পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রথম টার্গেট ছিল পুলিশ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরেই রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে পাকিস্তানি সেনারা হামলা চালায়। তখন রুখে দাঁড়িয়েছিলেন রাজারবাগের পুলিশ সদস্যরা। হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গড়ে তুলে ছিলেন প্রথম প্রতিরোধ।
এরমধ্যে পুলিশ সদস্য শাহজাহান মিয়া পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের খবর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। আর বাঙালি পুলিশ সদস্যদের জন্য অস্ত্রাগার খুলে দিয়েছিলেন আবু সামা। পাগলা ঘণ্টা বাজিয়ে সবাইকে সতর্ক করেছিলেন আবদুল আলী।
পাকিস্তানি বাহিনীর আকস্মিক হামলা প্রতিরোধ করতে গিয়ে ওই রাতে রাজারবাগেই জীবন দিয়েছিলেন প্রায় ১৫০ জন পুলিশ সদস্য। বন্দি হয়ে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন আরও শতাধিক। সব মিলিয়ে ২১০ জন পুলিশ সদস্য প্রথম দিনেই শহীদ হয়েছিলেন।
পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, রাত পৌনে ১২টার দিকে পাকিস্তানি সেনারা রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে আক্রমণ শুরু করে। আক্রমণের পর পুলিশ সদস্যরাও থ্রি-নট-থ্রি রাইফেলের গুলি চালিয়ে পাল্টা জবাব দেয়। আর এতেই শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ।
রাত সাড়ে ১২টার দিকে রাজারবাগের পুলিশ সদস্যরা কৌশল বদলে গেরিলা স্টাইলে আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকে। পাল্টা আক্রমণে হতভম্ব হয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনারা। পরে আরও শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। রাত সাড়ে তিনটার দিকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস দখল করে নেয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। বন্দি হয় দেড় শতাধিক পুলিশ সদস্য।
রাজারবাগে হামলার খবর পেয়ে সারাদেশে বাঙালি পুলিশ সদস্যরা পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নিজেরা মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি মুক্তিকামী মানুষের হাতে তুলে দেন তাদের কাছে থাকা অস্ত্র ও গোলাবারুদ। আর এ কারণে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি ও শহীদ হতে হয়েছিল ডিআইজি থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ের সহস্রাধিক পুলিশ সদস্যকে।
একজন ডিআইজি ও চারজন পুলিশ সুপারসহ বিভিন্ন পদবীর ১১শ’রও বেশি পুলিশ সদস্য শহীদ হন মহান মুক্তিযুদ্ধে। আহত ও পঙ্গুত্ব বরণ করেন আরও অনেকে। প্রায় ১৪ হাজার পুলিশ সদস্য মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন বলে জানা যায়।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগের ওয়্যারলেস অপারেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন কনস্টেবল বীর শাহজাহান মিয়া। পরে তিনি সাব ইন্সপেক্টর হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে অবসরে যান।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসসহ রাজধানী ঢাকা আক্রান্ত হওয়া এবং বাঙালি পুলিশ সদস্যদের প্রতিরোধের বার্তা বেতার মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এজন্য শাহজাহান মিয়া পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নির্মম নির্যাতনেরও শিকার হয়েছিলেন। পরে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস ১১ নম্বর সেক্টরের বিভিন্ন এলাকায় বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন তিনি।
এখনও বেঁচে আছেন শাহজাহান মিয়া। এখন পর্যন্ত কোনও রাষ্ট্রীয় খেতাব না পাওয়ায় খানিকটা মনোকষ্টে ভুগলেও খুব বেশি আক্ষেপ নেই তার। বুধবার (২৪ মার্চ) গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, পাকিস্তানি বাহিনীর হামলার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি পুলিশ সদস্যরাও পাল্টা আক্রমণ করে। বিলম্ব না করে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সকল বিভাগ ও জেলা শহরের পুলিশ স্টেশনগুলোতে একটি মেসেজ পাঠিয়ে দেন। মেসেজটা ছিল- ‘ওভার-বেইজ ফর অল স্টেশন্স অব ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ, কিপ লিসেন অ্যান্ড ওয়াচ, উই আর অলরেডি অ্যাটাকড বাই পাক আর্মি। ট্রাই টু সেভ ইয়োরসেলভস, ওভার।’
পরদিন ২৬ মার্চ ভোর পাঁচটার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী তাকে আটক করে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তার ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। বিভিন্ন সম্মাননা পেলেও এ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় কোনও খেতাব পাননি তিনি।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে অন্যান্য পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে রাজারবাগে দায়িত্ব পালন করেছিলেন পুলিশের স্পেশাল আর্মড ফোর্সের (এসএএফ) কনস্টেবল মো. আবু সামা। তিনি ওইদিন রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের অস্ত্রাগারের দায়িত্বে ছিলেন। বুধবার (২৪ মার্চ) গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর আগমনের খবর পেয়ে তিনি একটি অস্ত্রাগারের তালা খুলে দেন পুলিশ সদস্যদের। আরেকটি অস্ত্রাগারের তালা শাবল দিয়ে ভেঙে ফেলেন। পরে সেখান থেকে যে যার মতো রাইফেল, বেটা গান ও গুলি নিয়ে প্রতিরোধে এগিয়ে যায়। তিনিও আজ পর্যন্ত কোনও রাষ্ট্রীয় খেতাব পাননি।
পুলিশ সদর দফতরের জনসংযোগ বিভাগের এআইজি মো. সোহেল রানা গণমাধ্যমকে বলেন, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে দেশ ও মানুষের জন্য অকাতরে জীবন উৎসর্গ করে পুলিশ বাহিনী সেদিন দেশপ্রেমের অনন্য ইতিহাস রচনা করেছিল। সেই মহান বীর মুক্তিযোদ্ধা পুলিশ সদস্যদের জন্য বাংলাদেশ পুলিশ আজও গর্বিত। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই মাহেন্দ্রক্ষণে তা উদযাপনে নানা আয়োজন করেছে বাংলাদেশ পুলিশ।
সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন