চন্দন কান্তি নাথ:
জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। পবিত্র সংবিধানের ৩৫(৩) অনুচ্ছেদে আছে ফৌজদারী অপরাধে অভিযুক্ত আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দ্রুত ও প্রকাশ্যে বিচার লাভের অধিকারী হবেন। উক্ত অনুচ্ছেদের দ্রুত বিচার লাভের বিষয়টি স্বাধীনতার পরে এখনো অধরা রয়ে গেছে। ১৮৯৮ সনের ফৌজদারী আইন কোন বাধা তৈরী না করলেও কিছু ধারনা দ্রুত বিচারকে ব্যাহত করছে। সবাই বলেন বৃটিশ আমলের আইন দিয়ে দ্রুত বিচার সম্ভব নয়। কিন্তু বাস্তবে এটি কতটুকু সত্য?
এটিও সবাইকে মেনে নিতে হবে ফৌজদারী কার্যবিধি, সাক্ষ্য আইন, দন্ডবিধি ইত্যাদি নতুন করে করার সক্ষমতাও এই দেশ অর্জন করতে পারেনি।
ফৌজদারী আইন মোতাবেক থানায় কিংবা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের হয়। ম্যাজিস্ট্রেট সরাসরি মামলা আমলে নেন অথবা পুলিশ রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে মামলা আমলে নেওয়া হয়। ১৮৯৮ সনের ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৭ (১) ধারা মোতাবেক ২৪ ঘন্টার মধ্যে ইতদন্ত শেষ করার কথা। পিআরবির ২৬১(সি) প্রবিধান অনুসারে যত কঠিন মামলা হোক না কেন তা ১৫ দিনের মধ্যে শেষ করার বিধান লিপিবদ্ধ আছে। ফৌজদারী কার্যবিধির ১৭২ধারা মোতাবেক পুলিশ তার প্রতিদিনের কার্যক্রম কেইস ডাইরীতে লিপিবদ্ধ করতে বাধ্য। ১৭৩ ধারা মোতাবেক কোন অপ্রয়োজনীয় দেরী পুলিশ করতে পারবেনা। পুলিশ নিদির্ষ্ট সময়ে তদন্ত শেষ করতে না পারলে ফৌজদারী কার্যবিধি, পুলিশ আইন, পিআরবি ও অন্যান্য ফৌজদারী আইন অনুসারে সংশ্লিষ্ট আমল গ্রহনকারী ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা সংশ্লিষ্ট আদালত ব্যবস্থা নিতে পারেন। কিন্তু তারা কোন ব্যবস্থা না নেওয়ায় অনেকের মাঝে ভুল ধারনা হয়েছে যে, মামলা তদন্তের দেরীর জন্য শুধুমাত্র পুলিশই দায়ী।
মামলার প্রসেস যথাসময়ে জারি না হলেও সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারেন। সংশ্লিষ্ট পুলিশ তার দায়িত্ব মোতাবেক ওয়ারেন্ট জারী না করতে পারলে পরবর্তী তারিখে সিআর আরও এর বিধান মোতাবেক এনইআর রিপোর্ট (নন এক্সিকিউটিং রিপোর্ট) প্রদান করতে বাধ্য। পরবর্তীতে আসামী হাজির না হলে আসামীর মালামাল ক্রোক করার জন্য পুলিশের উপর দায়িত্ব পড়ে। সেক্ষেত্রে বাস্তবে সকল আসামিই ফকির হয়ে যায়। তাদের কোন মালামাল থাকেনা। আর সেক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট বিচারক উক্ত রিপোর্ট গ্রহন করে কোনরকম ব্যবস্থা নেন না। নিয়মিত মিটিং, থানা পরিদর্শন এবং বিচারিক আদেশের মাধ্যমে উক্ত কার্যক্রম গুলো সঠিক ও দ্রুতগতিতে নেওয়া যায়। কিন্তু কোনরকম ব্যবস্থা নিতে পারবেননা এটা এমন একটি ধারনা যা দ্রুতবিচারকে ব্যাহত করে।
মামলা বিচারে আসলে ফৌজদারী কার্যবিধির ২৪৪ ধারা মোতাবেক একদিনেই সকল সাক্ষ্য গ্রহণে মামলা নিস্পত্তি করার কথা। ২৪৪ ধারায় আছে, “244..(1) If the Magistrate does not convict the accused under the preceding section or if the accused does not make such admission, the Magistrate shall proceed to hear the complainant (if any), and take all such evidence as may be produced in support of the prosecution, and also to hear the accused and take all such evidence as he produces in his defense :
(1) Provided that the Magistrate shall not be bound to hear any person as complainant in any case in which the complaint has been made by a Court.
