মোঃ শামীম হোসেন:
অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা বলতে এক কথায় বোঝায় যাহা স্থায়ী নয়। মনে রাখা দরকার- অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর হয় মোকদ্দমাটি চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত। অথবা পরবর্তী আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত। আরও একটি বিষয় মনে রাখা দরকার- অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চাওয়া হয় মূল মোকদ্দমায় অতিরিক্ত প্রতিকার হিসেবে। অর্থাৎ কোন মোকদ্দমা চলমান না থাকলে সরাসরি অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার জন্য আবেদন করা যায় না। দেওয়ানী কার্যবিধি আইনের আদেশ ৩৯ বিধি ১ ও ২ মোতাবেক এবং ক্ষেত্রবিশেষে ১৫১ ধারায়ও এ ধরণের প্রতিকার চাওয়া যায়। অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আবেদন কখন করা যায় এ সম্পর্কে বিধি ২(১) তে বলা হয়েছে যে মোকদ্দমার যে কোন পর্যায়ে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার জন্য আবেদন করা যাবে।
বিধি ১ অনুযায়ী যখন নালিশী সম্পত্তি কোন পক্ষ কর্তৃক ধ্বংস, ক্ষতিগ্রস্থ বা হস্তান্তরিত হওয়ার বা কোন ডিক্রি জারিমূলে অন্যায়ভাবে বিক্রি হতে পারে অথবা বিবাদী যখন পাওনাদারকে বঞ্চিত, প্রতারিত করার জন্য তার সম্পত্তি হস্তান্তর করার হুমকি প্রদান করে বা ইচ্ছা পোষণ করে, তখন আদালত উক্ত নালিশী সম্পত্তি ধ্বংসকরণ, ক্ষতিগ্রস্থকরণ, হস্তান্তর, নিলাম, বিক্রয়, অপসারণ বা সমর্পণ স্থগিত করার উদ্দেশ্যে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর করতে পারে বা আদালত কর্তৃক যেরূপ উপযুক্ত বিবেচিত হবে সেরূপ আদেশ দিতে পারেন। তবে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারির পূর্বে বিধি ৩ অনুযায়ী অপর পক্ষকে নোটিশ প্রদান করতে হবে এবং বিধি ৩(ক) মোতাবেক ঐরূপ নোটিশ ৭ (সাত) দিনের মধ্যে জারি হোক বা না হোক আদালতে ফেরত দিতে হবে। আর যদি নোটিশ বিনা জারিতে ফেরত আসে, তাহলে দেওয়ানী কার্যবিধি আইনের আদেশ ৫ বিধি ২০ মোতাবেক ৭ (সাত) দিনের মধ্যে পুনরায় নোটিশ জারি করতে হবে এবং উক্তরূপ জারির ফলে নোটিশটি যথাযথভাবে জারি হয়েছে বলে গণ্য হবে।
অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারির কতগুলো নীতিমালা অবলম্বন করা হয়। উল্লেখ্য অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা প্রদানের ক্ষেত্রে দেওয়ানী কার্যবিধি আইনের আদেশ ৩৯ তে কোন নীতিমালা দেওয়া হয়নি বা নীতিমালার বিষয়ে কোন কিছু উল্লেখ নেই। তবে এক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের বহু বছরের সিদ্ধান্ত ও অভিমত পর্যালোচনা করে মূলত ৪ (চার) টি নীতি পাওয়া যায় এবং অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে সাধারণত এ চারটি নীতিই অনুসরণ করা হয়ে থাকে।
(ক) প্রথমেই আবেদনটি বিবেচনা করে যদি মনে হয়- আপাত দৃষ্টিতে প্রার্থীর পক্ষে যুক্তিগ্রাহ্য বক্তব্য বা Prima faci Case আছে। অর্থাৎ প্রার্থীর দাবী প্রাথমিকভাবে সত্য বলে প্রতিয়মান হচ্ছে বা দাবীর মধ্যে সত্যতা রয়েছে। পাশাপাশি আরও প্রতিয়মান হবে যে- প্রার্থীর দাবীর সমর্থনে জোড়ালো যুক্তি (arguable case) উপস্থাপনের সুযোগ আছে। যেমন- ‘ক’ নালিশী সম্পত্তি ‘খ’ এর নিকট হতে খরিদাসূত্রে মালিক হয়ে ভোগদখলে আছে এবং ‘ক’ খরিদা দলিল, দাখিলা, নামজারির আদেশ প্রভৃতি আদালতে দাখিল করে বলল যে, যদি প্রার্থীত নিষেধাজ্ঞা জারি না করা হয়, তাহলে তার অধিকার ক্ষুন্ন হবে বা বাঁধাগ্রস্থ হবে, তখন ধরে নিতে হবে ‘ক’ এর দাবীর সমর্থনে Prima faci arguable Case আছে।
(খ) প্রার্থনাটি শুধুমাত্র অপর পক্ষকে হয়রানী করার জন্য করা হয়েছে, নাকি প্রকৃতপক্ষেই অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার প্রয়োজন রয়েছে তা বিবেচনায় নিতে হবে। অর্থাৎ যখন বাদী আইন দ্বারা স্বীকৃত অধিকার রক্ষার জন্য আবেদন করে, তখন ধরে নিতে হবে অপর পক্ষকে হয়রানী করা হয়নি। যেমন- দবির সাহেবেরা ৬ ভাই। দবির সহ আরও ৪ ভ্রাতা অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আবেদন করে বলল যে তারা নালিশী সম্পত্তিটি ওয়ারিশানমূলে মালিক হয়ে ভোগ দখলে আছেন। কিন্তু সর্বশেষ রেকর্ড বা জরিপে তাদের ৫ জনের নাম লিপি না হয়ে, বড় ভাই ছবির এর নামে এককভাবে রেকর্ড লিপি হয়েছে। সমন পেয়ে দবিরের বড় ভাই ছবির তখন বাদীগণকে বেদখলের হুমকি প্রদান করেন এবং বেদখলের হুমকির কারণে বাদীগণ অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আবেদন করিয়াছেন, এরূপ ক্ষেত্রে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশ জারি হওয়া সঠিক হবে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে বোঝা যাচ্ছে বাদীগণ বিবাদীকে কোন ধরণের হয়রানীর জন্য আবেদন করে নাই।
