মনজিলা সুলতানা ঝুমা:
যেকোনো কারণেই, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ হতে পারে অথবা যৌথ সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে স্বামী বা স্ত্রী আলাদা থাকতে পারেন। শেষ সিদ্ধান্ত হিসেবে কোন দম্পতি যখন চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন, এক ছাদের নিচে আর থাকা সম্ভব নয় এবং দুজনই বিচ্ছেদকেই সিদ্ধান্ত হিসেবে গ্রহণ করেন তখন কিছু বিষয় সামনে আসে। যেমন তাঁদের বিচ্ছেদের পর তাদের অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের কী হবে? সন্তানদের আইনগত অবস্থান কী হবে, সন্তানেরা থাকবে কার কাছে, কে বহন করবে তাদের ভরণপোষণ, তা অনেকের কাছে জানা থাকেনা। অনেক সময় দেখা যায় দুজনই সন্তানকে নিজের কাছে রাখতে চান, কেউই ছাড় দেবার পাত্র নয়। ফলে শুরু হয় নতুন সংকট। তাছাড়া সমাজে মুখরোচক বিভিন্ন গল্প আছে যা পুরোপুরি আইন সম্মত বা সত্য নয়। সাধারণ মানুষ এটাও ভাবে যে বাবাই সন্তানে একমাত্র এবং চূড়ান্ত অধিকারী। এবং সেখানে মায়ের কোন ধরনের অধিকার নাই। এই সকল ধারণা স্পষ্ট করার জন্য নিম্নবর্নিত বাস্তব জীবনের কিছু সমস্যার ভিত্তিতে আইনী বিষয় জানবো এবং পাশাপাশি সেই সমস্যা সমাধানের আলোকে আইনের বিধান জানবো।
ঘটনা- ১ :
স্বামী-স্ত্রী উভয়ের সম্মতিতে যদি ডিভোর্স হয়। পুত্রসন্তানের বয়স তিন বয়স তিন বছর। এবং কন্যা সন্তানের ৭ বছর।এখন বাবা সন্তানদের নিজের কাছে রাখতে চায়। বাবা চাকুরীজীবি এবং দ্বিতীয় বিয়ে করতে চায়। সেক্ষেত্রে আইন কি বলে বা কোন বিধিনিষেধ আছে কী?
ঘটনা -২ :
মাহিয়ার ৪ মাস বয়সের একটি মেয়ে বাচ্চা আছে সে তার স্বামির সাথে সংসার করতে চায় না। সে তার মতামত স্বামীকে জানানোর পর তিনি রাজী হয়েছেন। কিন্তু তার স্বামী তাকে বাচ্চা দিবে না। মারিয়া মেয়ের ভালোর জন্য কমপক্ষে ১৮ বছর তার মেয়েকে লালন পালন করতে চায়। সে প্রয়োজনে তার বাচ্চার ভরণপোষণের দাবীও করবে না।
ঘটনা-৩ :
নিলয়ের বাবা মা এর ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে ১ মাস। নিলয়ের বাবা অন্যত্র বিয়ে করে ফেলেছে কিন্তু নিলয় থাকে তার দাদির কাছে। এখন নিলয়ের মা তার সন্তানকে নিজের কাছে রাখতে চায় এবং তিনি অন্যত্র বিয়েও করেননি।
ঘটনা -৪ :
রুপা স্বামির সাথে এখনো ডিভোর্স হয়নি কিন্তু হয়ে যাবে। তারা আলাদা বসবাস করছি দীর্ঘ দিন ধরে। তাদের চার বছর বয়সী কন্যার অভিভাবকত্ব চেয়ে মামলা করতে রুপা। মেয়ের কোনো খরচাপাতি মেয়ের বাবা কখনোই বহন করেনি। রুপা মামলা কোথায় দায়ের করবে? তার স্থায়ী ঠিকানায় নাকি বর্তমান ঠিকানায়?
