আবুজার গিফারী

হিন্দু উত্তরাধিকার ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা 

আবুজার গিফারী :

দীপঙ্কর হিন্দু ধর্মের অনুসারী। তাঁর দীপ্ত ও শুভশ্রী নামে দুটি সন্তান রয়েছে। চন্দনপুর ইউনিয়নে দীপঙ্করের ৫ বিঘা জমি আছে যেটা বছর দুই আগে কার্তিকের থেকে ক্রয় করেন। হঠাৎ দীপঙ্কর তাঁর স্ত্রী শর্মিলা ও দুই সন্তান রেখে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ধর্মান্তরিত হওয়ার দরুণ দীপঙ্করের নাম পরবর্তীতে নাসির উদ্দীন রাখা হয়। ধর্মান্তরিত হওয়ার পর নাসির উদ্দীন মাজিদা নামের এক ভদ্র মহিলাকে বিয়ে করেন। কিছুদিন পর নাসির উদ্দীন ও মাজিদার ঘরে আরাফাত, নাহার ও নুর জাহান নামে তিন সন্তান জন্মগ্রহণ করে। নাসির উদ্দীন তাঁর তিন সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে রতনপুর ইউনিয়নে ৪ বিঘা জমি ক্রয় করেন। হঠাৎ নাসির উদ্দীনের শরীরে ক্যান্সার ধরা পড়লে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি তাঁর স্ত্রী মাজিদা ও তিন সন্তান রেখে মারা যান। প্রশ্ন হলো- বর্তমানে রেখে যাওয়া নাসির উদ্দীনের ৪ বিঘা জমি কি তার পূর্বের (হিন্দু) ঘরের সন্তান দীপ্ত ও শুভশ্রী দাবী করতে পারবে? কিংবা পূর্বের ঘরে রেখা আসা ৫ বিঘা জমি কি বর্তমান (মুসলমান) ঘরের তিন সন্তান দাবী করতে পারবে? অর্থাৎ মৃতের রেখে যাওয়া সম্পত্তি কি তাঁর ধর্মান্তরিত হওয়ার আগের ও পরের সন্তানেরা দাবী করতে পারবে? নাকি ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে পিতা কর্তৃক পৃথক রেখে যাওয়া সম্পত্তি ছাড়া কেউ অন্যের সম্পত্তিতে অধিকার দাবী করতে পারবে না?

হিন্দু-মুসলিম উভয় আইনে সম্পত্তির উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে অভিন্ন নীতি হলো, কেউ যদি ধর্মান্তরিত হয় তবে ঐ ধর্মান্তরিত ব্যক্তি যে ধর্মে ধর্মান্তরিত হবে তার ক্ষেত্রে সেই আইন প্রযোজ্য হবে। এক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তি তার পিতা-মাতার সম্পত্তির উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত হবে। অর্থাৎ ধর্মান্তরিত ব্যক্তিকে উভয় ধর্মে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তবে জাতিচ্যুত এবং ধর্মচ্যুত নিরসনে ১৮৫০ সালে The Caste Disabilities Removal Act,1850 প্রণয়ন করা হয়। কার্যত এই আইন প্রণয়ণের উদ্দেশ্য ছিলো, কোন ব্যক্তি কোন কারণে জাতিচ্যুত বা ধর্মচ্যুত হলে সে তাঁর পিতার উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে না। ১৮৫০ সালের এই আইনটিকে কেউ কেউ ধর্মীয় স্বাধীনতার আইন বলেও মনে করেন। তবে এ আইনটি কেবল হিন্দু উত্তরাধিকারের প্রতিষ্ঠিত নীতিতে মৌলিক পরিবর্তন এনেছে তা নয় বরং এটি মুসলিম উত্তরাধিকার সংক্রান্ত নীতিতেও মৌলিক পরিবর্তন এনেছে। বস্তুত এ আইনে ধর্মান্তরিত এবং বর্ণচ্যুত উভয় ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষিত করা হয়েছে। ১৮৫০ সালের এ আইনটি কোন মৌলিক বা নতুন আইন নয়। কার্যত ১৮৩২ সালে যে Bengal Presidency Regulations প্রণীত হয় ১৮৫০ সালের আইনটি সেটির বর্ধিত সংস্করণ মাত্র। অত্র আইনে বলা হয়েছে, কোন হিন্দু বা মুসলিম ব্যক্তি ধর্মান্তরিত হলে তাঁর ধর্ম এবং প্রথা অনুসারে সে যে সকল অধিকার হতে বঞ্চিত হতো এ আইন কার্যকর হওয়ার পর আর বঞ্চিত হবে না। সুতরাং এই আইন প্রয়োগের ফলে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জৈন বা শিখ ধর্মের কেউ ধর্মান্তরিত হলে সে তাঁর মা-বাবার সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী হবার অধিকার লাভ করেছিল। তবে বর্তমানে অত্র আইনের কার্যকরীতা বিলুপ্ত হয়েছে।

