মো: তানভীর আহমেদ :
ভোক্তার অধিকার এবং সুরক্ষার ব্যাপারে আমাদের দেশের মানুষের ধারণা এখনো অনেকাংশে কম। সাধারণভাবে একজন ব্যক্তি যিনি ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য কোন পণ্য বা পরিসেবা অথবা উভয়ই ক্রয় করেন, তখন তাকে বলা হয় ভোক্তা। যখনই কোনো পণ্য বা পরিসেবা ক্রয় করা হয়, তখনই সেই পণ্য বা পরিসেবা উপর তার একটি আইনগত অধিকার এবং সুরক্ষা জন্ম নেয়, আর সেই আইনকেই বলা হয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন।
এক কথায় ভোক্তার অধিকার হচ্ছে, ভোক্তা বাজার থেকে কোন পণ্য বা পরিসেবা অথবা উভয়ই ক্রয়ের ক্ষেত্রে বিক্রেতা বা বিক্রেতাদের অনৈতিক এবং অন্যায় আচরণের হাত থেকে রক্ষা করার এবং সঠিক পরিসেবা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা প্রদানের একটি আইনগত কাঠামো। ভোক্তার অধিকার এবং সুরক্ষার ধারণাটি অনেক প্রাচীন। বর্তমান যুগে ভোক্তার অধিকার রক্ষার জন্য প্রায় সকল দেশেই তাদের নিজস্ব আইন আছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভোক্তা সুরক্ষা নির্দেশনা (ডাইরেক টিপস) প্রত্যেকটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশ মানতে বাধ্য, যদিও যুক্তরাজ্য ব্রেক্সিট এর ফলে এটি আওতার বাইরে চলে এসেছে, তারপরেও তাদের নিজস্ব আইন দ্বারা এটি সুরক্ষিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুই স্তরে ভোক্তাদের অধিকার সুরক্ষিত, অর্থাৎ তাদের ফেডারেল আইন এবং রাজ্যগুলির নিজস্ব আইন উভয় আইনেই ভোক্তাদের অধিকার নিশ্চিত করে।
বাংলাদেশ একটু দেরিতে হলেও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ করা হয়। অতি সাম্প্রতিককালে এই আইনের প্রয়োগ বেড়েছে এবং জনগণ তার সুফল পাচ্ছে। জাতিসংঘ স্বীকৃত ভোক্তা অধিকার ৮টি তারমধ্যে নিরাপদ পণ্য বা সেবা পাওয়ার অধিকার, পছন্দের অধিকার, জানার অধিকার,অভিযোগ করা বা প্রতিকার পাওয়ার অধিকার অন্যতম এবং এইগুলি এই আইন দ্বারা ভোক্তাদের অধিকার নিশ্চিত করে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ এর অনেকগুলি ভালো দিক এর মধ্যে একটি হচ্ছে, সঠিকভাবে অভিযোগকারী যদি অভিযোগ করেন এবং অভিযুক্ত ব্যক্তির প্রতি যদি কোন ধরনের অর্থদন্ড প্রদান করা হয়, সেই অর্থের ধারা ৭৬ (৪) এবং (৫) মোতাবেক ২৫ ভাগ পাবে অভিযোগকারী। এই আইন এর চতুর্থ অধ্যায়ের অপরাধ এবং দণ্ডের ব্যাপারে বলা হয়েছে যার মধ্যে অন্যতম ধারা ৪০ ধার্য মূল্যের অধিক মূল্যে পণ্য, ওষুধ বা সেবা বিক্রি করিলে অনূর্ধ্ব এক বৎসর কারাদণ্ড, বা অনধিক পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইতে পারেন, ধারা ৪১ কোন ব্যক্তি জ্ঞাতসারে ভেজাল মিশ্রিত পণ্য বা ঔষধ বিক্রয় করিলে বা করিতে প্রস্তাব করিলে তিনি অনূর্ধ্ব তিন বৎসর কারাদণ্ড, বা অনধিক দুইলক্ষ টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইতে পারেন এবং ধারা ৫১ কোন ব্যক্তি মেয়াদ উত্তীর্ণ কোন পণ্য বা ঔষধ বিক্রয় করিলে বা করিতে প্রস্তাব করিলে তিনি অনূর্ধ্ব একবৎসর কারাদণ্ড বা অনধিক পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইতে পারেন।
কোন অভিযোগকারী মহাপরিচালক, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর অথবা বিভাগীয় উপ-পরিচালক, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর অথবা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর লিখিত ভাবে ঘটনা উদ্বুদ্ধ হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন। এছাড়াও ইমেইলের মাধ্যমে অভিযোগ করতে পারবেন (nccc@dncrp.gov.bd)। জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তরের নিজস্ব ওয়েবসাইটে সকল তথ্যাদি দেওয়া আছে (dncrp.portal.gov.bd)।
অভিযোগ দায়েরের জন্য প্রমাণাদি অবশ্যই সংরক্ষণ করে রাখতে হবে, যেমন পণ্য বা সেবা গ্রহণের রশিদ, পারিপার্শ্বিক যদি কোন প্রমাণাদি থাকে সেগুলি।অভিযোগ দায়ের করার সময় অভিযোগকারী এবং অভিযুক্ত উভয়ের যোগাযোগের ঠিকানা সঠিকভাবে প্রদান করা, ঘটনার সময় এবং তারিখ স্পষ্ট ভাবে লেখা, অভিযোগ যদি একের অধিক থাকে প্রতিটি অভিযোগ আলাদাভাবে স্পষ্টকরণ করা। এই আইনের অধীনে অভিযোগ করলে সরাসরি আইনজীবী নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা নেই, তবে আইনজীবী নিয়োগের ক্ষেত্রে বাধা নেই। জটিলতা সৃষ্টি হলে আইনজীবীর পরামর্শ নেয়া যেতে পারে।
বাংলাদেশে যে কয়টি প্রতিষ্ঠান স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার আওতায়তার মধ্যে অন্যতম জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। যদিও তাদের লোকবল অনেকখানি কম তারপরেও স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার প্রশ্নে তারা বাংলাদেশের অন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে একটু আলাদা। আশা করি তারা তাদের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা ধরে রাখবে এবং মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত থাকবে।
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। E-mail : junctionofjustice@yahoo.com