এখন আমরা জেনে নিব এই সম্পর্কে আইনের বিধানে কি আছে :
মুসলিম আইন অনুযায়ী, পিতা অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের আইনত অভিভাবক এবং মা হচ্ছেন সন্তানের তত্ত্বাবধায়ক। নাবালকের সার্বিক কল্যাণের গুরুত্বের ওপরে নির্ভর করে দেশে প্রচলিত মুসলিম আইন অনুযায়ী, মাকে নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত সন্তানের জিম্মাদারিত্বের অধিকার দেয়া হয়েছে। ছেলে শিশুকে সাত বছর এবং মেয়ে শিশুকে তার বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত মা জিম্মায় রাখার অধিকারী। এটিকে হিজানত বলে। তবে নাবালক সন্তান যার তত্ত্বাবধানে থাকুক না কেন, সন্তানের খোঁজখবর নেয়া, দেখাশোনা এবং ভরণপোষণের দায়িত্ব কিন্তু অভিভাবক হিসেবে বাবার।
জিম্মাদারিত্বের নির্দিষ্ট বয়স পার হলেও সন্তান তার পিতার জিম্মায় যেতে বাধ্য নয়। নির্দিষ্ট বয়সের পরও সন্তানের সার্বিক কল্যাণের বিষয়টি বিবেচনা করে সন্তানের জিম্মাদারিত্বের দায় ফের মায়ের কাছে ন্যস্ত হতে পারে। ‘সার্বিক কল্যাণ’ (Best interest of the child) বলতে আইন অনুযায়ী সন্তানের পার্থিব, নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক কল্যাণকে বোঝায়। সন্তানের নিরাপত্তার পাশাপাশি সুন্দর ও উত্তমরূপে তাকে প্রতিপালনের বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত করে। অর্থাৎ, জিম্মাদারিত্বের নির্দিষ্ট বয়স পার হলেই বাবা শর্তহীনভাবে সন্তানদের চূড়ান্ত জিম্মাদার হতে পারেন না, এ ক্ষেত্রে সন্তানের সার্বিক কল্যাণকে গুরুত্ব দেয়া হয়। ১৭ ডিএলআর ১৩৪ অনুযায়ী মায়ের জিম্মায় থাকাকালে সন্তানের পিতা যদি কোনো ভরণপোষণ বহন না করেন, সে ক্ষেত্রে মা সন্তানকে বাবার সাথে দেখাসাক্ষাৎ করাতে ‘বাধ্য নন’ বলে এই মামলার রায়ে অভিমত পোষণ করা হয়েছে।
পিতা মাতা ছাড়া অন্য কেউ অভিভাবক হতে পারে?
পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ অনুসারে বাবা মা ছাড়াও নিম্নলিখিত ব্যক্তিরা নাবালকের সম্পত্তির অভিভাবক হওয়ার অধিকারী : অগ্রগণ্যতার ক্রম অনুযায়ী বাবা কর্তৃক নিয়োগকৃত ব্যক্তি; বাবার বাবা অর্থাৎ দাদা, দাদা কর্তৃক নিয়োগকৃত ব্যক্তি। যদি এসব ব্যক্তি না থাকেন, তাহলে আদালত কর্তৃক নিয়োগকৃত আইনগত অভিভাবকই নাবালকের সম্পত্তির অভিভাবক। এ ক্ষেত্রে, মা কেবল একজন তত্ত্বাবধায়ক এবং তিনি নাবালক সন্তানের কোনো সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারেন না, যদি না আদালত কর্তৃক সম্পত্তির অভিভাবক নিযুক্ত হন।
মা কখন সন্তানের তত্ত্বাবধান করবেন :
সন্তানের মা যদি বাবার কাছ থেকে আলাদা থাকেন কিংবা তাঁদের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে যায়, তাহলে মা তাঁর সন্তানের তত্ত্বাবধান করার ক্ষমতা হারাবেন না। ছেলের ক্ষেত্রে সাত বছর বয়স পর্যন্ত এবং মেয়েসন্তানের বয়ঃসন্ধি বয়স পর্যন্ত মা সন্তানদের নিজের কাছে রাখতে পারবেন। সন্তানের ভালোর জন্য যদি সন্তানকে মায়ের তত্ত্বাবধানে রাখার আরও প্রয়োজন হয়, সে ক্ষেত্রে এ বয়সসীমার পরও মা সন্তানকে নিজের কাছে রাখতে পারবেন। তবে এ জন্য ক্ষেত্রবিশেষে আদালতের অনুমতির প্রয়োজন হতে পারে।
মা কখন সন্তানের জিম্মাদারিত্বের অধিকার হারান :
নিম্নবর্নীত কারনে অনেক সময় মা সন্তানের জিম্মাদারিত্ব হারানঃ
১. নীতিহীন জীবন যাপন করলে;
২. এমন কারো সাথে তার বিয়ে হলে, যিনি শিশুটির নিষিদ্ধ স্তরের মধ্যে ঘটলে তার ওই অধিকার পুনর্জীবিত হয়;
৩. সন্তানের প্রতি অবহেলা করলে এবং দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে;
৪. বিয়ে বজায় থাকা অবস্থায় বাবার বসবাসস্থল থেকে দূরে বসবাস করলে;
