শুরুতেইযে আইনের ধারা বয়ষ্ক পিতা-মাতা’র কথা বলে বিষয়টি ভাল করে বুঝার জন্য চলুন আমরা ‘পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন, ২০১৩’ সম্পর্কে জেনে আসি…
রিসার্চ প্যানেল :
কিছু কাজ করতে হয় সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে। আমরা (School Of Legal Rights) মনে করি, আইনের ছাত্র হিসেবে জনগুরুত্বপূর্ণ কিছু আইন সকলের সামনে উপস্থাপন করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। সেই দায়িত্ববোধের জায়গা থেকেই আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে ‘পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন, ২০১৩’ আইনটির প্রতিটি ধারার বিশ্লেষণ করেছি। এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, যেসব পিতা-মাতা সন্তানের কাছ থেকে ভরণ-পোষণ পাচ্ছেন না তারা এবং তাদের সন্তানরা এই আইন সম্পর্কে জানেন না। তাদের সন্তানরা এই আইন সম্পর্কে জানলে শাস্তির ভয়ে হলেও বৃদ্ধ পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ বিষয়ে সচেতন হতো। আইন জানলে তাদের পিতা বা মাতা কোনো না কোনোভাবে হয়তো থানায় বা আদালতে হাজির হতেন এবং প্রতিকার লাভ করতেন। এই লেখার উদ্দেশ্য হলো- পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন সহজবোধ্যভাবে উপস্থাপন করা যাতে এই আইনের বার্তা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে পৌঁছায়। জেলা শহরে বা শহরের আশপাশের গ্রামে বা গন্ডগ্রামে যেখানে ছোট ছোট দোকানে একটি টেলিভিশনকে কেন্দ্র করে সারা দিনরাত চায়ের আড্ডা বসে, সেইসব আড্ডায় যারা অংশ নেন তাদেরকেও সচেতন করার জন্য এই লেখা। আপনারা নিজে জানবেন, নিজের পিতা-মাতাকে জানাবেন এবং আশপাশের চাচা-চাচি বা ফুফা-ফুফু বা খালা-খালুকে এই আইন সম্পর্কে বুঝিয়ে বলবেন এটাই প্রত্যাশা। এই আইন বাস্তবায়নে সচেতন হোন, দেখবেন আপনি যখন বয়স্ক হবেন, তখন এই আইনের কল্যাণেই হয়তো আপনিও সন্তানের কাছ থেকে ভরণ-পোষণ পাবেন। যে কথাগুলো শেষে বলার কথা, শুরুতেই বলে ফেললাম। এবার আইন বিষয়ে আসা যাক।
আইন সম্পর্কে প্রাথমিক পরিচিতি ও ধারাসমূহ :
২০১৩ সনে বাংলাদেশ সরকার সন্তান কর্তৃক পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করার জন্য পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন- ২০১৩ প্রবর্তন করে। আইনটির প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে , যেহেতু সন্তান কর্তৃক পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বিধান করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়; সেহেতু এতদ্বারা নিম্নরূপ আইন করা হইল। এর আগে এসম্পর্কিত কোনো বিধিবদ্ধ আইন ছিল না। আইনটি ২৭ অক্টোবর ২০১৩ সালে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মতি লাভ করে। ২০১৩ সালের পর এই আইন থাকা সত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে- অনেক পরিবারেই বৃদ্ধ পিতা-মাতা সন্তানের কাছ থেকে ভরণ-পোষণ পাচ্ছেন না; বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। এর প্রধান কারণ হচ্ছে আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব এবং আইন সম্পর্কে না জানা।
এই আইনের বিস্তারিত বর্ণনায় যাওয়ার পূর্বে এই আইনের অধীন কিছু টার্ম সংজ্ঞায়িত করা দরকার। আইনটির ২ ধারায় বলা হয়েছে, বিষয় বা প্রসঙ্গের পরিপন্থী কোন কিছু না থাকিলে, এই আইনে—
