কাজী শরীফ: নোয়াখালীর একটি সুপ্রাচীন উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন সিনিয়র শিক্ষক ২০১৪ সালের মাঝামাঝি দেওয়ানি আদালতে একটা ঘোষণামূলক মোকদ্দমা করেন। শিক্ষকের নাম আবুল কাশেম (ছদ্মনাম)৷ তার দাবি ২০১৪ সালে স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করেন। তিনি সে বহিষ্কারাদেশ অবৈধ ও তার উপর বাধ্যকর নহে ঘোষণার ডিক্রি চান। অন্যদিকে স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের উদ্দেশ্যে কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডে আবেদন করলে তারা আদালতে মোকদ্দমা থাকায় তা নিষ্পত্তির আগে চূড়ান্ত বহিষ্কারে অপারগ বলে ঘোষণা দেন। সাসপেন্ড করার কারণে জনাব আবুল কাশেম রীতি অনুযায়ী সামান্য সুবিধা ব্যতীত অন্যান্য ভাতাবঞ্চিত হয়ে এক মানবেতর জীবন কাটাতে থাকেন।
২০১৯ সালে আমার বিচারিক জীবনের মাস তিনেকের মধ্যেই মোকদ্দমার বিবাদীপক্ষ মানে স্কুল কর্তৃপক্ষ একটা আরজি খারিজের দরখাস্ত করেন। তাদের দাবি সাসপেনশন আদেশের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা চলে না। যদি বাদীকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হতো তাহলেই কেবল তার মামলা করার অধিকার জন্মাতো। বিবাদীপক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবী ডিএলআরের বেশ কয়েকটি রেফারেন্স দিয়ে শুনানি করেন। আমি দরখাস্ত নামঞ্জুর করে বলি যথাযথ পদ্ধতি অবলম্বন না করে কাউকে সাসপেন্ড করা হলে আদালতে যাওয়ার পূর্ণ অধিকার একজন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আছে। আদালতে যেতে না পারলে তার অধিকার লঙ্ঘিত হয়।
আমার নামঞ্জুর আদেশের বিরুদ্ধে জেলা জজ আদালতে স্কুল কর্তৃপক্ষ রিভিশন করেন। মাননীয় জেলা জজ আদালত আমার আদেশ বহাল রাখেন।
আত্নপ্রচার হলেও বলি নোয়াখালীর সে বিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন ছাত্র আমার বেশ সিনিয়র একজন সম্মানিত বিচারক। তিনি এ আদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেন। যা আমার মত এক নবীন বিচারকের জন্য অত্যন্ত আনন্দদায়ক।
মূল প্রসঙ্গে আসি। মোকদ্দমা শুনানিতে চলে আসে। করোনার বাধা পেরিয়ে শুনানিতে মোকদ্দমার বাদী শিক্ষক তার লম্বা জবানবন্দিতে দাবি করেন ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তাকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। তিনি প্রধানশিক্ষক হতে দরখাস্ত করেন। পরীক্ষায় তিনি সবচেয়ে ভালো করলেও তাকে প্রধানশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয়নি। এ ঘটনার প্রতিবাদ করায় ঝামেলার সূত্রপাত। যার রেশ তিনি টেনে চলেছেন।
অপরদিকে স্কুলের দাবি হলো এ শিক্ষক ক্লাসে অনিয়মিত। একরোখা ও কারো কথা শোনেন না, ক্লাসে পড়ান না ইত্যাদি।
আমি দেখলাম যে প্রধানশিক্ষকের সাথে সমস্যা তিনি ইতোমধ্যে অবসরে চলে গেছেন। স্কুল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্তে জাতীয়করণ হয়ে গেছে। স্কুলের সভাপতি পদাধিকারবলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। সুতরাং মোকদ্দমা চালানোর চেয়ে আপসে সমাধান করাই উত্তম।
বাদী শিক্ষক আবুল কাশেম সাহেবের সাক্ষ্যশেষে জেরা করতে এলেন স্কুলের পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবী। আমি বিজ্ঞ আইনজীবীকে বললাম “লার্নেড আজ জেরা করবেন না। আমি একটু দেখি।”
এটা বলেই জিজ্ঞেস করি স্কুলের পক্ষে আদালতে কে এসেছেন?
একজন পেছন থেকে দাঁড়িয়ে বললেন “স্যার আমি আছি।”
জিজ্ঞেস করলাম আপনি স্কুলের কী?
