লকডাউনের কারণে সংসার আর নিজের চিকিৎসার খরচ নিয়ে চরম বেকায়দায় পড়ে ৩৩৩ নম্বরে প্রতিবন্ধী ছেলের জন্য খাদ্য সহায়তা পাওয়ার আশায় ফোন করেন ফরিদ উদ্দিন। সেই ফোন করাটাই যেন কাল হলো তার।
বাবার রেখে যাওয়া ভবনের তৃতীয় তলার এক পাশের ছাদে টিনসেডের দুটি ছোট্ট কামরায় একমাত্র প্রতিবন্ধী ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করেন ফরিদ উদ্দিন (৫৭)। একটি হোসিয়ারি দোকানে চাকরি করে মাসে ১০ হাজার টাকা বেতনে কোনো মতে চলে তার সংসার। মাস তিনেক আগে ব্রেইন স্ট্রোক করে বাম চোখের দৃষ্টি হারানোর পাশাপাশি কথাবার্তাও খুব একটা গুছিয়ে বলতে পারেন না তিনি। কখনও কখনও দুপুরেই ভুলে যান সকালে কী বলেছেন।
দুই বাড়ি দূরে থাকা স্থানীয় ইউপি সদস্য আইয়ুব আলী ক্ষিপ্ত হয়ে উপজেলা পরিষদ থেকে তদন্তে আসা লোকদের বলেন ফরিদ উদ্দিন একজন ব্যবসায়ী এবং চারতলা বাড়ির মালিক।
এই তথ্য পেয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হাজির হয়ে ১০০ দরিদ্রকে ত্রাণ দিতে নির্দেশ দেন ফরিদ উদ্দিনকে। ত্রাণের এই টাকা যোগাড় করতে নিজের আর ভাইয়ের স্ত্রীর স্বর্ণালংকার বন্ধক দিতে হয়েছে তাকে। কষ্টে আত্মহত্যারও চেষ্টা করেছেন তিনি।
২২ মে (শনিবার) নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার কাশীপুর ইউনিয়নের দেওভোগ নাগবাড়ী এলাকায় গিয়ে এমন তথ্য পাওয়ার পর খোদ উপজেলা প্রশাসন ও গণমাধ্যমকর্মীরা অবাক হয়েছেন। ফরিদ উদ্দিন ৩৩৩ নম্বরে ফোন দিয়ে খাদ্যসামগ্রী চাওয়ার ছলে দুষ্টুমি করেছেন বলে যে সংবাদ ছড়িয়ে পড়েছিল, বাস্তব চিত্র তার পুরোপুরি উল্টো।
২০ মে (বৃহস্পতিবার) ইউএনওর নির্দেশ মতে ১০০ দরিদ্রকে খাদ্য সহায়তা দিতে ফরিদ উদ্দিন রাজি হওয়ায় শনিবার বিকেলে সেই ত্রাণ দিতে এসেছিলেন ইউএনও আরিফা জহুরাসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও। কিন্তু অসুস্থ ফরিদ উদ্দিন, তার স্ত্রী আর বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ছেলেকে দেখে তারাও ‘হকচকিয়ে’ যান। আশ্বাস দিয়ে যান বিষয়টি তারা খুব ভালোভাবেই দেখবেন এবং ফরিদ উদ্দিনের ব্যাপারে ভ্রান্ত তথ্য দেওয়া স্থানীয় ইউপি সদস্যের ব্যাপারেও প্রয়োজনে ব্যবস্থা নেবেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ফরিদ উদ্দিনের বাড়ির সামনের রাস্তায় শত শত মানুষ ভিড় করেছেন। কাশীপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আইয়ুব আলীর নেতৃত্বে তার লোকজন ত্রাণ নিতে আসা মানুষদের লাইনে দাঁড় করানোর কাজে ব্যস্ত। ইউএনওর আসার কথা আছে বলে সেখানে চেয়ার টেবিলও সাজিয়ে রেখেছেন আইয়ুব আলী। অবস্থা দেখে মনে হবে ত্রাণ সহায়তা তিনিই দিচ্ছেন। কিন্তু ওই বাড়ির সামনে গিয়ে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র।
সেই কথিত চারতলা বাড়ির মালিক ফরিদ উদ্দিন, তার স্ত্রী ও প্রতিবন্ধী এক কিশোরকে নিয়ে অসহায়ের মতো এক কোনে কাঁদছেন। কথা বলতে গেলে ভয়ে কিছুই বলছিলেন না। এরপর ফরিদ উদ্দিনের ছোট ভাইয়ের স্ত্রী মূল বিষয়টি বলার পর মুখ খুললেন তারা।
ফরিদ উদ্দিন ও তার স্ত্রী জানান, প্রকৃতপক্ষে প্রতিবন্ধী ছেলের জন্য সরকারের তরফ থেকে অনেক খাদ্য পাওয়ার আশাতেই ৩৩৩ নম্বরে ফোন দিয়েছিলেন ফরিদ উদ্দিন। ফোন করার দুইদিন পর সেখান থেকে তাদের ঠিকানা জানা হয়। এরপর বৃহস্পতিবার তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন ইউএনও আরিফা জহুরাসহ উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
ফরিদ উদ্দিন বলেন, ইউএনও আমাকে বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করলে আমি সত্যটাই বলেছি যে বাড়ির মালিক আমি। তিনি আমাকে বলেছেন- আপনি বৃদ্ধ মানুষ তাই জেল-জরিমানা করলাম না। কিন্তু যেহেতু আপনি সচ্ছল হয়ে খাবার চেয়েছেন তাই ১০০ দরিদ্রকে ত্রাণ দিতে হবে। আমি ভয়ে রাজি হই। কিন্তু সে সময় আমার অবস্থাটা বলতে গেলেও আমাকে স্থানীয় মেম্বার আইয়ুব আলী বলার সুযোগই দেননি। উল্টো ৩৩৩ নম্বরে ফোন না করে উনাকে কেন জানালাম না সেজন্য ধমকাতে থাকেন।
