সাঈদ আহসান খালিদ:
জামিন আবেদন শুনানি অন্তে কতো সময়ের মধ্যে বিজ্ঞ বিচারক সেটির নিষ্পত্তি আদেশ প্রদান করবেন- বাংলাদেশের আইনব্যবস্থায় এই সংক্রান্ত কোন সুনির্দিষ্ট বিধিবদ্ধ আইনি বিধানের কথা জানা যায় না। শুনানির দিনে জামিন আবেদন নিষ্পত্তি না করে বিজ্ঞ বিচারক যদি সেটির নিষ্পত্তিতে যৌক্তিক কারণে সময় গ্রহণ করেন, সুনির্দিষ্ট বিধিবদ্ধ আইনের অনুপস্থিতিতে এটি বিচারকের judicial discretion বা বিচারিক ইচ্ছাধীন ক্ষমতার অংশ হিশেবে অনুমিত হয়। এটি আইনত বৈধ।
এই judicial discretion কি অসীম ও নিঃশর্ত? আইনের শাসন নীতি অনুযায়ী এটির উত্তর হচ্ছে- না। আইনের শাসনের গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে-
ক. discretion এর অনুশীলন অসীম ও নিঃশর্ত নয়;
খ. discretion কখনো arbitrary বা স্বেচ্ছাচারমূলক হতে পারবে না;
গ. discretion-কে সবর্দাই reasonableness বা যুক্তিগ্রাহ্যতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হওয়া লাগবে।
এই পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হলে বিচারিক ইচ্ছাধীন ক্ষমতার চর্চাও আরবিট্রারি বা স্বেচ্ছাচারিতা গণ্য এবং আইনগতভাবে অবৈধ বিবেচ্য।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শুনানির দিন জামিন সংক্রান্ত আদেশ ঘোষণা না করে অযৌক্তিক বিলম্বে নিষ্পত্তি করা বিচারকের judicial discretionary ক্ষমতার arbitrary অনুশীলন কিনা? বিধিবদ্ধ নির্দিষ্ট আইনের শূন্যতায় এক্ষেত্রে প্রতিটি মামলার পারিপার্শ্বিক ঘটনাপ্রবাহ, আইনবিজ্ঞানের দার্শনিক চেতনা, সর্বোচ্চ আইন- সংবিধানের অন্তর্নিহিত দর্শন ও আইনের শাসন নীতির উপরোক্ত শর্তপূরণ সাপেক্ষে এটির উত্তর নির্ভর করবে।
আইনের স্বাভাবিক দর্শন ও সাংবিধানিক চেতনা দ্রুত বিচার ও প্রকাশ্য প্রতিকার দাবি করে। জামিন শুনানির আদেশ ঘোষণার ক্ষেত্রে স্পষ্ট যৌক্তিক কারণদর্শানো ব্যতিরেকে অতিরিক্ত সময় নেওয়া সেই চিরায়ত দর্শন ও চেতনার পরিপন্থী। কারণ- জামিনের আবেদন নিষ্পত্তির আদেশ রায় ঘোষণার মতো কোন বিষয় নয় যে, সাক্ষ্য পর্যালোচনাপূর্বক বিচারকের সময়ের প্রয়োজন হবে। জামিন পাওয়া এবং দ্রুততম সময়ে পাওয়া অভিযুক্তের স্বাভাবিক আইনি অধিকার, বঞ্চিত হওয়াটাই বরং ব্যতিক্রম। তদুপরি নারী ও অসুস্থ অভিযুক্তের ক্ষেত্রে জামিন পাওয়া একটি আইনি অগ্রাধিকার। জামিনের আবেদন প্রকাশ্যে করা হলে- প্রকাশ্য আদালতেই দ্রুততম সময়ে সেটির নিষ্পত্তি হওয়া প্রত্যাশিত। সংবিধানের ৩৫(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রকাশ্য আদালতে বিচারলাভ এবং দ্রুত বিচারলাভ প্রতিটি অভিযুক্তের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার। যুক্তিসঙ্গত কারণ ব্যতীত জামিন আবেদন নিষ্পত্তির বিচারিক বিলম্ব ন্যায়বিচারকে অস্বীকারের নামান্তর। কারণ- আইনবিজ্ঞানের প্রাথমিক পাঠের একটি হচ্ছে- ‘Justice Delayed is Justice Denied’।
নিম্ন আদালতের বিচারক কৃত এই ধরণের আইনগত বিচ্যুতির ক্ষেত্রে ভারতের উচ্চ আদালতের বিচারিক হস্তক্ষেপের একাধিক উজ্জ্বল নজির রয়েছে যার মধ্য দিয়ে আইনের শাসনের অনন্য দর্শন মূর্ত হয়ে ওঠে।অধস্তন আদালতের বিচারক কর্তৃক জামিন আবেদন নিষ্পত্তির বিলম্বের ঘটনা দৃষ্টিগোচর হলে ২০০৯ সালে বোম্বে হাইকোর্ট অধস্তন আদালতের বিচারকদের উদ্দশ্যে একটি সার্কুলার (circular no.A.1211/2009) জারি করে ‘as expeditiously as possible’ জামিন আবেদন নিষ্পত্তির নির্দেশনা প্রদান করেন।
একই সালে Rasiklal vs Kishore [(2009) 4 SCC 446] মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট পর্যবেক্ষণ প্রদান করেন যে, জামিনযোগ্য মামলায় জামিন দাবি করা ও তাৎক্ষণিক জামিনলাভ করা অভিযুক্তের একটি পরম (absolute) ও অলঙ্ঘনীয় (indefeasible) অধিকার।
২০১৯ সালে কেরালার ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে সন্তোষ কুমার নামের এক ব্যক্তি জামিন আবেদন করলে বিজ্ঞ বিচারক দুই সপ্তাহ বিলম্বের পর সেই আবেদন নিষ্পত্তি করেন। বিষয়টি কেরালা হাইকোর্টের দৃষ্টিগোচর হলে আদালত এই বিলম্ব অযৌক্তিক ঘোষণা করেন এবং এই মর্মে আদেশ প্রদান করেন যে, প্রতিটি জামিন আবেদন শুনানির দিনে অথবা পরদিনে অবশ্যই নিষ্পত্তি করতে হবে, এছাড়া, জামিন আবেদনের উপর ঘোষিত আদেশের কপি ঘোষণার দিনেই আবেদনকারীকে হস্তান্তর করতে হবে।
S.K. Hyder v. The State of Odisha (2019) মামলার রায়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন- ‘Delay in Disposal of Bail Application is Travesty of Justice’।
শেষ কথা- জামিন আবেদনের বিলম্বিত ও অপ্রকাশ্য নিষ্পত্তি জামিন প্রার্থীর ন্যায়বিচার প্রাপ্তির প্রতিবন্ধক, আইনের শাসন ও সংবিধানের চেতনার সাংঘর্ষিক, জামিন আবেদন নিষ্পত্তিতে অযৌক্তিক সময়ক্ষেপণ ন্যায়বিচারকে পরাহত করে। স্মরণ রাখা কর্তব্য- বিচারিক ইচ্ছাধীন ক্ষমতার চর্চা যুক্তিসঙ্গত হওয়ার শর্ত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এ সংক্রান্ত ভারতীয় বিচারিক দর্শন বাংলাদেশের আইনব্যবস্থায় অনুকরণীয় হতে পারে।
লেখক- সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।