বর: ২০/২০১৭) করেন ঢাকার জেলা প্রশাসক। অর্পিত সম্পত্তি আপিল ট্রাইব্যুনাল এবং ঢাকার জেলা জজ ২০১৭ সালের ২ নভেম্বর আপিল খারিজ করে সিনিয়র সহকারি জজ আদালতের রায় বহাল রাখেন। পরে এই রায়ের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর হাইকোর্টে রিট করে সাভার থানা অসহায় পরিবার পুনর্বাসন বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড।
রিটে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ ট্রাইব্যুনাল ও আপিল ট্রাইব্যুনালের রায় ও ডিক্রি অবৈধ ঘোষণার আবেদন জানানো হয়। ওই রিটের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট রুল জারি করে। ওই রুলের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে গত বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট রায় দেন।
রায়ে হাইকোর্ট বলেন, মাধব তার সাক্ষ্যে বলেছেন যে, নালিশী জমি তার দাদা ক্ষেত্র মোহন সাহা পোদ্দার সি.এস মালিক রমনী মোহন রায় হতে বন্দোবস্ত নিয়েছিল এবং এই বন্দোবস্তের কাগজপত্র তিনি আদালতে দাখিল করেছেন। নথিতে একটি বন্দোবস্ত দলিলের সিল-সাক্ষরবিহীন অস্পষ্ট ফটোকপি আছে। যেটি খালি চোখে দেখলে বুঝা যায় এটি অতি সম্প্রতি তৈরি করা জাল কাগজ।
‘তারা বীরেশ চন্দ্র সাহা পোদ্দারের সন্তান হলে তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে তাদের পারিবারিক ছবি আদালতে দাখিল করতেন। বাবা-মায়ের নামের ভোটার তালিকা উপস্থাপন করতেন। বাবা-মা কবে মারা গেছেন, কোথায় দাহ করা হয়েছে বলতে পারতেন। তাদের অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের নাম, ঠিকানা বলতে পারতেন। নথি পর্যালোচনায় এটা দিবালোকের মত স্পষ্ট যে, আবেদনকারীরা বীরশে চন্দ্র সাহা পোদ্দারের সন্তান হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। ’
হাইকোর্টের রায়ে আরও বলা হয়, মাধব ও তার ভাই রোহী তাদের কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পত্তিকে পরিত্যক্ত রেখে দীর্ঘ ৪০/৫০ বছর কেন নীরব ছিলেন সেই বিষয়ে কোন বক্তব্য নেই। মূল মামলার আবেদনে তারা ঠিকানা হিসেবে মিরপুরের কালসীর ঠিকানা দিয়েছেন। সাভারে কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক নিজের সম্পত্তিতে না থেকে মিরপুরের কালসিতে ভাড়া বাসায় থাকেন কেন তার কেনো ব্যাখ্যা নেই। এমনকি কালসীর কত নম্বর বাসায় থাকেন এবং সেই বাসার হোল্ডিং নম্বর দেন নি। অর্থাৎ তারা যে প্রকৃতপক্ষে ভুয়া এবং জালিয়াত তা দিনের আলোর মত প্রমাণিত সত্য।
রায়ে উচ্চ আদালত বলেন, জনগণের সম্পত্তি দেখভালের সর্বশেষ স্তরে জনগণ বিচারকদের ওপর আস্থা রেখেছেন। সুতরাং বিচারকদের বিশাল গুরুদায়িত্ব হলো জনগণের সম্পত্তি যেন জোচ্চর, ঠক, বাটপার এবং জালিয়াত চক্র গ্রাস করতে না পারে।’
রায়ে আদালতের সঙ্গে প্রতারণার জন্য ২ নম্বর প্রতিপক্ষকে এক কোটি টাকা জরিমানা করে রুলটি চুড়ান্ত করেন। বাতিল করেন অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যপর্ণ ট্রাইব্যুনাল ও ঢাকা জেলা জজের রায় ও ডিক্রি।
এছাড়া হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি পুনরায় কোন জালিয়াত চক্র, প্রতারক চক্র দখল করতে না পারে, জাল দলিল সৃজন করে এই নালিশি সম্পত্তি গ্রাস করার প্রচেষ্টা প্রতিহত করতে মূল মালিক ‘ক্ষেত্র মোহন’ এর নামে সাভার অঞ্চলের শিশু কিশোরদের জন্য একটি শিশু পার্ক নির্মাণ করতে ঢাকার জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেন।
রায়ের এই অনুলিপি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণের জন্য পাঠাতে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে নির্দেশ দেওয়া হয়। যাতে প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগত উদ্যোগে নালিশি অর্পিত সম্পত্তিসহ লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার রাষ্ট্র তথা জনগণের সম্পত্তি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের মত লুটেরা বাহিনীর হাত হতে রক্ষা করতে যথাযথ উদ্যোগ নিতে পারেন।