(ক) “পিতা” অর্থ এমন ব্যক্তি যিনি সন্তানের জনক;
(খ) “ভরণ-পোষণ” অর্থ খাওয়া-দাওয়া, বস্ত্র, চিকিৎসা ও বসবাসের সুবিধা এবং সঙ্গ প্রদান;
(গ) “মাতা” অর্থ এমন ব্যক্তি যিনি সন্তানের গর্ভধারিণী;
(ঘ) “সন্তান” অর্থ পিতার ঔরসে এবং মাতার গর্ভে জন্ম নেওয়া সক্ষম ও সামর্থ্যবান পুত্র বা কন্যা;
‘পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ’ শিরোনামে আইনের ৩ ধারায় বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে। ৩(১) ধারায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক সন্তানকে তার পিতামাতার ভরণপোষণ নিশ্চিত করতে হবে। ৩(২) ধারানুযায়ী, কোন পিতা-মাতার একাধিক সন্তান থাকলে সেইক্ষেত্রে সন্তানগণ নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে তাদের পিতা-মাতার ভরণপোষণ নিশ্চিত করবে। ৩(৩) ধারানুসারে, পিতা-মাতার ভরণপোষণ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রত্যেক সন্তানকে পিতা-মাতার একই সঙ্গে একই স্থানে বসবাস নিশ্চিত করতে হবে। ৩(৪) ধারা মতে, কোন সন্তান তার পিতা বা মাতাকে বা উভয়কে তার বা ক্ষেত্রমত, তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে, কোন বৃদ্ধ নিবাস কিংবা অন্য কোথাও একত্রে কিংবা আলাদা আলাদাভাবে বসবাস করতে বাধ্য করবে না। ৩(৫) ধারা মতে, প্রত্যেক সন্তান তার পিতা এবং মাতার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজ খবর রাখবে, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা ও পরিচর্যা করবে। ৩(৬) ধারা মতে, পিতা বা মাতা কিংবা উভয়, সন্তান হতে পৃথকভাবে বসবাস করলে সেক্ষেত্রে প্রত্যেক সন্তানকে নিয়মিতভাবে তাদের বা ক্ষেত্রমত, তাদের সহিত সাক্ষাৎ করতে হবে। ৩(৭) ধারা মতে, কোন পিতা কিংবা উভয়ে, সন্তানদের সঙ্গে বসবাস না করে পৃথকভাবে বসবাস করলে, সেই ক্ষেত্রে উক্ত পিতা বা মাতার প্রত্যেক সন্তান তাদের দৈনন্দিন আয়-রোজগার বা ক্ষেত্রমত, মাসিক আয় বা বাৎসরিক আয় হতে যুক্তিসংগত পরিমাণ অর্থ পিতা বা মাতা বা ক্ষেত্রমত উভয়কে নিয়মিত প্রদান করবে।
আইনের ৪(ক) ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, প্রত্যেক সন্তান তাদের পিতার অবর্তমানে দাদা-দাদীকে এবং ৪(খ) মতে, মাতার অবর্তমানে নানা-নানীকে ধারা ৩ অনুযায়ী ভরণপোষণ প্রদানে বাধ্য থাকবে এই ভরণপোষণ পিতা-মাতার ভরণপোষণ হিসাবে গণ্য হবে।
আইনটির ৫ ধারায় পিতা-মাতার ভরণপোষণ না করার দণ্ড সম্পর্কে বর্ণনা আছে। ৫(১) ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, কোন সন্তান কর্তৃক ধারা ৩ এর যে কোন উপ-ধারার বিধান কিংবা ধারা ৪ এর বিধান লংঘন অপরাধ বলে গণ্য হবে এবং উক্ত অপরাধের জন্য অনূর্ধ্ব ৩ মাস কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে। ৫(২) ধারা মতে, কোন সন্তানের স্ত্রী বা ক্ষেত্রমত স্বামী কিংবা পুত্র-কন্যা বা অন্য কোন নিকট আত্মীয় ব্যক্তি ৫(২ক) মতে, পিতা-মাতা বা দাদা-দাদীর ভরণপোষণ প্রদানে বাধা প্রদান করলে বা ৫(২খ) পিতা-মাতার বা দাদা-দাদীর বা নানা-নানী ভরণপোষণ প্রদানে অসহযোগিতা করলে তিনি উক্তরূপ অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করলে গণ্যে উপ-ধারা (১) এ উল্লিখিত দণ্ডে দণ্ডিত হবে।
‘অপরাধের আমলযোগ্যতা, জামিনযোগ্যতা ও আপোষযোগ্যতা’ শিরোনামে ৬ ধারায় বলা হয়েছে, এই আইনের অধীন অপরাধ আমলযোগ্য (cognizable), জামিনযোগ্য (bailable) ও আপোষযোগ্য (compoundable) হইবে।