এসব কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন ফরিদ উদ্দিন আর তার স্ত্রী। এ সময় ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল তার প্রতিবন্ধী ছেলেটি।
ফরিদের স্ত্রী বলেন, বাড়িটির মালিক আমার স্বামীর ছয় ভাই ও এক বোন। বাড়িটি পুরোপুরি চারতলাও না, তিন তলার এক পাশে টিনসেড আর আমরা অপর পাশের ছাদে দুটি টিনসেডে ছোট রুম করে থাকি। তিন মাস আগে আমার স্বামী (ফরিদ) স্ট্রোক করে তার বাম পাশের চোখটির দৃষ্টি হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি কথাবার্তাও ঠিকমত বলতে পারেন না, অনেক কিছু মনে রাখতে পারেন না। যে দোকানে কাজ করতেন দয়া করে সেই দোকানের মালিক তাকে এখনও চাকরিতে রেখেছেন।
এই ত্রাণ যোগাড় করতে গিয়ে আমাদের স্বর্ণালংকার বন্ধক রাখতে হয়েছে, ধার করতে হয়েছে। মেম্বার আইয়ুব আলীও আমাদের সুদে ১০ হাজার টাকা ধার দিয়েছেন। গত দুইদিন আমরা ইউএনও আপার কাছে যেতে চাইলেও মেম্বার আমাদের ভয় দেখিয়েছেন যে ত্রাণ দেওয়ার আদেশ না মানলে তিন মাসের জেল হয়ে যাবে।
এদিকে ফরিদ উদ্দিনের সেই ছোট দুই কামরায় গিয়ে দেখা গেল, দুটি ভাঙাচোরা খাট আর পুরোনো কয়েকটি আসবাব ছাড়া কিছুই নেই।
এ ব্যাপারে ইউপি সদস্য আইয়ুব আলী প্রথমে কথা বলতে রাজি হননি। পরে তিনি বলেন, ফরিদ উদ্দিন একজন হোসিয়ারি ব্যবসায়ী, চারতলা বাড়ির মালিক। সে কেন ৩৩৩ নম্বরে ফোন দেবে? আর খাবারের দরকার হলে আমাকে বলতো, আমি স্থানীয় মেম্বার। এটাতো আমার জন্য ‘ডিসক্রেডিট’।
মাত্র দুই বাড়ি পরে থেকেও ফরিদ উদ্দিন প্রতিবন্ধী ছেলে নিয়ে কষ্টে আছেন এমনটি জানলেন না কেন- এমন প্রশ্ন করার পর নিজের বক্তব্য তাৎক্ষণিক ঘুরিয়ে ফেলেন আইয়ুব আলী। তিনি বলতে শুরু করেন, আমি ইউএনও ম্যাডামকে বলেছিলাম ১০ লোককে ত্রাণ দেওয়ার অবস্থা ফরিদের নেই। কিন্তু ততক্ষণে কিছুই করার ছিল না।
অপরদিকে উপজেলা পরিষদের লোকজন তদন্তে আসার পর চারতলার বাড়ির মালিক কেন বলেছেন- এমন প্রশ্ন করলে আইয়ুব আলী উত্তর না দিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের ‘বাড়ি থেকে শরবত বানিয়ে এনেছি, খান’ বলে সটকে পড়েন।
বিষয়টি নিয়ে ইউএনও আরিফা জহুরার কার্যালয়ে গিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকার ৩৩৩ কল সেন্টারের মাধ্যমে অসহায় ও দুস্থদের খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে। কেউ ওই নম্বরে কল করে সংকটের কথা জানালে ইউএনও অফিসে জানানো হয়। পরে তা স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে যাচাই করে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হয়। ফরিদ উদ্দিনের বিষয়টি স্থানীয় ইউপি সদস্য আইয়ুব আলীই প্রথম তথ্য দিয়েছিলেন যে তিনি চারতলা বাড়ির মালিক। পরবর্তীতে আমি যাচাই করতে নিজেই বৃহস্পতিবার সেখানে যাই। ফরিদ উদ্দিনকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি নিজেই স্বীকার করেন ওই বাড়ির মালিক তিনি এবং ৩৩৩ এ ফোন দিলে খাদ্য সহায়তা দেয় কিনা দেখতেই তিনি ফোন দিয়েছিলেন।
তিনি আরও বলেন, আমরা সেখানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করিনি কিন্তু যেহেতু তিনি সচ্ছল বলে জানতে পেরেছিলাম তাই ওনাকে বলেছিলাম যেন তিনি এমন ১০০ দরিদ্রকে সহায়তা করেন। এজন্য তাকে দুইদিন সময়ও দিয়েছি। কিন্তু এর মধ্যে কেউই কিন্তু আমাকে পুরো সত্যটা জানাননি বা ফরিদ উদ্দিনের পরিবার থেকেও কেউ জানাননি।
নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, ফরিদ উদ্দিন যদি সত্যিই অসহায় হয়ে থাকেন তাহলে তাকে সহযোগিতা করা হবে। ত্রাণ সহায়তা দিতে তার যে খরচ হয়েছে সেই অর্থও তাকে ফেরত দেওয়া হবে। দুইদিন সময় পাওয়ার পরও তারা কেন প্রশাসনকে তাদের অসহায়ত্বের কথা জানাননি সেটিও খতিয়ে দেখা হবে।