বাবা, আমি তো বড় হয়েছি, এখন ট্রাই- সাইকেল আর চালাব না। তুমি বলেছিলে আমার জন্য বাই সাইকেল আনবা!
“এই শুনছো ছেলের কথা। রাসেল বাই -সাইকেল চায়।
আচ্ছা, কাল এনে দিব।”
তুমিতো সকাল হলেই ভুলে যাও। সারাদিন অফিসে থাক আর আংকেলদের সাথে কথা বলো।
দাঁড়াও আমি পেন্সিল আর কাগজ আনছি, তোমাকে লিখে দিচ্ছি ; তুমি তোমার অফিসের কাগজের সাথে নিয়ে যাবে, তাহলে রহমান আংকেল কে বলতে ভুলবে না।
হো হো হাসির শব্দ আছড়ে পড়ে ৩২ নং বাড়ির দোতলার রুমটির চার দেয়ালে। পিতা মুজিব আর মা ফজিলাতুন্নেছার গলা জড়িয়ে ফোকলা দাঁতের হাসিতে বায়না ধরে শিশু রাসেল। শঙ্খশুভ্র বিছানার চাদরে স্যান্ডো গেঞ্জি আর চেক লুঙ্গিতে আয়েশি ভঙ্গিতে বসা পিতা মুজিব ভেবে নেয়, “কাল মুহিত কে একবার বলতে হবে”।
মা পানের বাটাটা টেনে নিতেই বাবা বলে উঠে,”পাইপটা একটু আনো তো।” পাইপে আগুন লাগিয়ে বাবা দিয়াশলাইয়ের আগুন নেভাতে হাতের ঝাঁকুনি দেয়। ঝলসিত পাইপে কুন্ডলী পাকিয়ে উঠে ধোঁয়া আর মা ডান পাশের গালে পুরে দেয় এক কিলি পান। দীর্ঘদিনের জীবনসঙ্গীর পারস্পরিক আলাপচারিতা শুরু হতে না হতেই রাসেলের চোখ জুড়ে নেমে ঘুম আসে রাজ্যের ঘুম।
বিকেল পাঁচটার দিকে শাঁ করে ৩১ নম্বরের অপ্রশস্ত রাস্তা থেকে ৩২ নম্বরে ঢুকেই একেবারে পপাতধরণিতল। গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। …অতঃপর সাইকেলে উঠে লেকপাড়ে উধাও হয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। বিকেলে লেকের পূর্বপাড়ে এমনি করে চক্কর মারছে। ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পূর্বপ্রান্তের সাদা একটি দালান পর্যন্ত সাইকেলারোহীর দৌড়ানোর সীমানা। .এদিকে বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন স্নেহময়ী মায়ের তীক্ষ দৃষ্টি। সীমানা পেরিয়ে দুরে যেতেই, মা দেয় ডাক। সে ডাকেই ঘুম ভেঙ্গে যায় রাসেলের।
বিছানায় মা নেই, বাবাকেও দেখতে পাচ্ছে না রাসেল।চারিদিকে দ্রিম দ্রিম আওয়াজ। ত্রস্তপায়ে সামনে এগিয়ে যায়। মেঝেতে রক্তের মত কি জানি দেখতে পায় রাসেল। ভয়ে হতবিহ্বল ছোট মানুষটি। হরেক কিসিমের মানুষের চিৎকার আর পঁচা কথা শুনে দিকভ্রান্ত রাসেল ছুটতে থাকে। সিঁড়ির দিকে নামতেই রক্তে রঞ্জিত বাবাকে পড়ে থাকতে দেখেই ফুঁপিয়ে উঠে রাসেল। নিচে মুহিত চাচাকে পেয়ে জাপটে ধরে। “আমাকে ওরা মারবে না তো”! আচমকা গোঁফওয়ালা এক লোক শক্ত হাতে রাসেলকে টানতে থাকে চোখ ফেটে কান্না আসলেও শব্দ করে না অবুঝ শিশুটি। করুণভাবে লোকটিকে বলে, “আংকেল আমি মার কাছে যাব”। “চল তোকে মার কাছে নি”। কচি মনে বয়ে যাওয়া অবিশ্বাস্য ঝড়েও বিশ্বাসী মনে মেরুন কালের শার্ট আর হাফপ্যান্ট পরিহিত ছোট রাসেল পিছু নেয় তার। মাকে কাছে পাওয়ার আকুতির এ দহন সাথে সাথে অঙ্গারে পরিণত হল মাকেও নিথর পরে থাকতে দেখে। এবার অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে মিনতি করেছিল ‘আমাকে হাসু আপার কাছে পাঠিয়ে দিন’।
আপার কাছে নেয়ার মিথ্যা প্রতিশ্রুতির খুন রাঙা পথে চোখে পড়ে মা,বাবা ভাই,চাচাদের নিস্তব্ধ ও লাল রঙের দেহগুলি।
অন্য একটা রুমে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে দেয় তুলতুলে শরীরের বাবুটা কে। “আংকেল আমাকে মেরো না। আমাকে ছেড়ে দাও।” কচি মনেও বুঝে আসছে মা আর আঁচল দিয়ে মুখ মুছে দিবে না। মনে পড়ে যায় তার লাল বাই-সাইকেল নিয়ে স্বপ্নের কথা। মনে পড়ে যায় সাইকেল চালানের সময় স্বপ্নে মাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা, বাবার কাঁধে লাফালাফি আর হাসু আপার ভাত খাইয়ে দেয়ার কথা। রহমাান আংকেল আর নীচ- তলায় থাকা সেলিম আংকেল এর পীঠে “ঘোড়ায় চড়া” মনে ভেসে উঠতেই কচলিয়ে উঠে নিস্পাপ অথচ ফুলের কলিরূপ রাসেলের হৃদয় খানি। এত কচি মনে মূহুর্তেই চাপিয়ে দেয়া হাজার কষ্টের ভার নিতে পারা না পারার এক বিরল সন্ধিক্ষণেই একটি বুলেট বিদির্ণ করে নিস্কলুষ হৃদপিণ্ডটিকে। ফিনকি দিয়ে বয়ে যায় লোহিত সাগরের শাখা নদীর একটি বহর। দুর থেকে ভেসে আসছে.. “আসসালাতু খাইরুম মিনাম নাওম”। জন্মজন্মান্তর সমস্ত বাঁধনগুলো নিমিষেই হারিয়ে গেল পৈশাচিক আনন্দে। দেবদূতরূপী শিশু রাসেল মুখ থুবড়ে পড়ে আছে ৩২ নং বাড়ির একটি কোণায় আর আমি আওড়াই কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শিশুরক্ত’ কবিতাটি –
‘তুইতো গল্পের বই, খেলনা নিয়ে
সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন বয়সেতে ছিলি!
তবুও পৃথিবী আজ এমন পিশাচি হলো
শিশুরক্তপানে তার গ্লানি নেই?
সর্বনাশী, আমার ধিক্কার নে!
যত নামহীন শিশু যেখানেই ঝরে যায়
আমি ক্ষমা চাই, আমি সভ্যতার নামে ক্ষমা চাই। ’
লেখক- নজরুল ইসলাম, বিচারক, নোয়াখালী।