স্বকৃত গালিব :
বাংলাদেশের পুরুষদের একটা বিরাট অংশ বহুদিন ধরে পুরুষ নির্যাতনের জন্য আলাদা আইন প্রণয়নের দাবি উত্থাপন করছে। তাদের দাবি নারী নির্যাতনের জন্য আলাদা আইন থাকলেও বাংলাদেশে পুরুষ নির্যাতনের কোন আলাদা আইন নেই। তারা আরও বলে যে বাংলাদেশে পুরুষদের একটি বিশাল অংশ নারী কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। পুরুষদের নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠন বাংলাদেশ মেন’স রাইটস ফাউন্ডেশন নিজেদের পরিচালিত এক গবেষণায় জানিয়েছে বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ বিবাহিত পুরুষ ‘মানসিক’ নির্যাতনের শিকার। সামাজিক লজ্জার ভয়ে অনেকেই এসব বিষয় প্রকাশ করতে চান না। তাই তাদের মতে বাংলাদেশের বিবাহিত পুরুষদের নারী কর্তৃক নির্যাতন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য জরুরি ভিত্তিতে “পুরুষ নির্যাতন দমন আইন” সংসদে পাশ করা হোক। কিন্তু নারী কর্তৃক পুরুষ নির্যাতনের জন্য আলাদা আইন হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে মামলা করে নারী কর্তৃক পুরুষ নির্যাতনের বিচার পাওয়া সম্ভব।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করার জন্য বাংলাদেশে প্রচলিত কয়েকটি আইন উল্লেখ করা অবশ্যক।
১। দণ্ডবিধি, ১৮৬০
২। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০
৩। যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮
৪। পারিবারিক সহিংসতা নিরোধ আইন, ২০১০
৫| পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫
৬| ফৌজদারী কার্যবিধি ১৮৯৮
দণ্ডবিধি, ১৮৬০ অনুসারে শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হলে পুরুষ কিংবা স্ত্রী যেই হোক এই আইনের মাধ্যমে মামলা করতে পারবে। এই আইনের ৩০২ ধারায় বলা হয়েছে খুনের শাস্তি মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড। ধারা ৩০৬ অনুসারে আত্মহত্যার সহায়তা বা প্ররোচনা দানের শাস্তি ১০ বছর পর্যন্ত শাস্তি হতে পারে। ৩২৩ ধারায় বলা হয়েছে ইচ্ছাকৃতভাবে আঘাত করার সাজা যার শাস্তি হতে পারে ১ বছর ও ১ হাজার টাকা অর্থ দন্ড। ৩২৪ ধারায় বলা হয়েছে ইচ্ছাকৃতভাবে মারাত্মক অস্ত্র কর্তৃক বা বিপদজ্জনক উপায়ে আঘাত করার সাজা যার শাস্তি হতে পারে ৩ বছর পর্যন্ত। ৩২৫ ধারায় বলা হয়েছে ইচ্ছাকৃতভাবে গুরুতর আঘাত করার সাজা যার শাস্তি হতে পারে ৭ বছর পর্যন্ত। ৩২৬ ধারায় বলা হয়েছে ইচ্ছাকৃতভাবে মারাত্মক অস্ত্র কর্তৃক বা বিপদজ্জনক উপায়ে গুরুতর করার সাজা যার শাস্তি হতে পারে যাবজ্জীবন বা ১০ বছর পর্যন্ত। ৩২৬(ক) ধারায় বলা হয়েছে স্বেচ্ছাকৃতভাবে দুইটি চোখ উপড়ে বা এসিড জাতীয় পদার্থ দ্বারা চোখ দুইটির দৃষ্টিশক্তি নষ্ট করা বা মুখমন্ডল বা মস্তক এসিড দ্বারা বিকৃতিকরণ করার সাজা মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন। ধারা ৩৬৩ অনুসারে মনুষ্য হরণের সাজা ৭ পর্যন্ত কারাদন্ড হতে পারে।এই ধারা গুলো অনুসারে শারীরিকভাবে নির্যাতিত পুরুষ কিংবা স্ত্রী মামলা করতে পারবে।এবং কোন নারী যদি কোন পুরুষের বিরুদ্ধে যে কোন মিথ্যা মামলা দায়ের করলে ২১১ ধারা অনুসারে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারবে এবং মিথ্য মামলা দায়ের করার জন্য সেই নারীর ৭ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ অনুসারে কেবল নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হলে মামলা করতে পারবে। পুরুষ এ আইন অনুসারে কোন মামলা করতে পারেনা। নারীদের জন্য দণ্ডবিধিতে প্রতিকার থাকা সত্ত্বেও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা দায়ের করার সুযোগ আছে । এবং কোন নারী যদি কোন পুরুষের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ অনুসারে কোন মিথ্যা মামলা দায়ের করলে ১৭ ধারা অনুসারে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারবে এবং মিথ্য মামলা দায়ের করার জন্য সেই নারীর ৭ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে।
যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮ অনুসারে স্ত্রী এবং পুরুষ উভয়েই মামলা করার অধিকার রাখে। এই আইন অনুসারে বিবাহ বলবৎ রাখার শর্তে বিবাহের যে কোন পক্ষ যদি যৌতুক দাবি করে তাহলে যে কোনো পক্ষই মামলা করার অধিকার রাখে সুতরাং এই আইন অনুসারে নারীরা যেমন মামলা করতে পারবে ঠিক পুরুষও তেমন মামলা করতে পারবে সুতরাং এই আইনের ভিতরে নারী-পুরুষ কোন বৈষম্য নেই।
এই আইনের ধারা ২ এর উপধারা (খ) তে বলা হয়েছে‘‘যৌতুক’’ অর্থ বিবাহের এক পক্ষ কর্তৃক অন্য পক্ষের নিকট বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের পূর্বশর্ত হিসাবে বিবাহের সময় বা তৎপূর্বে বা বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকা কালে, বিবাহ অব্যাহত রাখিবার শর্তে, বিবাহের পণ বাবদ, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, দাবিকৃত বা বিবাহের এক পক্ষ কর্তৃক অপর পক্ষকে প্রদত্ত বা প্রদানের জন্য সম্মত কোনো অর্থ-সামগ্রী বা অন্য কোনো সম্পদ, তবে মুসলিম ব্যক্তিগত আইন (শরিয়াহ্) প্রযোজ্য হয় এমন ব্যক্তিগণের ক্ষেত্রে দেনমোহর বা মোহরানা অথবা বিবাহের সময় বিবাহের পক্ষগণের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব বা শুভাকাঙ্ক্ষী কর্তৃক বিবাহের কোনো পক্ষকে প্রদত্ত উপহার-সামগ্রী ইহার অন্তর্ভুক্ত হইবে না।
যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮, এর যৌতুকের সংজ্ঞা এমনভাবে দেয়া হয়েছে যে বিবাহের যে কোন পক্ষ অপর কোন পক্ষের কাছে যদি কোন টাকা-পয়সা বা অন্য কিছু দাবি করে তবে তা যৌতুক হিসেবে গণ্য হবে । এখানে নির্দিষ্ট করে দেয়নি স্বামী স্ত্রীর কাছে যৌতুক দাবি করলে যৌতুক বলে গণ্য হবে কিনা।
পারিবারিক সহিংসতা আইন, ২০১০ অনুসারে কেবলমাত্র নারী এবং শিশুরাই মামলা করতে পারে। সত্যিকার অর্থে এই আইনের অধীনে মামলা করলে আসামির কোন সাজা হয় না বরং আদালত আসামিকে সহিংসতা বন্ধ করার জন্য একটি আদেশ প্রদান করে। এই আদেশ ভঙ্গ করলেই কেবল তাকে শাস্তি দেওয়া যায় সুতরাং এই আইনটা অনেক দুর্বল আইন। এই আইনে মামলা হয় না বললেই চলে। মূলত বিবাহ বিদ্যমান থাকা অবস্থায় কিভাবে পারিবারিক সহিংসতা রোধ করা যায় এ কথা চিন্তা করেই এই আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল।
সত্যিকার অর্থে পুরুষদের অভিযোগ হলো তারা নারী কর্তৃক শারীরিক নয় বরং মানসিক ভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। মানসিকভাবে নির্যাতিত হলে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে কোনো প্রতিকার না থাকলেও মানসিক নির্যাতনে অবসাদগ্রস্ত ব্যক্তি তার স্ত্রীকে তালাক প্রদান করতে পারে।
পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ অনুসারে স্ত্রী এবং পুরুষ উভয়েই মামলা করার অধিকার রাখে। এই আইনের ৫ অনুসারে যে কোন স্ত্রী পাঁচটি বিষয়ে মামলা করতে পারবে ও পুরুষরা শুধু তিনটি বিষয়ে মামলা করতে পারবে।
বিবাহ বিচ্ছেদ যে কোন পুরুষের স্ত্রীর সাথে বনিবনা না হলে, তার স্ত্রীকে পারিবারিক আদালতে মাধ্যমে তালাক দিতে পারবে। আর পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে তালাক দিলে তালাকের পর স্ত্রীর মামলা দায়েরের সম্ভাবনা কম থাকে।
দাম্পত্য সম্পর্ক পুনরুদ্ধার কোনো বৈধ কারণ ব্যতীত স্ত্রী স্বামীর সংসার ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে আশ্রয় নিলে এবং স্বামীর সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্ক বর্জন করলে স্বামী পারিবারিক আদালতে স্ত্রীকে ফেরত পাওয়ার জন্য মামলা করতে পারেন। তবে এ মামলা শুধু বিয়ে বলবৎ থাকা অবস্থাতেই করতে পারেন। বিয়ে ভেঙে গেলে বা তালাক হয়ে গেলে তা করা যাবে না।
অভিভাবকত্ব স্ত্রীকে তালাকের পর সন্তানের অভিভাবকত্ব নিয়ে মামলা করে,সন্তানের অভিভাবকত্ব ফিরে পেতে পারে।
ফৌজদারী কার্যবিধি ১৯৯৮ অনুসারে স্ত্রী এবং পুরুষ উভয়েই মামলা করার অধিকার রাখে। তবে বিশেষ করে এই আইনের ১০০ ধারা অনুসারে মামলা করে নিজের স্ত্রী সন্তাদের উদ্ধার করে মানসিক শান্তি পেতে পারে।
স্ত্রীর ঘর-সংসার করার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও যদি শ্বশুরবাড়ির লোকজন এতে বাধা দেয় তাহলে ফৌজদারি আদালতের আশ্রয় নেওয়া যায়। ফৌজদারি কার্যবিধি ১০০ ধারার বিধান অনুযায়ী তল্লাশি পরোয়ানার মামলা করে বন্দিদশা স্ত্রীকে থেকে মুক্ত করানো সম্ভব।
তালাকের পর স্ত্রী যদি সন্তানদের তার নিজের কাছে রেখে দেয় তাহলে স্বামী সন্তানদের উদ্ধারের জন্য ফৌজদারি কার্যবিধি ১০০ ধারার বিধান অনুযায়ী তল্লাশি পরোয়ানার মামলা করে বন্দিদশা সন্তানদের মুক্ত করানো সম্ভব।
লেখক: শিক্ষার্থী, স্নাতকোত্তর , আইন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।