অপরাধ বিচারার্থ গ্রহণ ও বিচার সম্পর্কে বলা হয়েছে আইনের ৭ ধারায়। ৭(১) ধারায় এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধ ১ম শ্রেণির জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচারযোগ্য হবে। ৭(২) ধারা মতে, কোন আদালত এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধ সংশ্লিষ্ট সন্তানের পিতা বা মাতার লিখিত অভিযোগ ব্যতীত আমলে গ্রহণ করবে না।
৮(১) ধারায় আদালত এই আইনের অধীন প্রাপ্ত অভিযোগ আপোষ নিষ্পত্তির জন্য সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা মেম্বার, কিংবা ক্ষেত্রমত, সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভায় মেয়র বা কাউন্সিলর, কিংবা অন্য যে কোন উপযুক্ত ব্যক্তির নিকট প্রেরণ করতে পারবে। ৮(২) উপ-ধারা (১) এর অধীন কোন অভিযোগ আপোষ নিষ্পত্তির জন্য প্রেরিত হলে, সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান, মেয়র, মেম্বার বা কাউন্সিলর উভয় পক্ষকে শুনানীর সুযোগ প্রদান করে, তা নিষ্পত্তি করে এবং এইরূপে নিষ্পত্তিকৃত অভিযোগ উপযুক্ত আদালত কর্তৃক নিষ্পত্তিকৃত বলে গণ্য হবে।
আইনের ৯ ধারায় সরকারকে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।
মামলা দায়েরের পদ্ধতি:
সন্তান যদি আইন অনুযায়ী পিতা-মাতা বা দাদা-দাদি অথবা নানা-নানিকে ভরণ-পোষণ না দেয় তাহলে তারা তিনটি সংস্থার যেকোনো একটিতে যেতে পারেন- নিকটস্থ থানা, নিকটস্থ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট অথবা জেলা লিগ্যাল এইড অফিস। জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে গেলে লিগ্যাল এইড অফিসার অপর পক্ষকে নোটিশ দিয়ে উপস্থিত করাবেন এবং আপোষ-মীমাংসার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করবেন। আপোষ-মীমাংসা না হলে মামলা করার পরামর্শ দিবেন। তখন ভুক্তভোগী ব্যক্তি থানায় গিয়ে এজাহার দায়ের করতে পারেন অথবা জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে মামলা করতে পারবেন। ভুক্তভোগী ব্যক্তি যদি আর্থিকভাবে অসচ্ছল হন তাহলে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার তার জন্য সরকারি খরচে আইনজীবী নিয়োগ করে দেবেন। ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে মামলা শুরু হওয়ার পরও ম্যাজিস্ট্রেট চাইলে যে কোনো ব্যক্তির নিকট বিষয়টি আপোষ করিয়ে মীমাংসার জন্য পাঠাতে পারেন। আপোষ ব্যর্থ হলে তখন মামলা চলতে থাকবে এবং বিচারে দোষী সাব্যস্ত ব্যাক্তির শাস্তি হবে।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি, পিতা-মাতার ভরণপোষণ বিষয়টি পারিবারিক ও মানবিক ইস্যু। তাই শুধুমাত্র আইন দিয়ে মা-বাবার প্রতি অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার অপরাধ বোধ করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন উচ্চ মাত্রার নৈতিকতা বোধ, ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস এবং তা যথাযথ পালন। প্রয়োজন পারিবারিক, মানবিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করা।
পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন, ২০১৩ এর মূল গেজেটটি দেখতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন –
https://www.dpp.gov.bd/…/downlo…/gazettes/9843_52837.pdf
লেখক: রিসার্চ প্যানেল,School Of Legal Rights. E-mail: schooloflegalrights@gmail.com