বললেন “আমি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক।”
বললাম আপনারা দুইজন অপেক্ষা করেন। আজ এজলাস থেকে নেমে আপনাদের সাথে কথা বলব।
এজলাস থেকে নামার পর প্রথমে স্কুলের প্রতিনিধি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে ডাকলাম। তার সাথে কুশল বিনিময়ের পর তিনি বললেন তার সরাসরি ছাত্র বিচারক। এ স্কুলেই তিনি পড়েছেন। আমি বুঝলাম তাকে দিয়েই এগোতে হবে।
বললাম “আপনার ছাত্র আজ বিচারক। যিনি আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে অধিকার ফিরে পেতে লড়ছেন তার ছাত্রও একই বিচারক। নিশ্চয়ই আপনার ছাত্র আপনাদের এ অবস্থা দেখে কষ্ট পান। আপনারা কি সব ভুলে এক হতে পারেন না?”
দেখলাম তিনি নরম হয়ে এসেছেন।
এবার বাদীকে ডেকে বললাম “জীবনতো একটাই। আপনি শিক্ষক হতে এ পেশায় এসেছেন। প্রধানশিক্ষক হতে আসেননি। সব ভুলে যান। ক্লাসে ফিরে যান। আপনার ইংরেজি ক্লাস থেকে যে ছেলেমেয়েরা বঞ্চিত হচ্ছে তা কি আপনাকে পোড়ায় না? আপনার ছাত্র আজ বিচারক। তিনিও তো আপনার কাছে পড়েই আজ এত বড় পদে।”
তিনি বললেন “স্যার আপনি মিটমাট করে দেন। ক্লাসে যেতে চাই।”
এরপর দুজনকে একসাথে বসালাম। আমি কিছুকথা বললাম। দেখি দুই শিক্ষক দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন।
আহা! কী গভীর মমতা। বললাম একটা এডিআরনামা বিজ্ঞ আইনজীবীদের দিয়ে প্রস্তুত করেন। আমি যা বলছি তাই লিখে আনেন। রবিবার আসেন।
আমার কথামত গত রবিবার উভয়পক্ষ আদালতে উপস্থিত। বিজ্ঞ আইনজীবীরা উপস্থিত। এডিআর হয়ে গেল। বাদী আবুল কাশেম স্কুলে যোগদান করবেন। তিনি চাকুরি ফিরে পেলেন।
আমি সেদিনই আদেশ লিখলাম। এডিআরমূলে মোকদ্দমায় ডিক্রি হলো। ন্যায়বিচারের স্বার্থে আরও লিখলাম “সাড়ে ছয় বছর মামলা চালাতে চালাতে নিঃস্ব ঋণগ্রস্ত শিক্ষককে যেন তার সাড়ে ছয় বছরের বকেয়া প্রাপ্য ভাতাদি দেয়া হয়। স্কুল জাতীয়করণ করায় তাকেও যেন সে সুবিধা দেয়া হয়।”
আদেশের কপি তাই জেলা শিক্ষা অফিসার, নোয়াখালী ও কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবর প্রেরণের নির্দেশ দিলাম। আজ ডিক্রিতে স্বাক্ষর করলাম। ইনশাআল্লাহ আগামীকাল একজন শিক্ষক সাড়ে ছয় বছরের লড়াই শেষে যোগদান করবেন তার প্রাণের স্কুলে।
গত রবিবার এডিআর শেষে স্কুল কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ও বাদী শিক্ষক আমার কাছে একটা আবদার করেছেন। আমি যেন সে স্কুলে একবার যাই। তাদের দেখে আসি।
আমি বলেছি “আমি ইনশাআল্লাহ যাব৷ আপনাদের দেখতে নয় আপনারা ক্লাস নিচ্ছেন আর বাচ্চারা আপনাদের ক্লাসে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বসে আছে এমন দৃশ্য দেখতেই আমি যাব।”
আমার কথাশুনে বহুদিন পর আবুল কাশেম সাহেবের মুখে হাসি দেখলাম। হাসি দেখতে দেখতে ভাবছি সুখী মানুষের হাসি এত সুন্দর কেনো!
দুনিয়ার কোনপ্রান্তে কোন শিক্ষক কষ্ট পাচ্ছেন এটা মানতে আমার কষ্ট হয়৷ অনেকে বলেন শিক্ষক ছিলাম বলে শিক্ষকদের আমি এত ভালোবাসি। তাদের কী করে বোঝাই আমার ছাত্রজীবন প্রায় দেড়যুগের। সুতরাং আমি আগে ছাত্র পরে শিক্ষক।
আমার শিক্ষকদের প্রতি আজীবনের ঋণ। এ আদেশ লেখার সময় আমার শিক্ষকদের চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠেছে ৷ দুনিয়ার সব শিক্ষককে শ্রদ্ধা।
কাজী শরীফ – সহকারী জজ, নোয়াখালী।