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারী হয়। এই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র আমাদের প্রথম অন্তবর্তীকালীন সংবিধান। এই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসন হতে শুরু করে পাকিস্তান ভূখন্ডে যতগুলো আইন প্রচলিত ছিল তা ২৬ শে মার্চ হতে Retrospective Effect দিয়ে বাংলাদেশের জন্য বৈধতা দেওয়া হয়। ফলে ১৮৫০ সালের আইনও বাংলাদেশে কার্যকর হয়। সাধারণ অর্থে Retrospective Effect বলতে বোঝায়, ‘অতীত তারিখ থেকে কার্যকরভাবে গ্রহণ করা। যেমন: ১৮৫০ সালের আইনটি তৎকালীন মুজিব নগর সরকার ১০ এপ্রিল, ১৯৭১ সালে গ্রহণ করলেও, এই নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে মনে করা হবে, আইনটি ২৬ মার্চ, ১৯৭১ তথা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের দিন থেকেই গ্রহণ করা হয়েছে।’ তবে এই কার্যকরীতা খুব বেশী দিন স্থায়ী হয়নি। কেননা ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার বাংলাদেশ স্বাধীনের পূর্বের প্রচলিত আইনসমূহ পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলশ্রুতিতে ১৯৭৩ সালে Bangladesh Laws Revision and Declaration Act,1973 প্রণীত হয়। অত্র আইনে ২টি schedule বা তফসিল ছিলো। প্রথম তফসিলে বাংলাদেশের ভূখন্ডে প্রচলিত কোন কোন আইনসমূহ বাতিল করা হলো তার তালিকা এবং দ্বিতীয় তফসিলে কোন কোন আইনসমূহ গ্রহণ করা হলো তার তালিকা প্রণয়ন করা হয়। এমনকি কিছু কিছু আইন সংযোজন-বিয়োজন করে  দ্বিতীয় তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, এ আইনের প্রথম তফসিলে যে বাতিলকৃত আইনসমূহের তালিকা দেওয়া হয়েছিলো তার ৮ নম্বর ক্রমে The Caste Disabilities Removal Act, 1850 আইনটি ছিলো। সুতরাং, ১৯৭৩ সালের Bangladesh Laws Revision and Declaration Act, 1973 প্রণয়নের পর হতে ১৮৫০ সালের The Cast Removal and Disabilities Act এর কোন কার্যকরীতা নেই। সুতরাং এখন থেকে হিন্দু বা মুসলিম যে কেউ ধর্মান্তরিত হলে সে সম্পত্তির উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত হবে। এই আইনটি শুধুমাত্র বাংলাদেশে বাতিল করা হয়নি বরং ভারতেও ২০১৭ সালে বাতিল করা হয়েছে। সুতরাং নাসির উদ্দীনের রেখে যাওয়া ৪ বিঘা জমিতে দীপ্ত ও শুভশ্রী কোন প্রকার দাবী করতে পারবে না। একইভাবে নাসির উদ্দীনের মুসলমান ঘরে রেখা যাওয়া সন্তান সন্তুতি তাঁর পিতার পূর্বের সম্পত্তিতে (হিন্দু থাকাকালীন অর্জিত সম্পত্তি) অধিকার দাবী করতে পারবে না। তবে বাজারে প্রচলিত অনেক বইয়ে ১৯৭৩ সালের আইন বিষয়ে আলোচনা না থাকার দরুণ জনমনে এখনো বিভ্রান্ত তৈরী হয় যে, ধর্মান্তরিত হওয়ার ফলে কোন ব্যক্তি স্বীয় উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হয় না। বস্তুত এ সমস্যাটির সমাধান করা তথা প্রচলিত বইয়ে সংশোধন আনা অতিব জরুরী।

