মারুফ রাজশাহী সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা পাস করেছেন। পরে কম্পিউটারের ওপরে একটি কোর্স করেছেন। চাকরি পেয়েছিলেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। শুধু হিজড়া বলে চাকরি থেকে বাদ পড়েছেন। আর জনি হোসেন অষ্টম শ্রেণি পাস করেছেন। হিজড়া হওয়ার কারণে কোনো চাকরির কথা ভাবতেই পারেননি। এই দুজনের জীবনেই আজ ঘটে গেছে অভাবনীয় ঘটনা। রাজশাহী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে তাঁরা সরকারি চাকরিতে যোগদান করেছেন। মারুফ কম্পিউটার অপারেটর আর জনি অফিস সহায়ক।
মারুফের বাড়ি রাজশাহী নগরের ডিঙ্গাডোবা এলাকায়। তাঁর বয়স ২২ বছর। আর জনির বাড়ি কাঁঠালবাড়িয়া মহল্লায়। জনির পুরো নাম মো. জনি হোসেন। তাঁর বয়স ৩০ বছর। মারুফের নামের আগে পিছে আর কিছু নেই, শুধুই মারুফ।
মারুফ জানান, তিনি এসএসসি পাস করার পর ২০১৯ সালে রাজশাহী সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা ইন ইলেকট্রোমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছেন। এর মধ্যে কম্পিউটারের ‘অফিস অ্যাপ্লিকেশন’–এর ওপরও একটি কোর্স করেছেন। তারপর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন। সেখানে তাঁর মেয়েলি স্বভাবের কারণে সহকর্মীরা হাসাহাসি করতেন। এতে নাকি পরিবেশ নষ্ট হচ্ছিল। এই অভিযোগে তাঁকে চাকরি থেকে বাদ দেওয়া হয়। তারপর করোনার মধ্যে বসে ছিলেন। তিনি বলেন, এবার রাজশাহী জেলা প্রশাসক মহোদয়ের কারণে সরকারি অফিসে কাজ পেয়েছেন। নতুন কর্মদিবসের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে মারুফ বলেন, ‘নতুন চাকরিতে খুব ভালো লাগছে। এখানে স্যারেরা খুব ভালো, অনেক বেশি সহায়তা করেছে। আজ প্রথম দিন খুব ভালো লাগছে।’
জনি হোসেন বলেন, ‘প্রথম দিনে খুব ভালো লাগছে। স্যাররাও অনেক ভালো। কথাবার্তাও অনেক ভালো। স্যাররাও অনেক হেল্প করছেন। প্রথম দিনে হালকা কিছু কাজ করেছি। খাতাপত্র কোথায় কীভাবে রাখতে হবে, নাস্তা পরিবেশন করা—এসব কিছু করেছি।’
জনি এর আগে কিছু করতেন না। খাওয়াদাওয়া কীভাবে করতেন, জানতে চাইলে জনি বলেন, ‘খাওয়াদাওয়ার কথা আর কী বলব, বলার ভাষা নেই। বাসা থেকে কোনো এক বেলা খেতাম। এখানে ওখানে যেতাম। কখনো খেয়ে, কখনো না খেয়েই দিন চলে গেছে। এখন এই চাকরি পেয়ে কতটা ভালো লাগছে, সেটা ভাষায় প্রাকাশ কারতে পারব না। এটা বাস্তব, না স্বপ্ন দেখছি—এখনো বুঝতে পারছি না।’
রাজশাহীতে হিজড়াদের সংগঠন দিনের আলোর সভাপতি মোহনা বলেন, ‘আমরা চাই আমাদের যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরির ব্যবস্থা হোক। এটির মাধ্যমে দেশে প্রথম সরকারি অফিসে হিজড়াদের যাত্রা শুরু হলো। এটি একটি মডেল হিসেবে কাজ হবে। আমরা চাই এই দৃষ্টান্ত দেখে এখন থেকে সব অফিস যেন এভাবে আমাদের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজের ব্যবস্থা করে দেয়।’
গত শনিবার রাজশাহী জেলা প্রশাসনের এক সভা চলাকালে হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনযাপনের করুন চিত্র তুলে ধরে তাৎক্ষণিকভাবে রাজশাহী জেলা প্রশাসক মো. আবদুল জলিল এই দুজনকে চাকরি দেওয়ার উদ্যোগ নেন।
জেলা প্রশাসক বলেন, রাজশাহীতে প্রকৃত হিজড়াদের শনাক্ত করে পর্যায়ক্রমে যোগ্যতানুসারে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। তাঁদের মধ্যে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে (মাস্টার রোলে) দুজনকে চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। একটি বাংলাদেশে প্রথম কি না, তা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও এটা যে একটা যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত, তা বলা যায়।