ঈশপের গল্প ও স্বপ্নের নাম জুডিসিয়ারি

রেজাউল করিম বাঁধন :

ধরে নেই, একটা গাছের গুঁড়িতে ৫০ টি বার কুড়াল দিয়ে আঘাত করে গুঁড়িটি কেটে ফেলা যাবে, আপনি গুঁড়িটি কাটতে চাইলে আপনাকে কুড়াল দিয়ে গাছের গুঁড়িটিকে ঠিক ৫০ টি বারই আঘাত করতে হবে। শুধু স্বপ্ন দেখেই গাছের শক্ত গুঁড়িটি আপনি কাটতে পারবেন না। যদি কোন বিশেষ লক্ষ্য সামনে রেখে আগান এবং যদি আপনি জানেন, সেই লক্ষ্যটিতে পৌঁছাতে আপনাকে ঠিক কতটুকু পরিশ্রম করতে হবে, ঠিক ততটুকু পরিশ্রম করেই আপনাকে সফল হতে হবে। কিন্তু ঐ যে, সবকিছু জেনেবুঝে, নানান রকম মোটিভেশনাল স্পিচ শুনেও বেশিরভাগ মানুষই তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যটিতে পৌঁছাতে পারছে না! কারণ একটাই! আমরা স্বপ্ন পূরণে প্রয়োজনীয় পরিশ্রমটুকু করতে অনাগ্রহী। স্বপ্নের কি তবে কোনই গুরুত্ব নাই? আছে। স্বপ্ন আপনাকে এক্সট্রা মাইল যেতে সাহায্য করবে। পরিশ্রম করে যখন আপনি ক্লান্ত, স্বপ্নের ভূমিকা ঠিক তখনই। স্বপ্ন আপনাকে আর একটু বেশি পরিশ্রম করতে উদ্বুদ্ধ করবে। বাট মূল কাজটি কিন্তু আগে, প্রয়োজনীয় পরিশ্রমটুকু করা। সেটি না করে শুধু আকাশ কুসুম স্বপ্ন দেখে আদতে লাভ নাই।
যতক্ষণ একটা মানুষ নিজের প্রয়োজনটুকু অনুভব না করছে, ততক্ষন সে যথেষ্ট পরিশ্রম করবার মতন তাড়না অনুভব করবে না, এটাই বাস্তবতা। তবে মজার বিষয় হচ্ছে,বেশিরভাগ মানুষ যখন প্রয়োজনটা বুঝতে পারে তখন আর প্রস্তুতির সময় থাকে না । প্রস্তুতিটা আগেই নিয়ে রাখে বুদ্ধিমানরা।

একটা ঈশপের গল্প বলি,
একবার এক হরিণ শাবক বনের মধ্যে দিয়ে যাবার সময় দেখতে পেল , এক গণ্ডার তার নাকের উপর থাকা খড়গটি গাছের গুঁড়ির সাথে ঘষে ঘষে ধার করছিল। গণ্ডারের আত্মরক্ষার সবচাইতে বড় অস্ত্রটি হচ্ছে এই খড়গ বা শিং। তো, হরিণ শাবক গণ্ডারকে খড়গ ধার করতে দেখে বলল , “গণ্ডার মামা তুমি এখন কেন খড়গ ধার করছ ?” গণ্ডার বলল,” যদি শত্রু আসে , তাই আত্মরক্ষার জন্য খড়গ ধার করে নিচ্ছি।“ হরিনশাবক হেসে দিয়ে বলল, “ মামা , শত্রু তো আশেপাশেই নাই, তো এখনই কেন খড়গ ধার করতে হবে?” গণ্ডার উত্তর দিল, “ যখন শত্রু আসবে তখন তো খড়গ ধার করারই সময় থাকবে না।”