(2) The Magistrate may, if he thinks fit, on the application of the complainant or accused, issue a summons to any witness directed him to attend or to produce any document or other thing.
(3) The Magistrate may, before summoning any witness on such application, require that his reasonable expenses, incurred in attending for the purposes of the trial, be deposited in Court.”
উপরোক্ত আইনে সাক্ষীর জন্য কোন ধরনের প্রসেস দেওয়ার কথা নেই। আবার ২৪৪ ধারায়, thinks fit, on the application of the complainant or accused, take all such evidence as may be produced in support of the prosecution, and also to hear the accused and take all such evidence as he produces in his defence. দ্বারা বুঝা যায় ম্যাজিস্ট্রেট প্রসেস দিতেও পারেন,আবার নাও পারেন। সেক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রসেস দেয়াকে সঠিক মনে করতে হয়। তাও আবার অভিযোগকারী অথবা আসামীর দরখাস্তের ভিত্তিতে কোন সাক্ষীকে বা কোন কাগজের জন্য বা অন্য কিছুর জন্য প্রসেস দেওয়ার বিষয়টি বিচারকের সামনে আসে। এটা অটো আসেনা। আবার এরূপ প্রসেস দেওয়ার আগে আদালত উক্ত প্রক্রিয়ার জন্য আদালতে খরচ জমা দিতে বলতে পারেন আর ম্যাজিস্ট্রেটকে একই দিনে রাস্ট্রপক্ষের অথবা আসামীর সাক্ষ্যপর্ব শেষ করতে হয়। আর ২৪৫ ধারা অনুসারে আর কোন সাক্ষী আদালত প্রয়োজন মনে করলে তাদের সাক্ষ্য নিয়ে এবং যদি আদালত মনে করে আসামীকে পরীক্ষা করে তাকে খালাস দিতে পারে অথবা সাজা প্রদান করতে পারেন। আরো লক্ষনীয় যে, ম্যাজিস্ট্রেট আদালত কর্তৃক বিচারমামলায় সেশন আদালতের মতো জাজমেন্ট বা রায় কথাটিই উল্লেখ করা হয়নি। যার অর্থ ম্যাজিস্ট্রেটকে সংক্ষিপ্তভাবেই খালাস কিংবা শাস্তির আদেশ লিখতে হয়।
একইভাবে সেশনআদালতের ক্ষেত্রে ফৌজদারী কার্যবিধির ২৬৫(এফ) ধারায় আছে, “265F.
If the accused refuses to plead, or does not plead, or claims to be tried or is not convicted under section 265E, the Court shall fix a date for the examination of witnesses, and may, on the application of the prosecution, issue any process for compelling the attendance of any witness or the production of any document or other thing.” উক্ত ধারায় May, a date, on the application of the prosecution দ্বারা বুঝা যায় সেশন আদালত প্রসেস দিতেও পারেন, আবার নাও পারেন। সেক্ষেত্রে আদালতকে প্রসেস দেয়াকে সঠিক মনে করতে হয়। তাও আবার রাস্ট্রপক্ষের দরখাস্তের ভিত্তিতে কোন সাক্ষীকে বা কোন কাগজের জন্য বা অন্য কিছুর জন্য প্রসেস দেওয়ার বিষয়টি বিচারকের সামনে আসে। এটা অটো আসেনা। উভয়ক্ষেত্রেই আদালত বা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক নিজ উদ্যোগে বাধ্যতামূলক ভাবে প্রসেস প্রদান করা আইন অনুসারেই সঠিক নয়। আবার ফৌজদারী কার্যবিধির ২৬৫(জি) অনুসারে ধার্য তারিখে প্রসিকিউশন যত সাক্ষী আনয়ন করবে তা নেওয়ার বিধান আছে। উক্ত একটি দিন বা তারিখ ছাড়া প্রসিকিউশনের সাক্ষীর জন্য আর কোন তারিখ রাখার কথা আইনে নেই। শুধুমাত্র ২৬৫(আই) ধারা আসামী দরখাস্তের ভিত্তিতে ন্যায়বিচারের স্বার্থে কোন সাক্ষীকে হাজির হওয়ার জন্য আদালত প্রসেস দিতে পারেন এবং আগত সাক্ষীকে পরীক্ষাপূর্বক যুক্তিতর্ক শেষে মামলার রায় ঘোষণা করা হয়।
কিন্তু সাক্ষীকে প্রসেস না দিলে সাক্ষী কিভাবে আসবে? প্রসেস না দিলে সাক্ষী আসবেনা এই ধারনাটি সঠিক নয়। কেননা সাক্ষী আনার দায়িত্ব আইনে পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। ফৌজদারী কার্যবিধির ১৭১(২) ধারায়আছে “(2) Notwithstanding anything contained in sub-section (1), it shall be the responsibility of the police-officer to ensure that the complainant or the witness appears before the Court at the time of hearing of the case.”
