এখন থেকে আমদানি-রপ্তানির নামে বিদেশে টাকা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। আদালতে টাকা পাচারের ঘটনা প্রমাণিত হলে পাচারকারীদের জেল-জরিমানা হবে।
এ বিষয়ে প্রচলিত আইনকে কার্যকর করা হয়েছে। এ আইন গত ১০ মার্চ থেকে আগামী ২০২৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় ছয় বছর কার্যকর থাকবে। একই সঙ্গে এই আইন প্রয়োগে বাড়ানো হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা।
বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইনের বেশ কিছু ধারা ওই দিন থেকে কার্যকর করে এ আইন প্রয়োগের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ আইনে বলা হয়েছে- সরকার সময় সময় গেজেট প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে অত্র আইনের আওতায় সংঘটিত অপরাধগুলোকে আমলযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করতে পারবে। এর জন্য নির্দিষ্ট সীমারেখাও ঘোষণা করতে পারবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল ইসলাম বলেন, এতবড় একটি আইন থাকতে এটি টাকা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবহার করা হয়নি। আইনটি যেহেতু এখন কার্যকর করা হয়েছে সেই কারণে এটি কঠোরভাবে প্রয়োগ করা উচিত। তাহলে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে দেশ থেকে টাকা পাচারের প্রবণতা কমে যাবে।
তিনি আরও বলেন, এ বিষয়ে এখন যেহেতু কেন্দ্রীয় ব্যাংক ক্ষমতা পেল সেই কারণে তাদেরও এটি কঠোরভাবে প্রয়োগ করা উচিত। তাহলে টাকা পাচারকারীরা আইনের আওতায় আসবে। অন্যদের কাছেও একটি বার্তা যাবে।
তিনি এ আইনকে কোনো সীমায় না রেখে সব সময়ের জন্য কার্যকর রাখার প্রস্তাব করেছেন। এতে আইনের সমান ও সব পক্ষের ক্ষেত্রে প্রয়োগ হবে।
সূত্র জানায়, সরকার থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করে আলোচ্য আইনের আওতায় সংঘটিত অপরাধগুলোকে আলমযোগ্য ঘোষণা না করলে তা আমলে আনা যাবে না। সাম্প্রতিক সময়ে দেশ থেকে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে টাকা পাচারের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে এ ধরনের ঘটনা উদঘাটিত হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক আইনের ধারাগুলোর আওতায় সংঘটিত অপরাধগুলোকে আমলযোগ্য ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারির প্রস্তাব করে।
এর আলোকে গত ১০ মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে প্রজ্ঞাপন জারির দিন থেকেই আলোচ্য অপরাধগুলো আমলযোগ্য হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এ প্রজ্ঞাপনটি পেয়ে গত সোমবার রাতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একটি সার্কুলার জারি করে বিষয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো হয়েছে।
এতে শুধু বলা হয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৪৭-এর ২৩(১) ধারায় বর্ণিত শাস্তিযোগ্য অপরাধসমূহ প্রজ্ঞাপন জারির (১০ মার্চ) দিন থেকে আগামী ২০২৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমলযোগ্য বলে বিবেচনা করা হবে।
বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী, যে কেউ যদি এ আইনের কোনো ধারা বা এ আইনের কোনো বিধি বা এ আইনের কোনো নির্দেশনা লঙ্ঘন করে বা লঙ্ঘনে সহায়তা করে, তবে অন্য আইনে বা এ আইনের অন্যধারায় যা-ই থাকুক না কেন, অপরাধীকে সর্বোচ্চ সাত বছরের জেল বা জরিমানা করা হবে। অথবা উভয় ধরনের শাস্তি দেয়া যাবে।
এর আওতায় দেশ থেকে পণ্য রপ্তানি করে তার মূল্য নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বা বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্ধিত সময়ের মধ্যে দেশে না আনলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে। একই সঙ্গে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলে এর মূল্য পরিশোধ করার পর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বা বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্ধিত সময়ের মধ্যে পণ্য দেশে না আনলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে।
এ ধরনের অপরাধকে আমলযোগ্য করার আগে কেন্দ্রীয় বাংক সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক ব্যাংক বা গ্রাহকের মাধ্যমে বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে আমদানি পণ্য দেশে না আনা বা রপ্তানি পণ্যের মূল্য দেশে না আনার বিষয়টি নিশ্চিত হতে হবে। এরপর গ্রাহককে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে।
এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি নিশ্চিত হয় যে, গ্রাহক আমদানির পণ্য দেশে না এনে বা রপ্তানির মূল্য দেশে না এনে টাকা পাচার করেছে তাহলে সংশ্লিষ্ট আমদানিকারক বা রফতানিকারকের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবে বা সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে মামলা করার নির্দেশ দিতে পারবে। একই সঙ্গে এই অপরাধ সংঘটনের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধেও মামলা করতে বা মামলা করার নির্দেশ দিতে পারবে।
সূত্র জানায়, আমদানি-রপ্তানির আড়ালে দেশ থেকে যে টাকা পাচার হয় তার পুরোটাই ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে। ফলে সব ধরনের রেকর্ডপত্র ব্যাংকের কাছে থাকে। এতে এ ধরনের অপরাধ স্বল্প সময়ের মধ্যেই আদালতে নিখুঁতভাবে প্রমাণ করা যাবে। এতে টাকা পাচারকারীদের শাস্তি দ্রুত নিশ্চিত করা যাবে। আলোচ্য আইনের আওতায় সংঘটিত অপরাধগুলোকে আগে গেজেট জারির মাধ্যমে আমলযোগ্য ঘোষণা না করায় এগুলোর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি। এখন নেয়া সম্ভব হবে।
এ ধরনের অপরাধের বিপরীতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে বিভিন্ন আদালতে প্রায় ১২ হাজার মামলা দায়ের করা হয়েছে। কিন্তু আইনটি কার্যকর না করায় সেগুলোর নিষ্পত্তি হচ্ছে না বা খারিজ হয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে এ ধরনের অপরাধের দায়ে ব্যাংক মামলা করতে চাইলে আদালত আমলে নিতেও অসম্মতি জানাচ্ছে।
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- বাংলাদেশ থেকে বছরে গড়ে ৬৪ হাজার কোটি টাকা আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের আড়ালে পাচার হচ্ছে।