এস এম নাজির আহম্মেদ :
(ক) ধর্ষিতা বা তার অভিভাবক ধর্ষকের শাস্তি চায় না:
এখনো আমাদের সমাজে অসংখ্য মানুষ আছে যারা ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ করতে সঙ্কোচ বোধ করে। ধর্ষিতা সমাজে মুখ দেখাতে লজ্জা বোধ করে বিধায় প্রকাশ করে না। অভিভাবক কন্যার বিয়ে বা ভবিষ্যৎ চিন্তা করে নীরব থাকে। এসব কারণে না চাইতেই ধর্ষক শাস্তি থেকে পরিত্রাণ পেয়ে যায়। অবশ্য এ জন্য আমাদের সমাজ ব্যবস্থাও অনেকটা দায়ী। এখনো অনেকে ধর্ষকের চাইতে ধর্ষিতাকে দায়ী করে তৃপ্তি পান।
(খ) স্থানীয় বিচার ব্যবস্থার আশ্বাস:
ধর্ষিতা যদি অপেক্ষাকৃত গরীব পরিবারের হয় তো কথাই নেই। প্রথমে দ্বারস্থ হতে হয় স্থানীয় সমাজপতিদের। সমাজপতিদের কেউ কেউ প্রায়ই বিষয়টি নিজেরা মিমাংসা করে দেয়ার আশ্বাস দেন। ধর্ষককে হাজির করা, বিচারের দিনক্ষণ ঠিক করা ইত্যাদি কাজে কালক্ষেপণ হতেই থাকে। স্থানীয় মুরুব্বীদের উপর নির্ভর করে এক পর্যায়ে ধর্ষিতা স্বেচ্ছায় ধর্ষণের সব আলামত নিজেই ধ্বংস করে ফেলে। যেমন, গোসল করে পাক পবিত্র হয়ে নেয়। জামা কাপড় উত্তমরূপে ধৌত করে পরিস্কার হয়ে অঘটনের সব স্মৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা করে। কয়েক দিন যাবার পর হয়তো স্থানীয় মাতব্বরেরা বিচার করে ধর্ষককে কিছু শাস্তি দেয় যা আইনে বর্ণিত শাস্তির ধারে কাছেও যায় না। অথবা বিচার করতে অস্বীকার করে বা অসম্মতি জানায় বা অপারগতা প্রকাশ করে দায়িত্ব শেষ করে। তখন ধর্ষিতা বা অভিভাবক চাইলেও আর ধর্ষণের বিচার পান না। কারণ, ততক্ষণে ধর্ষণ প্রমানের জন্য ডাক্তারী পরীক্ষায় পাওয়া যেতে পারে এমন সব আলামত গায়েব হয়ে গেছে। বাকী আছে শুধু ধর্ষিতার মৌখিক সাক্ষ্য। যার উপর নির্ভর করে ধর্ষণের শাস্তি নিশ্চিত করা দুঃসাধ্য। শুধুমাত্র মৌখিক সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করে ধর্ষণ মামলায় অভিযুক্তের শাস্তি হলে অনেক পুরুষকে প্রতিপক্ষের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে এখন জেলের ঘানি টানতে হতো। যেটা কারো কাম্য হতে পারে না।
(গ) দুর্বৃত্তঘেরা সমাজ ও স্থানীয় বিচার ব্যবস্থা:
অনেক সময় ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশের পর ধর্ষক দুর্বৃত্তের আশ্রয় নেয়। সমাজ নিয়ন্ত্রণকারী অনেকে ধর্ষকের পক্ষ নিয়ে থাকেন। কেউ কেউ তরুণ ধর্ষককে ছেলে মানুষের সামান্য ভুল হিসেবে আখ্যায়িত করতে চেষ্টা করেন। কখনো ধর্ষকের সামাজিক শাস্তি হয় কয়েকটি জুতার বাড়ী। প্রকাশ্য রাস্তায় নিজের থুতুর উপর দিয়ে নাকে খত, ইত্যাদি। কখনো অভিভাবকের জরিমানা। আর জরিমানার ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে মাঝে মধ্যে পত্র পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ হতে দেখা যায়।
(ঘ) ধর্ষকের দলীয় পরিচিতি:
ধর্ষকের দলীয় পরিচিতি অনেক সময় বিচার প্রাপ্তির অন্তরায় হয়ে দাড়ায়। দলের মান রক্ষায় কেউ কেউ ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কখনো ধর্ষিতা বা অভিভাবক বিচার চাইতে সাহস পায় না। নইলে দলীয় পরিচিতি ব্যবহার করে বা ক্যাডার লেলিয়ে দিয়ে বিচারপ্রার্থীকে পিছু হটতে বাধ্য করা হয়। তবে মিডিয়া সাহস করে ইতিবাচক ভুমিকা রাখলে দলীয় বড় মিয়ারাও নিজেদের সাধু প্রমাণে ধর্ষকের শাস্তির পক্ষে কথা বলতে শুরু করেন। মিডিয়ার কল্যাণে অনেক ধর্ষণকারীকে বিচারের কাঠগড়া পর্যন্ত নিতে পারলেও সময়ক্ষেপণ হেতু আলামত এবং সাক্ষ্য বিনষ্টের কারণে প্রায়ই শাস্তি নিশ্চিত করা যায় না।
(ঙ) সামাজিক বৈষম্য:
