এম. এ সাঈদ শুভ:
একদম অল্পকিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এই সমাজে যাদের হাতেই ক্ষমতা, অর্থ, প্রভাব, প্রতিপত্তি আছে সাধারণত তাদের অধিকাংশই বিনয়ী নয়! তারা বিনয়ী তাদের কাছে যাদের ক্ষমতা, অর্থ, প্রভাব, প্রতিপত্তি তাদের থেকে বেশি; যাদের সামনে বিনয়ী না থাকলে তাদের কথিত ক্ষমতা, অর্থ, প্রভাব, প্রতিপত্তি হারানোর আশঙ্কা থাকে।
আপনি একবার চিন্তা করে দেখুনতো, আপনি যখন তখন কোনো বড় বড় ক্ষমতাধরকে ফোন দিতে পারেন এবং আপনি বলার সাথে সাথে তারা সেভাবে কাজ করেন আপনি যেভাবে চান। সেক্ষেত্রে তথাকথিত সেই ক্ষমতাধরের থেকে অপেক্ষাকৃত কম ক্ষমতাধর কাউকে ধর্তব্যে রাখবেন? আর অপেক্ষাকৃত কম ক্ষমতাধর কেউ যদি আপনার কাছে কোনো কারণে কৈফিয়ত তলব করে তাহলে আপনি তার সাথে কীরূপ আচরণ করবেন?
আবার আপনি যদি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকেন তাহলে আপনি আপনার অধীনস্থ ও তথাকথিত ক্ষমতাহীনদের সাথে কীরূপ আচরণ করেন? কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা তো দেখি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বিনয়ী ও নিরীহ ছেলে বা মেয়েটা কোনো প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ পদে যাওয়ার সাথে সাথে তার চেহারা পরিবর্তন হয়ে যায়। কর্তৃত্ব বহির্ভূত আচরণ ও ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ হয়ে যায়! এমন নয় যে তাদের বিনয় ও নিরীহ চেহারা একদমই থাকেনা। অপেক্ষাকৃত ক্ষমতাধরদের সামনে বিনয়ের প্রদর্শন করতে করতে তারা হয়ে যায় ‘বিনয় মজুমদার অথবা বিগলিত ব্যানার্জী।’
আসলে তারা তাদের বসের সামনে, ক্ষমতাধরদের সামনে কেমন ব্যবহার করেন তার ওপর নির্ভর করে না তারা কতটা বিনয়ী। তারা তো তাদের বস, শক্তিমান আর ক্ষমতাধরদের সামনে নতজানু হয়ে থাকে ভয়ে। ভয়ে নতজানু হয়ে থাকা বিনয়ের বহিঃপ্রকাশ নয়। বরং তারা কতটা বিনয়ী সেটা অনেকাংশে নির্ভর করে তাদের অধীনস্থদের সাথে, অসহায়, বঞ্চিত, মজলুমদের সাথে কেমন ব্যবহার করে তার ওপর। তবে সত্যিকারের বিনয়ীরা সব সময় আনুগত্যশীল ও কৃতজ্ঞ হয়। চিন্তা ও কর্মে সৎ মানুষেরা তাদের বিনয় এবং আনুগত্য তাদের কর্মের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করে থাকে। তারা তাদের অধিনস্থদের সাথে, অসহায়, বঞ্চিত আর মজলুমদের সাথে সদয় আচরণ করেন।
আর তথাকথিত ক্ষমতাধররা অধীনস্থদের সাথে, অসহায়, বঞ্চিত আর মজলুমদের সাথে কেমন আচরণ করে তা খেয়াল করলে বুঝতে পারবেন তারা কতটা ঔদ্ধত্য ও কর্তৃত্ববহির্ভূত আচরণ করে থাকে! এগুলোই নির্মম বাস্তবতা! এই সমাজও সেভাবেই গড়ে উঠেছে। একজন সৎ, নিষ্ঠাবান কর্মকর্তাকে সমাজ অতটা মূল্যায়ন করেনা। একই পদবীর দুজন সৎ আর অসৎ কর্মকর্তার জীবনে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। অধিকাংশ ক্ষেত্রে একজন সৎ, নিষ্ঠাবান কর্মকর্তাকে তার সমাজ, খোদ পরিবার, আত্মীয়স্বজন অতটা মর্যাদার চোখে দেখেনা।
কেননা সেই সৎ কর্মকর্তা অবৈধ অর্থ-বিত্ত দিয়ে পরিবার, আত্মীয়স্বজন, সমাজকে সন্তুষ্ট করতে পারেননা। বিবেক ও দায়িত্ববোধের কারণে চাইলেই অবৈধভাবে আত্মীয়স্বজনদের চাকরী দিতে পারেননা, অবৈধ সুযোগসুবিধা দিতে পারেনা, চাইলেই মসজিদ, মন্দিরে লক্ষ লক্ষ টাকা দান করতে পারেননা। একজন সৎ কর্মকর্তা চাইলেই জাগ্রত বিবেকের কারণে অবৈধ ক্ষমতা ও প্রভাব বিস্তার করতে পারেননা। সুতরাং সমাজ সেই সৎ ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তাকে পছন্দ করেনা। আর যারা দিনের পর দিন অবৈধ ক্ষমতা ও অবৈধ বিত্ত-বৈভবের মাধ্যমে সমাজকে সন্তুষ্ট করে চলেছে সমাজ তাদেরকেই পূজা করছে! তাহলে কি এসমস্ত ঔদ্ধত্যপূর্ণ, দাম্ভিকদের এই সমাজই তৈরী করছেনা?
আসলে এই সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। প্রকৃত অর্থে এই সমাজ বা তথাকথিত ক্ষমতাধরদের বড় অংশই সত্যিকারের শিক্ষা ও জ্ঞানের আলো থেকে বঞ্চিত। সত্যিকারের শিক্ষা ও জ্ঞান মানুষকে বিনয়ী, সৎ, যোগ্য, উদার ও সাহসী করে তোলে। প্রকৃত শিক্ষা ও জ্ঞানের আলো থেকে যোজন যোজন মাইল দূরে থাকার কারণেই এই সমাজের আজ এই অবস্থা! তবে এই মিথ্যা ক্ষমতাধর ও দাম্ভিকরাও বেশিদিন টিকে থাকেনা! ইতিহাস তাই বলে! আসলে ক্ষমতা, রুপ, যৌবন ভোরের শিশিরের ন্যায় ক্ষণস্থায়ী।
লেখক: জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, নাটোর।