৫. যদি তিনি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম গ্রহণ করেন;
৬. যদি সন্তানের বাবাকে তার জিম্মায় থাকা অবস্থায় সন্তানকে দেখতে না দেন;
৭. মা ২য় বিয়ে করলে।
তবে ক্ষেত্রবিশেষে আদালত সব ঘটনা ও অবস্থা বিবেচনা করে নাবালককে তার মায়ের পুনর্বিবাহের পরও সে মায়ের জিম্মায় রাখার আদেশ দিতে পারেন।
অভিভাবক হিসেবে বাবা কখন অযোগ্য হতে পারেন:
অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন, ১৮৯০-এর ১৯ ধারা অনুযায়ী পিতাও অভিভাবক হিসেবে অযোগ্য হতে পারেন। তিনি চারিত্রিকভাবে অসৎ হলে, সন্তানের মা অর্থাৎ স্ত্রীর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করলে, যদি মাদকাসক্ত এবং অধার্মিক হন, শিশুদের প্রতি অমানবিক আচরণ করেন, প্রকাশ্যে লাম্পট্য করেন, দুস্থ অথবা নিঃস্ব হন অথবা স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে এ সংক্রান্ত কোনো চুক্তি থাকে, বাবা ফের বিয়ে করেন এবং নাবালক সন্তানের ভরণপোষণ দিতে অবহেলা করেন।
কখন পারিবারিক আদালতের আশ্রয় নিবেন:
দম্পতির বিচ্ছেদের পরে সন্তানের অভিভাবকত্ব ও তত্ত্বাবধান নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে পারিবারিক আদালতে আশ্রয় নেওয়া যাবে। পারিবারিক আদালত তখন আইন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবে, সন্তানেরা কার কাছে থাকবে। তবে আইনের পাশাপাশি আদালতের ক্ষমতা রয়েছে সন্তানের কল্যাণের দিকটি বিবেচনা করা। আদালত সন্তানের সুস্থ, স্বাভাবিক বিকাশের দিকটি বিবেচনা করে বাবা বা মা যে কারও কাছে রাখার আদেশ দিতে পারেন।
সন্তানের মতামতের প্রাধান্য :
অনেক সময় সন্তানের যদি ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা থাকে, তাহলে সন্তানের মতামতকেও আদালত গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এ জন্য প্রয়োজন হলে সন্তানকে আলাদা করে বিচারক নিজের কাছে নিয়ে তার মতামত জেনে নিতে পারেন। আবার মা-বাবা পর্যায়ক্রমে সন্তানকে কাছে রাখা কিংবা একজনের কাছে থাকলে অন্যজনকে দেখা করার অনুমতিও দিয়ে থাকেন। পারিবারিক আদালতে নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সন্তানকে কাছে রাখার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ারও সুযোগ রয়েছে। সন্তানের মা আলাদা থেকে অথবা বিবাহ বিচ্ছেদের পরে সন্তানের ভরণপোষণ আদায় করার জন্য নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পারিবারিক আদালতে মামলা করতে পারবেন।
সন্তানের ভরণপোষণের দায়িত্ব কার:
বিচ্ছেদের পর সন্তান যদি মায়ের কাছে থাকে, অনেক বাবা মনে করেন সন্তানের ভরণপোষণ দিতে হবে না। এটা ঠিক নয়। সন্তান বাবা কিংবা মা—যার কাছেই থাকুক না কেন, সন্তানের ভরণপোষণের দায়িত্ব সম্পূর্ণ বাবার। অর্থাৎ মা-বাবার মধ্যে বিচ্ছেদ হলে কিংবা মা-বাবা আলাদা বসবাস করলে বাবাকেই সন্তানদের ভরণপোষণ দিয়ে যেতে হবে। ইচ্ছে করলে মা আলাদা থেকেও বিবাহবিচ্ছেদ হোক বা না হোক।
মামলা দায়েরের স্থান এবং আদালত :
অভিভাবকত্ব এবং নাবালক সন্তানের জিম্মাদারিত্বের জন্য পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়। এ ছাড়া আদালতের বাইরে উভয় পক্ষ সমঝোতার মাধ্যমে বা কারো মধ্যস্থতায়ও এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। পারিবারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে জেলা জজের আদালতে আপিল করা যায়। মামলার জন্য যেই আবেদন করুক না কেন তার বসবাস করা স্থান যে আদালতের এখতিয়ারাধীন অথবা যেখানে সন্তান বসবাস করে সেখানে মামলা করতে পারে।
লেখক – আইনজীবী, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ঢাকা এবং খাগড়াছড়ি।