রায়হান কাওসার: নিভৃত গ্রাম থেকে জনারণ্য ঢাকা শহরে আমার আগমন পড়াশুনার উদ্দেশ্যে। ইন্টারমিডিয়েট পাশের পরে। এর আগে কখনও ঢাকায় আসা হয়নি। এখানে আসার আগে ভাবতাম গ্রামের লোকগুলোই সবচেয়ে বদমায়েশ আর খারাপ। কোনটা ন্যায় আর কোনটা অন্যায়- সেটি বোঝার ক্ষমতাই নাই তাদের, শুধু নিজেরটা পেলেই হলো। অনেকদিন রাতের বেলা দেখেছি, পাশের বাড়ির লোকজন বিল থেকে অন্যের ক্ষেত থেকে ধান গাছের শুকনা লাড়া চুরি করে আনত সকালে খেজুরের রস জ্বাল দেওয়ার জন্য। কয়েকজনকে দেখতাম, তারা রোজা থেকে দুপুরবেলা অন্যের ক্ষেতের পাকা পেপে চুরি করে নিয়ে আসত। জানিনা সেটি দিয়ে তারা সন্ধ্যায় ইফতার করত কিনা। জানিনা, এটি তাদের স্বভাবের দোষ, না অভাবে স্বভাব নষ্ট।
দেখেছি গ্রাম্য সালিশে মোড়লদের দেওয়া বেধম পিটুনি। পিটুনি দেওয়ার হক তাদের আছে। কেননা তাঁরা বিচারক, এলাকার মোড়ল যেন-তেন কথা নয়। গ্রামে যাদের লাঠি বেশি তারাই বিচারক, শিক্ষা-দীক্ষা- সে পরে দেখা যাবে। প্রেম ঘটিত কোন সালিশ বসলে তো কথাই নেই। পাইছি তোগো। অভিযুক্ত ছেলে-মেয়েগুলিকে পিতা-মাতা কিংবা কাছের লোকজনের সামনে যেসব অশ্লীল প্রশ্ন করা হতো তা সত্যি বিব্রতকর।
যাই হোক, ঢাকা শহর গ্রামের চেয়ে ঢের ভাল হবে, সেখানে সব শিক্ষিত লোকের আবাস। একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব। সুতরাং সেখানে কিছুটা ন্যায়-নীতি থাকবে সেটাই প্রত্যাশিত। ঢাকায় আসলাম। এলাকার এক ভাই বললেন, “হলে উঠবা? তোমাকে হলে তুলে দেই”। আমি বললাম, “তাই নাকি, পারবেন? আমি রাজি”। আমার মেরিট পজিশন ভাল ছিল, ভাবলাম কোন স্যারকে রিকোয়েস্ট করে হয়ত হলে তুলে দিবে। সেই ভাইয়া বললেন, হলের ৩৫০ নং রুমে গিয়ে অমুক ভাইয়ের সাথে দেখা কর। সে তোমাকে হলে তুলে দিবে। আমি বললাম, সে তো নিজেই ছাত্র সে কিভাবে আমাকে হলে তুলবে? আমার এলাকার ভাই বললেন, “আরে বোকা, এরাই হলের হর্তা-কর্তা। প্রভোস্ট আর হাউস টিউটররা এখানে ছাত্র ওঠায় না, ওরাই তোকে ওঠাবে। কাউকে গোনার টাইম নাই। তোকে যে গণরুমে দিবে সেখানে থাকবি, ক্লাস করবি আর মাঝে মাঝে রাতে গেস্টরুমে ডাকলে যাবি- এটাই তোর কাজ। এখন যা”।
গেস্টরুমে কত অছাত্র-সদৃশ ছাত্র সহজ-সরল ছাত্রদের কত ভাবেই না ম্যানার শেখাত। তারা বলতেন, গেস্টরুম হলো ম্যানার শেখানোর উত্তম একটি জায়গা। হলে নতুন উঠেছি। একদিন দুগ্রুপে মারামারি লাগল। আমাদের বড় নবাবজাদারা সামনে ছিল। অন্য গ্রুপের ধাওয়া খেয়ে নবাবগুলো লক্ষণসেনের মতো লেজগুটিয়ে দিল দৌড়। আমার হাতে ছিল ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প। ওরে বাবা, পালাই। স্ট্যাম্প ফেলে দে দৌড়। হলের মাঠে ঝাউ গাছের জঙ্গলের মত এক ঝরনের গাছ ছিল। তার মধ্যে লুকালাম। সেদিন থেকে বোধদয় হলো রাজনীতি করা বেশ রিস্কি। আমি এর মধ্যে নাই। যেদিন শুনতাম যে হলে মারামারি হবে, সেদিন অন্য হলে চলে যেতাম।