গরীবের বউ সকলের ভাবী। কখনো কখনো ধনীর দুলালী ধর্ষিতা হলে ধনিক শ্রেণী জোটবদ্ধ হয়ে বিচারে ইতিবাচক ভুমিকা রাখে। আর ধনীর দুলাল যদি গরীবের বউ-মেয়েকে ধর্ষণ করে তখনকার চিত্র আর আগের মত থাকে না। অনেক সময় গরীবের বিচার চাইতে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়। হাজার খানেক গরীব এক হয়ে কয়েকজন ধনীর বিপক্ষে দাড়াতে পারলেও মেরুদন্ড বেশীক্ষণ সোজা রাখা সম্ভব হয় না।
(চ) আইন প্রয়োগকারী সংস্থার গাফিলতি:
কখনো কখনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক ধর্ষণের অভিযোগ গ্রহণ সহ সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে গড়িমসি করার তথ্য মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়। যা বিচার প্রক্রিয়ায় দারুণ বিরূপ প্রভাব ফেলে। এমনকি ইচ্ছাকৃত বা অদক্ষতাজনিত কারণে দুর্বল তদন্তের ফলাফলও ধর্ষকের পক্ষে চলে যায়। কখনো অজ্ঞাত কারণে সামান্য কিছু লোক ধর্ষকের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বিচার প্রক্রিয়া ভন্ডুল করে বলেও অভিযোগ ওঠে।
(ছ) বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ্যসূত্রীতা:
বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতার কারণেও অনেক সময় ধর্ষক বাদীপক্ষকে আয়ত্বে নিতে সক্ষম হয়। তা কোন কিছুর বিনিময়ে হোক কিংবা কৌশলে বাদী পক্ষের সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমেই হোক। কখনো কখনো বাদীপক্ষ আদালতে ঘুরাঘুরিতে বিরক্ত হয়েও বিচার প্রক্রিয়া থেকে সরে দাড়ায়।
(জ) বিচারহীনতা থেকে হতাশা:
এদেশে ধর্ষকের উল্লাস অনেকেই দেখেছে। অনেক আলোচিত ঘটনার ধর্ষককেও কোন না কোন উপায়ে আইনের ফাঁক ফোঁকর গলে মুক্তি পেতে দেখা যায়। যার শাস্তি নিশ্চিত বলে প্রকাশ পায় তাকেও এক সময় বুক ফুলিয়ে চলতে দেখে মানুষ। ধর্ষণ ঘটনার ইত্যাকার অনেক নেতীবাচক অভিজ্ঞতা বিচারপ্রার্থীকে হতাশ করে। এসব কারণে কখনো বিচারপ্রার্থী বিচার চায় না। কখনো বিচার প্রক্রিয়ার কোন পর্বে হাত গুটিয়ে সরে দাড়ায়।
পরিশেষে বলা যায়, মামলার বিচারের জন্য সর্বপ্রথম “ধর্ষণ” প্রমাণিত হওয়া আবশ্যক। ধর্ষণ প্রমাণের মূল উপাদান হচ্ছে বস্তুসাক্ষ্য বা আলামত। ঘটনাস্থল এবং ধর্ষিতার দেহ বা পরিধেয় কাপড়ে আলামত বেশী পাওয়া যায়। যেমন, ধর্ষকের বীর্য, মুখের লালা, ধর্ষিতা কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে কখনো ধর্ষকের রক্ত, ধর্ষকের পরিধেয় কাপড়ের অংশ বিশেষ বা আঁশ, চুল, গুপ্তাঙ্গের পশম ইত্যাদি পাওয়া যেতে পারে। ধর্ষিতার দেহে কামড়ের দাগ, আঘাত, ক্ষত ইত্যাদি সহ ধর্ষণের ফলে শারীরিক অন্যান্য পরিবর্তন হতে পারে। অপরাধ সংঘটনের পর যত দ্রুত ভিকটিমকে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পুলিশের আশ্রয়ে নেয়া যাবে বিচার প্রাপ্তি ততটা নিশ্চিত হবে বলে বিশ্বাস রাখতে হবে। তদন্তকারী অফিসার কর্তৃক পরিদর্শণ ও আলামত সংগ্রহ করার পূর্ব পর্যন্ত ঘটনাস্থল সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। একটু কষ্ট হলেও ভিকটিমের পরিধেয় কাপড় চোপড় সংরক্ষণ করতে হবে। দেহ থেকে আলামত সংগ্রহ বা ডাক্তারী পরীক্ষার পূর্বে যেন গোসল করা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
স্থানীয় শালিসীর আশ্বাস বা অন্য কোন কারণে আইনের আশ্রয় নিতে বিলম্ব করলে বিচার প্রাপ্তি অনিশ্চিত বলে ধরে নিতে হবে। অর্থাৎ অবিলম্বে আইনের আশ্রয় নেয়ার পরামর্শ রইল।
সকল ধর্ষণের বিচার হোক এ প্রত্যাশা নিরন্তর।
তবে ‘‘ধর্ষণ’’ যেন প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার “অস্ত্র” না হয় সেদিকে যত্নবান হওয়া প্রতিটি নাগরিক, সাক্ষী, পুলিশ, এ্যাডভোটেক, মিডিয়া সহ সকলের পবিত্র দায়িত্ব।
লেখকঃ পুলিশ পরিদর্শক,বাংলাদেশ পুলিশ।