চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে বিস্ময়করভাবে ১৪ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা মূল্যমানের অঘোষিত সম্পদকে বৈধ করা হয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বৃহস্পতিবার দ্য গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, চলমান মহামারিতে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে সরকারের দেওয়া সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অন্তত ১০ হাজার ৩৪ ব্যক্তি তাদের রেকর্ড পরিমাণ অবৈধ সম্পদ বৈধ করেছেন। এজন্যে তারা কর দিয়েছেন এক হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা।
প্রায় নয় হাজার ৬৯৩ জন মানুষ এক হাজার ৩৯০ কোটি টাকা কর দিয়ে তাদের অঘোষিত ফিক্সড ডিপোজিট স্কিম (এফডিআর), সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য সম্পদকে বৈধ করে নিয়েছেন।
এনবিআর কর্মকর্তা আরও জানিয়েছেন, বৈধ করা সম্পদের মোট পরিমাণ ১৩ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৯০ শতাংশই নগদ অর্থ, এফডিআর, সঞ্চয়পত্র, ইত্যাদি। বাকিটা ফ্ল্যাট, বাড়ি, জমি ইত্যাদি।
আরও ৩৪১ জন মানুষ ৪৯ কোটি টাকা কর দিয়ে পুঁজিবাজারে ৪৩৫ কোটি টাকার অঘোষিত বিনিয়োগকে বৈধ করে নিয়েছেন।
শুধু রাজধানীর ১৫টি কর অঞ্চলেই প্রায় চার হাজার ৮৮৫ জন ব্যক্তি ৯৮০ কোটি টাকা কর দিয়ে তাদের অঘোষিত এফডিআর, সঞ্চয়পত্র, নগদ অর্থ ও বাড়ি বৈধ করে নিয়েছেন।
আরও ২০৪ জন মানুষ ৩৪ কোটি দুই লাখ টাকা কর দিয়ে পুঁজিবাজারে তাদের বিনিয়োগকে বৈধ করেছেন।
তবে, বৃহৎ করদাতাদের ইউনিটের ২৯ জন এই সুযোগ নিয়েছেন। যার মানে বোঝায়, এই ইউনিটের বেশিরভাগ সদস্যই সঠিকভাবে কর দিয়ে থাকেন। শীর্ষ ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন করদাতাদের নিয়ে এই ইউনিট গঠিত হয়েছে।
চট্টগ্রামের চারটি কর অঞ্চলে এক হাজার ১০৬ ব্যক্তি সরকারের দেওয়া সুযোগটি গ্রহণ করেছেন। তারা ১২১ কোটি টাকা ব্যয় করে তাদের অঘোষিত এফডিআর, সঞ্চয়পত্র, নগদ অর্থ ও বাড়ি বৈধ করেছেন।
অন্তত ৫২ ব্যক্তি পুঁজিবাজারে তাদের বিনিয়োগকে বৈধ করেছেন চার কোটি ৫১ লাখ টাকা কর দিয়ে।
এ ছাড়াও, খুলনায় ৫৪৪ জন, কুমিল্লায় ৫৩৮, নারায়ণগঞ্জে ৪৮৮, রংপুরে ৩৮৭, গাজীপুরে ৩৬৯, রাজশাহীতে ২৯৫, বগুড়াতে ২৬৩, ময়মনসিংহতে ২৪১ ও বরিশালে মোট ২৩০ জন তাদের অঘোষিত সম্পদ বৈধ করেছেন।
অঘোষিত সম্পদ বৈধ করতে সরকারের বেঁধে দেওয়া সময়সীমা আগামী ৩০ জুন শেষ হতে যাচ্ছে।
এনবিআর কর্মকর্তা মনে করেন, কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে অঘোষিত অর্থের বৈধকরণের হারটি এপ্রিলে এসে উল্লেখযোগ্য হারে কমে গিয়েছে।
সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় থাকার সময়ে ২০০৭-০৮ ও ২০০৮-০৯ অর্থবছরে অঘোষিত সম্পদ বৈধ করার রেকর্ড ছিল সর্বোচ্চ।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, সে সময়ে প্রায় নয় হাজার ৬৮২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা বৈধ করা হয়েছিল।
আগের উদ্যোগগুলো প্রত্যাশিত ফল আনতে ব্যর্থ হওয়ায় সরকার অর্থনীতিকে চাঙা করতে, বিনিয়োগ বাড়াতে ও পুঁজিবাজারের উন্নয়নের জন্য বর্তমান অর্থবছরে অঘোষিত সম্পদকে ঢালাওভাবে বৈধ করার সুযোগ দেয়।
এনবিআর ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বা অন্য কোনো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বৈধ করা সম্পদের উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন তুলতে পারবে না বলেও এখানে বিধান রাখা হয়।
এক্ষেত্রে সম্পদের আকার অনুসারে তাদের সব অঘোষিত সম্পদ, যেমন— বাড়িঘর, জমি, দালান বা ফ্ল্যাটের জন্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিয়ে সেগুলোকে বৈধ সম্পদ হিসেবে ঘোষণার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।
অঘোষিত নগদ অর্থ, ব্যাংকে জমা রাখা টাকা, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, বন্ড ও অন্যান্য সিকিউরিটির ওপর ১০ শতাংশ কর দিয়ে সেগুলো বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।
তাদেরকে পুঁজিবাজারে অন্তত এক বছরের জন্যে বিনিয়োগের অনুমতিও দেওয়া হয়েছিল এবং এই বিনিয়োগ তারা তাদের কর রিটার্নে দেখানোরও সুযোগ পেয়েছেন।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আগে অঘোষিত সম্পদের বৈধকরণের সুবিধাটি শর্তসাপেক্ষে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, এবারের সুযোগটি বেশ উদার প্রকৃতির ছিল। কোনো সংস্থা যেহেতু এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন তুলতে পারবে না, তাই অনেকে তাদের অর্থ বৈধ করেছেন।’
তিনি বলেন, ‘কিন্তু, আমরা মুদ্রার অপর পিঠের দিকে তাকাচ্ছি না। সৎ করদাতাদের ওপর এমন সুযোগের কী প্রভাব পড়তে পারে, যারা নিয়ম মেনে অনেক বেশি পরিমাণে কর দিয়েছেন? এটি বিবেচনায় আনা উচিত।’
তার প্রশ্ন, ‘যখন অনেকেই মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে তাদের অঘোষিত সম্পদ বৈধ করে নিতে পারছেন, তাহলে সৎ করদাতারা কেন কর দেবেন?’