হলের প্রভোস্ট মহাশয় নবাবী বাংলো নিয়ে বেজায় খুশি, ছাত্রদের খোঁজ খবর নেওয়ার সময় নেই তাঁর। শুধু এসে ডকুমেন্ট সাইন করেন, আর হলে কোন দিন গ্যানজাম হলে তবে আসতেন। এটুকুই। আর হাউস টিঊটরগুলি কোয়ার্টার পেয়ে হন নবাবের উজির। আয়েশ আর আয়েশ। প্রভোস্ট মহাশয়কে চেনা যেত অন্তত। কিন্তু অনেক হাউস টিউটরকে আমরা চিনতামও না। এছাড়াও দেখতাম অনেকেই হলের ছাত্র নন, বহিরাগত,তারা হলে থাকতেন হলের অছাত্র সদৃশ ছাত্রদের ছত্রছায়ায়, ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে অনেক আগে অথচ হলে আছেন দিব্যি। এই হলো এখানকার নীতি।
একটি শীর্ষস্থানীয় বিদ্যাপিঠের শিক্ষক, প্রশাসন এবং ছাত্রনেতাদের এই হলো নীতি। এরপর ইচ্ছা না থাকলেও ভাগ্যের ভেলায় চড়ে আসতে হলো সুপ্রিম কোর্টে। কয়েকদিন আগে বার মিলনায়তনে একজন মোটামুটি বয়োজ্যেষ্ঠ আইনজীবী ভরা মজলিসে আক্ষেপ করে বললেন, “একজন জুনিয়র আইনজীবী কিউবিকলস পায় অথচ আমি পাইনা”। আরেকদিন অন্য একজন বয়োজ্যেষ্ঠ আইনজীবী হল রুমে বসে গল্প করতে করতে বলছিলেন, “অমুক সেক্রেটারি-প্রেসিডেন্টের সময় আবেদন করেছিলাম। দেয়নি। জুনিয়র অনেকেই পেয়েছে”। আবার অনেকেই কোর্টে রেগুলার না তবুও তারা রুম পেয়েছেন, অথচ আমি পাইনি”। মনের কষ্টে তিনি এখন আর কিউবিকলস এর জন্য আবেদনই করেন না।
গ্রামে থাকতে ভাবতাম, গ্রামের লোকগুলিই সবচেয়ে বেশি খারাপ। বিশ্ববিদ্যালয়ের এসে দেখি যারা নীতি আর জ্ঞানের আলো ছড়ানোর কাজে নিয়োজিত তারা আরও বেশি নীতিহীন, নীর্বিকার। আইন অঙ্গনে এসে উপলব্ধি হলো- “Common People are everywhere in chain”. “Humans are everywhere but conscience is nowhere”.
সুপ্রিমকোর্ট অঙ্গণে পদচারণা খুব বেশি দিনের নয়। অল্প দিনের পদচারণায় খেয়াল করে দেখছি সর্বোচ্চ এই বিচারালয়ের অনেক কিছুই হচ্ছে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়, অন্যরা থাকছেন ধোঁয়াশায়। আইনজীবীদের কিউবিকলসগুলির বন্টনও হচ্ছে অস্বচ্ছভাবে। বিশেষ বিশেষ সম্মানীয় ব্যক্তিবর্গের সদয় ও বিশেষ বিবেচনায় কিউবিকলসগুলি বরাদ্দ দেওয়া হয়- এমন অভিযোগ অনেক আইনজীবীর নিকট থেকেই শুনি। কেনই বা এখানে স্বচ্ছতা আসবে? সর্বোচ্চ বিচারালয়ের অনেক কিছুই তো হচ্ছে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়।
সাধারণ জনগণনের ইচ্ছার প্রতিফলন যদি সংবিধান হয়ে থাকে আর সংবিধানের রক্ষক যদি সুপ্রিম কোর্ট হয়ে থাকে, তাহলে এই বিচারালয়ের অনেক বিষয়েই স্বচ্ছতা আনা জরুরী। এর মধ্যে আইনজীবীদের নিজেদের মধ্যে কিউবিকলস বন্টনে স্বচ্ছতা আনয়ন হলো অন্যতম।
কিউবিকলস বন্টনের ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়নতা ও যৌক্তিকতার ভিত্তিতে একটি লিখিত নীতিমালা থাকা দরকার যেখানে একটি কিউবিকলস বরাদ্দের ক্ষেত্রে একজন আইনজীবীর সিনিয়রিটি, প্র্যাকটিসিং রেকর্ড ও অন্যান্য পজিটিভ ইন্ডিকেটরগুলি বিবেচনা করে যেন তা বন্টন করা হয়। যাতে শুধুমাত্র বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিবর্গের খুব কাছের আইনজীবীরা কিউবিকলস পাবেন এবং সিনিয়র প্র্যাকটিসিং আইনজীবীরা কিউবিকলস পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবেন- সেটি যেন না হয়। তাঁদের দীর্ঘশ্বাস যেন আমাদের আর দেখতে না হয়।
লেখক- আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।
ইমেইলঃ raihankawsardu@gmail.com