মিল্লাত হোসেন:
বাংলাদেশের বিচার বিভাগে ‘বিচারিক হাকিম’, “জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম”, “মহানগর হাকিম’; “অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম”, “অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম”, “মুখ্য বিচারিক হাকিম” বা “মুখ্য মহানগর হাকিম” বলে কোন পদ নেই।
তা সত্ত্বেও, খবরের কাগজসহ অন্যান্য সংবাদমাধ্যমেও বিচারিক হাকিম বা মহানগর হাকিম এসব পদবি উল্লেখ করতে দেখা যায় জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এর বদলে। আরো সুনির্দিষ্টভাবে বললে বলতে হয়- Magistrate পদবিটিকে ‘হাকিম’ বলে এবং Judicial, Senior, Additional ও Chief শব্দগুলোকে যথাক্রমে বিচারিক, জ্যেষ্ঠ, অতিরিক্ত ও মুখ্য বলে স্বেচ্ছাকৃত অনুবাদ করে লিখা হতে দেখা যায়। অবশ্যই প্রাগুক্ত ইংরেজি শব্দগুলোর বঙ্গানুবাদ এমনই যেমনটি লেখা হয়। কিন্তু, তা পৃথক-পৃথকভাবে। যদি কোন পদ নাম হিসেবে এগুলো একত্রে ব্যবহৃত হয় তখন স্বেচ্ছাকৃত বঙ্গানুবাদ শুধু যে করা যাবে না, তা নয়, করলে বেআইনিও হবে।
দেশের সর্বোচ্চ আইন বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদে বাংলাতেই আছে- ‘ম্যাজিস্ট্রেট’ শব্দটি। ১১৫, ১১৬ ও ১১৬ক অনুচ্ছেদে আছে- ‘বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনকারী ম্যাজিস্ট্রেট’, ‘ম্যাজিস্ট্রেট’ ইত্যাদি। হাকিম বলে অনুবাদ করা হয়নি।
The Code of Criminal Procedure, 1898 আইনটি ইংরেজি ভাষায় প্রণীত হয়ে সেভাবেই বহাল আছে এখনো পর্যন্ত। এই আইনের ৬ ধারা অনুযায়ী Judicial Magistrate, Metropolitan Magistrate, Additional Chief Judicial Magistrate, Additional Chief Metropolitan Magistrate, Chief Judicial Magistrate ও Chief Metropolitan Magistrate নামের পদই কেবল আছে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (সার্ভিস গঠন, সার্ভিস পদে নিয়োগ ও সাময়িক বরখাস্তকরণ, বরখাস্তকরণ ও অপসারণ) বিধিমালা, ২০০৭ সহ বিচারকদের জন্য প্রণীত অন্যান্য চাকুরি বিধি অনুযায়ী জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট,
সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, এডিশনাল চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, এডিশনাল চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট নামের পদই কেবল আছে।
এগুলোর কোনো বাংলা অনুবাদ করা হয়নি আইনে বা বিধিতে। আবার, বাংলার ক্ষেত্রেও শুধু প্রতিবর্ণীকরণ করা হয়েছে। ফলে, আনুষ্ঠানিকভাবে যখন এসব পদের নাম লিখতে হবে তখন আইনানুযায়ীই লিখতে হবে।
যে কোনো ব্যক্তি বা স্থানের নাম proper name হিসেবে হুবহু বানান ও উচ্চারণ করার বাধ্যবাধকতা থাকে। যেমন- কারো নাম যদি “শহীদ” বা “যুবরাজ” হয় তবে কেউ যদি তা “সহিদ” বা “ইয়ুবরাজ” লিখেন বা উচ্চারণ করেন তবে তা একদিকে যেমন হবে অসম্মানজনক; অন্যদিকে হবে- নিরেট ভুল।
আর, কোনো নাম যদি আইনগতভাবে নির্দিষ্ট করা হয়, যেমন- “বাংলাদেশ” (Bangladesh) বা “Chattogram” (চট্টগ্রাম); তবে সেভাবেই লিখতে হবে। ইংরেজি ধ্বনি উচ্চারণ পদ্ধতি (IPA) অনুসারে এগুলো ভুল (চ্যাট্টোগ্র্যাম বা ব্যাংলাদেশ!) হলেও কিছু করার নেই। হ্যাঁ, এগুলো যারা ঠিক করেছেন তাদের জ্ঞান নিয়ে সমালোচনা করতে পারেন, কিন্তু এভাবেই লিখতে হবে যতোক্ষণ না সংবিধান বা অন্যান্য বিধিবিধানে সংশোধনী আনা হয়। কারণ, আইন as it is প্রয়োগ করা হবে।
মানে, কালো অক্ষরে যেভাবে আছে সেভাবেই ব্যবহার করার বাধ্যবাধকতা আছে। হ্যাঁ, সে আইনটা ভাল না মন্দ, সেই আলোচনা নিশ্চয় করা যাবে। তবে, সেটা আইন প্রণয়ন বা সংশোধনের পর্যায়ে, প্রয়োগের ক্ষেত্রে as it is।
ফলে, আইন অনুসরণ না করে যে কোনো পর্যায়ের সরকারি বা বেসরকারি যে সব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান “বিচারিক হাকিম” বা “মুখ্য মহানগর হাকিম” ইত্যাদি লিখছেন তারা-
প্রথমত, ভুল করছেন;
দ্বিতীয়ত, আইন লঙ্ঘন করে যাচ্ছেন এবং সর্বশেষে, ভুল নামে ডেকে বা লিখে আদবেরও যে ব্যত্যয় ঘটাচ্ছেন, তা বলাই বাহুল্য। এই বিষয়ে সতর্ক ও সচেতন হওয়া জরুরি।
লেখক : যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ, সিলেট