সংশ্লিষ্ট আদালতের কোর্ট পুলিশ আদালত থেকে ধার্য তারিখ গুলো সংগ্রহ করতে পারে এবং শুনানীর ধার্য তারিখ গুলোতে পুলিশ সাক্ষী নিয়ে হাজির হতে পারে। ইতিমধ্যেই পুলিশ রিপোর্টে সকল সাক্ষীদের নাম্বার দেওয়া হয়। মোবাইল নাম্বারের সহযোগিতায় এবং পুলিশের নিকট রক্ষিত পুলিশ রিপোর্ট এবং আদালতের ডাইরী থেকে পুলিশ মামলার তারিখ সংগ্রহক্রমে আইন অনুসারে নির্ধারিত তারিখে সাক্ষী হাজির করতে পারে। আইন অনুযায়ী কার্যক্রম ব্যর্থতায় সংশ্লিষ্ট আদালত বা ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। যাতে করে পুলিশ নিয়মিত সাক্ষী হাজির করেন।
সাক্ষী শেষ হওয়ার পর কিংবা বিচার চলাকালে সংশ্লিষ্ট আদালত আসামীকে কিছু প্রশ্ন করতে পারেন,আবার নাও করতে পারেন। ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় আছে, “ 342.(1) For the purpose of enabling the accused to explain any circumstances appearing in the evidence against him, the Court may, at any stage of any inquiry or trial without previously warning the accused, put such questions to him as the Court considers necessary, and shall, for the purpose aforesaid, question him generally on the case after the witnesses for the prosecution have been examined and before he is called on for his defence.
(2) The accused shall not render himself liable to punishment by refusing to answer such questions, or by giving false answers to them; but the Court 1[* * *] may draw such inference from such refusal or answers as it thinks just.
(3) The answers given by the accused may be taken into consideration in such inquiry or trial, and put in evidence for or against him in any other inquiry into, or trial for, any other offence which such answers may tend to show he has committed.
4) No oath shall be administered to the accused.”
উক্ত ধারায় কিংবা প্রসেস দেওয়া সংক্রান্ত বিধানে May শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। বিচার ব্যবস্থায় May শব্দ দ্বারা May or May not বুঝানো হয়। কিন্তু বর্তমান বিচার ব্যবস্থায় এমনভাবে ৩৪২ ধারা কিংবা অন্য ধারা গুলোর May ব্যবহৃত হয় যেন মনে করা হয় May শব্দ এর পরিবর্তে Shall শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। সংসদ কর্তৃক প্রনীত আইনকে এরুপ ব্যাখ্যা করার সুযোগ নেই।
উপরোক্ত ব্যবস্থায় সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট ১-৫ দিনে এবং সেশন আদালত ১-১৫ দিনে মামলার বিচার কার্যক্রম শেষ করতে পারেন। আমরা জানি যে, আইনের বিধান কার্যকর করার ক্ষেত্রে প্রথমত মূল আইনের দিকে নজর দিতে হয়। তার পর অন্যান্য সোর্সের দিকে নজর দেওয়া হয়। ৩৪২ ধারার কার্যক্রম আইন অনুসারেই যেকোন পর্যায়ে করা যায় এবং আদালত উক্ত প্রশ্নউত্তর পর্ব থেকে ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৪২ (২) ধারা মোতাবেক যেটা ভাল মনে করেন সেটা অনুমান করতে পারেন, নাও করতে পারেন। ৩৪২ ধারা বাধ্যতামূলক কিনা এই বিষয়ে উচ্চ আদালতের পরস্পর বিপরীতমুখি সিদ্ধান্ত বিদ্যমান আছে। তাই শুধুমাত্র ৩৪২ ধারার উপর জোর দেওয়া যায় না।
উপরোক্ত আলোচনার আলোকে এটা বলা যায়। তদন্ত পর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেট বা বিচারক যথাযথ ভূমিকা পালন করলে এবং ফৌজদারী কার্যবিধির ১৭১ (২) ধারা, ২৪৪ ধারা, ২৬৫ (এফ) ধারা এবং ৩৪২ ধারা এর যে ধারনা গুলো রয়েছে তা লাঘবে পর্যাপ্ত বিচারক নিয়োগে পবিত্র সংবিধানের ৩৫(৩) মোতাবেক ভূমিকা রাখলে দ্রুত বিচার নিশ্চিত হবে।
লেখক: সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কুমিল্লা।