একজন ব্যক্তিকে বছরে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত আয়কর দিতে হয়।
তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ‘যদি মহামারির কারণে এমন সুযোগ দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে সৎ করদাতারাও কেন একই রকম সুযোগ পাবে না?’
‘যদি এ ধরনের কার্যক্রমের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জনের লক্ষ্য থেকে থাকে, তাহলে যাচাই করতে হবে এমন উদ্যোগর মাধ্যমে আদৌ কোনো রাজস্ব বেড়েছে কি না। বেড়ে থাকলে কী পরিমাণে বেড়েছে, তা দেখা দরকার’, যোগ করেন তিনি।
তিনি মনে করেন, কোনো নীতিমালায় এ ধরনের বৈষম্য থাকা উচিত নয়।
সাবেক এনবিআর সভাপতি নাসিরউদ্দিন আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘মহামারির কারণে এমন সুযোগ দেওয়া হয়েছে।’
তার মতে, অঘোষিত সম্পদের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ না থাকায় এই বিপুল পরিমাণ অর্থ বৈধ হয়েছে।
অর্থনীতিতে এর অবদান সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এই ১৪ হাজার কোটি টাকা আমাদের ২৩ লাখ কোটি বা ২৪ লাখ কোটি টাকার জিডিপির তুলনায় কিছুই না।’
‘এ সুযোগগুলো নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির সুবিধার জন্য দেওয়া হয়ে থাকে’, উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তা সৎ ও অসৎ করদাতাদের মাঝে দ্বন্দ্ব তৈরি করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘দেশে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি রয়েছেন। সম্ভবত তাদের প্রভাবে এ ধরনের সুবিধা দেওয়া হয়েছে, যা ঠিক নয়।’
তিনি মনে করেন, ‘সরকারের উচিত করপোরেট করকে বাস্তবসম্মত করার পাশাপাশি কর রেয়াত ও একাধিক করের হারের মতো কর নীতিমালার অসংগতিগুলো ধীরে ধীরে দূর করা। এগুলো করা হলে কর আদায় বাড়বে।’
তবে, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আবদুল মজিদ ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘মহামারির কারণে টাকা পাঠানো ও সংগ্রহের অবৈধ মাধ্যম হুন্ডি বন্ধ আছে। এ কারণে অনেকেই তাদের অঘোষিত সম্পদ ও অর্থ বৈধ করেছেন।’
এমন উদ্যোগে অর্থনৈতিক সুবিধা কেমন হয়, সে সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এ টাকাগুলো বেসরকারি খাতেই ছিল এবং তা বেসরকারি খাতেই থাকছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকার এ পদ্ধতিতে আগের চেয়ে কম কর পেয়েছে। কারণ করের হার ছিল মাত্র ১০ শতাংশ।’
‘এ ধরনের বৈধকরণ সুবিধা যদি শুধু অস্থায়ী হাসপাতাল তৈরি বা মহামারির কারণে চাকরি হারানো ব্যক্তিদের জন্য আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করার কোনো প্রকল্পের ক্ষেত্রে দেওয়া হতো, তাহলে তা বেশি যুক্তিযুক্ত হতো’, বলেন মুহাম্মদ আবদুল মজিদ।
এই তিন বিশেষজ্ঞের সবাই বলেছেন যে অঘোষিত সম্পদের বৈধকরণের এ সুযোগ অর্থনৈতিক বা নৈতিকভাবে যৌক্তিক নয়। তাদের মতে, ভবিষ্যতে এ ধরনের সুবিধা না দেওয়াই ভালো হবে।