আবার যদি এ রকম হয় যে খরিদমূলে মালিক হয়ে নালিশী ভূমি দখলে আছেন মর্মে স্বত্ব ঘোষণার মোকদ্দমা দায়ের করেন। পরবর্তীতে সমন পেয়ে বাদীকে বেদখলের হুমকির কারণে বাদী যদি অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আবেদন করেন, সেক্ষেত্রে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়া বাদীর অধিকার রক্ষার জন্য প্রয়োজন। ২২ ডি এল আর (এডি) ৯৮।
(গ) অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আবেদন মঞ্জুর করার ক্ষেত্রে সুবিধা-অসুবিধার ভারসাম্যের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে বিবেচনা করে দেখতে হবে যে যদি নিষেধাজ্ঞার আবেদন মঞ্জুর না করা হয়, তাহলে প্রার্থীর অসুবিধা অপর পক্ষের চেয়ে বেশী হবে, তখন আবেদন মঞ্জুর করা সঠিক হবে। কিন্তু যখন দেখা যাবে আবেদন মঞ্জুর করা হলে অপর পক্ষের অনেক বেশী অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে, সেক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার আবেদন না-মঞ্জুর করাই সঠিক হবে। বিষয়টি এ রকম হতে পারে- এক ব্যক্তি এজমালী সম্পত্তিতে ১/১৩ অংশ নিয়ে মামলা করল এবং নিষেধাজ্ঞার আবেদন করে বলল যে, বিবাদী যেন এজমালী সম্পত্তিতে কোন কাজ না করতে পারে সেজন্য নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হোক। কিন্তু এখানে বিবেচ্য বিষয় হল- বাদীর স্বীকৃতমতেই তিনি মোট সম্পত্তির ১৩ ভাগের ১ ভাগ এর মালিক এবং ১২ ভাগই বিবাদীর। এক্ষেত্রে বোঝা যাচ্ছে সুবিধা-অসুবিধার ভারসাম্য বিবাদীর অনুকূলে এবং বাদীর বিরুদ্ধে। এরূপ ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার আবেদন মঞ্জুর করা সঠিক হবে না।
(ঘ) প্রার্থনা অনুযায়ী অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি না করা হলে প্রার্থীর অপূরনীয় ক্ষতির সম্ভাবনা আছে। অর্থাৎ প্রার্থনা অনুযায়ী যদি নিষেধাজ্ঞার আবেদন মঞ্জুর না করা হয়, তাহলে যে ক্ষতি হবে তা টাকার অংকে পরিমাপ করা যাবে না, তখন আবেদন মঞ্জুর করাই সঠিক হবে। কিন্তু যে ক্ষতি হবে উহা যদি টাকা দিয়ে পূরণ করা যায়, তাহলে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আবেদন না-মঞ্জুর হবে। যেমন- চুক্তি ভঙ্গের মামলায় ক্ষতিপূরণ সাধারণত টাকা দিয়ে পরিমাপ করা যায়, এক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার আবেদন না-মঞ্জুর করাই সঠিক হবে। কিন্তু কোন ক্ষতিটা অপূরনীয় বা অপূরণীয় ক্ষতি কিভাবে পরিমাপ করতে হবে, এক্ষেত্রে একটাই বিবেচ্য বিষয়- যে ক্ষতি হবে সেটা টাকা দিয়ে পূরণ করা যাবে না। যেমন- ট্রেডমার্কস অধিকার খর্ব হলে উহা টাকা দিয়ে পূরণ করা যাবে না। আবার এ রকমও হতে পারে বাদী কোন নির্দিষ্ট জমিতে তার স্বত্ব ঘোষনার জন্য মামলা করার পর নালিশী জমি হতে ধান বা অন্য কোন ফসল যেন বিবাদী কেটে নিতে না পারে সেজন্য নিষেধাজ্ঞার প্রার্থনা করেন। এক্ষেত্রে ধারণা করা হতে পারে যে- যদি ধান কেটে নেওয়াও হয়, তাহলে উক্ত ধানের মূল্য টাকা দিয়ে পূরণ করা সম্ভব হতে পারে, তাই নিষেধাজ্ঞা না-মঞ্জুর হবে। কিন্তু যদি এ রকম হয় যে ধান কেটে নেওয়ার পর বাদীকে আর নালিশী জমিতে ঢুকতে দিচ্ছে না। সেক্ষেত্রে বাদীকে পুনরায় Ad value কোর্ট ফি দিয়ে স্বত্ব ঘোষণাসহ দখল পুনরূদ্ধাারের মোকদ্দমা করতে হবে। কিন্তু যদি নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়, সেক্ষেত্রে এ ধরণের পরিস্থিতি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব, এরূপক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার প্রার্থনা মঞ্জুর করাই সঠিক হবে।
লেখক: আইনজীবী, জজ কোর্ট, ঢাকা। E-mail : shamimlawassociates@gmail.com