জুডিসিয়ারি পরীক্ষা দিয়ে বাংলাদেশের বেষ্ট জবটা আপনি করতে চান! ঠিক এমন চাওয়াটি আপনার মত আরও ৮ থেকে ১০ হাজার পরীক্ষার্থীও চাচ্ছে। সবাই কি সফল হচ্ছে? না। কে সফল হবেন? যিনি পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষার হলে যাবেন। মহামারীর অনিশ্চয়তার কারনে পরীক্ষার ডেট পরছে না বলে আপনি যখন হা হাপিত্যিশ করছেন, বৈশ্বিক গোলযোগ ( যেখানে দোয়া করা ছাড়া আপনার কোন ভূমিকা নাই), ব্যক্তিগত মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব, সামাজিক সমস্যা, নিজের গাফিলতিসহ বিভিন্ন কারনে যখন আপনি পড়ালেখায় ঢিল দিচ্ছেন, ঠিক এই সময়টাতে আপনারই কোন সহ-পরীক্ষার্থী নিজেকে আর একটু ঝালিয়ে নিচ্ছেন। সেকশনগুলো শেষ বারের মতন মেমোরাইজ করছে, কেস রেফারেন্সগুলো আর একটু ঝালিয়ে নিচ্ছে, প্রব্লেমেটিক কোয়েশ্চেনগুলো সল্ভ করছেন।

আর আপনি কি করছেন? এমন অনেক পরীক্ষার্থীকে জানি যারা, কোন রকম প্রস্তুতি না নিয়েই ফরম ফিলআপ করে, এই করোনাকালীন গ্যাপটি পেয়ে হায়েস্ট প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছেন। তারা এই সময়টাকেই আশীর্বাদ মনে করছেন। আর আপনি ভাবছেন, পরীক্ষার ডেট পেলে পরবেন! পরীক্ষা না হওয়ার কারনে আপনি যে মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন , ঠিক একই সিচুয়েশনে আরও ১০ হাজার পরীক্ষার্থীও যাচ্ছে। এর মধ্যেই যারা হাল ধরে থাকবে শক্ত করে, দিনশেষে তারাই বিজয়ী হবে!

চিন্তা করে দেখেন তো, এক সপ্তাহ পর যদি পরীক্ষা হয়, আপনার তার জন্য পূর্ণ প্রস্তুতিটা আছে কিনা? সব সাবজেক্ট এর সব টপিকের “কি পয়েন্টগুলো” চোখের সামনে ভাসছে কিনা? যদি না ভাসে, বুঝবেন আপনার প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হয়নি। তাহলে পরীক্ষা কবে হবে ,এটা দিয়ে আপনি কি করবেন? আর ডেট তো ঠিক আপনার বা অন্য কোন পরীক্ষার্থীর মনমত হবে না! কমিশন যখন সিদ্ধান্ত নিবেন , পরীক্ষা ঠিক তখনই হবে। আপনার আগ্রহ, গ্রুপগুলোতে পরীক্ষার ডেট নিয়ে ঝড় তোলায় কিচ্ছু যাবে আসবে না! বরং আপনি যেটা পারেন, সেই পড়াশোনাটা করতে থাকেন। পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে রাখেন। প্রিলির পড়া শেষ হলে রিটেনের জন্য প্রস্তুতি নিন। গেম চেঞ্জার হচ্ছে রিটেন পরীক্ষা। এখানে যিনি ভাল করবেন, চাকরি হবার সম্ভাবনা তারই বেশি থাকবে। মজার বিষয় হচ্ছে, পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ১০ হাজার হলেও বাস্তববাদী, বুদ্ধিমান,কৌশলী ও পরিশ্রমী পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বড়জোর একহাজার। বাকিরা পরীক্ষা দিচ্ছে মূলত ঝরে পরার জন্যই, যেমন করে বাগানের কিছু ফুলের জন্ম হয় সুবাস ছড়ানোর জন্য, বাকিদের জন্ম শুধুই ঝরে পরবার জন্য। ফলে , ঠিক এই বর্তমান সময়টাতে আপনার নিয়ে রাখা পূর্ব প্রস্তুতিই আপনাকে মেরিট লিস্টে নিয়ে আসবে মূল পরীক্ষায়।
সবাই যখন পড়বে , আপনি তখন তো পড়বেনই, সবাই যখন ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে যাবে, আপনি তখন আর একটু বেশি পড়বেন। পার্থক্যটা গড়ে দেয় মূলত এই অতিরিক্ত পরিশ্রমটুকুই। খড়গটা এখনই ধার করে রাখুন, পরীক্ষার ডেট দিলে আর খড়গ ধার করবার সময় পাবেন না।

 

লেখক : সহকারী জজ, ১১শ বিজেএস।