উত্তরাধিকার প্রশ্নে হিন্দুদের মধ্যে ২টি মতবাদ প্রচলিত। প্রথমটি দায়ভাগ মতবাদ এবং অন্যটি মিতাক্ষর মতবাদ। দায়ভাগ মতবাদের প্রবক্তা জীমূতবাহন পক্ষান্তরে মিতাক্ষর মতবাদের প্রবক্তা বিজ্ঞানেশ্বর। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ বেশ কিছু রাজ্যে দায়ভাগ মতবাদ প্রচলিত। দায়ভাগ মতবাদে পরিবারের কর্তার মৃত্যুর পর সন্তানেরা উত্তরাধিকারী হয়। অর্থাৎ পিতার মৃত্যুর সাথে সাথে পিতার সম্পত্তিতে পুত্রের অধিকার সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে মিতাক্ষর মতবাদে পুত্রের জন্মের সাথে সাথে পিতার সম্পত্তিতে তাঁরা উত্তরাধিকার হয়। অর্থাৎ পিতার জীবিতকালেই সন্তানেরা সম্পত্তির ভাগ চাইতে পারে। দায়ভাগ মতবাদ অনুসারে উত্তরাধিকার ৩ শ্রেণীর। যথা: সপিণ্ড, সকুল্য ও সমানোদক। সপিণ্ডের সংখ্যা ৫৩ জন যার মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৪৮ এবং নারীর সংখ্যা মাত্র ৫ জন। অন্যদিকে সকুল্য ও সমানোদকের সংখ্যা যথাক্রমে ৩৩ ও ১৪৭ জন। সকুল্য ও সমানোদক শ্রেণীতে কোন মহিলা উত্তরাধিকারী হয় না। অর্থাৎ এ দুই শ্রেণীর মধ্যে সকলেই পুরুষ, কোন নারীর স্থান নেই। আরো সহজভাবে বলা যায়, দায়ভাগ মতবাদে উক্ত তিন শ্রেণীর সমষ্টিতে তথা ২৩৩ জনের মধ্যে মাত্র ৫ জন নারী উত্তরাধিকারী হিসেবে সম্পত্তি পায়। সর্বপ্রথম সপিণ্ড শ্রেণীর ব্যক্তিরা মৃতের সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী হয়। এছাড়া সপিণ্ডের অবর্তমানে সকুল্য এবং সকুল্যের অবর্তমানে সমানোদক উত্তরাধিকারী হয়। তবে এই ৩ শ্রেণীর অবর্তমানে যথাক্রমে ধর্মীয় গুরু বা রাষ্ট্রের অনুকূলে সম্পত্তি চলে যায়। পিতা-মাতা মারা যাওয়ার পর যারা পিণ্ডদানের অধিকারী, তাদেরকে সপিণ্ড বলা হয়। পিণ্ড শুধুমাত্র পুত্র সন্তান দিতে পারে। এছাড়া দাদার পিতার ঊর্ধ্বতন ৩ পুরুষ সকুল্য নামে অভিহিত। অন্যদিকে সকুল্যের ঊর্ধ্বতন ৭ পুরুষ সমানোদক নামে পরিচিত। শ্রাদ্ধের সময় তাদের উদ্দেশ্যে শুধুমাত্র জল নিবেদন করা হয়। সপিণ্ডের সংখ্যা যদিও ৫৩ জন তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট তথা বাস্তবতার নিরিখে প্রথম ২০ জনের তালিকা জানলে সহজে উত্তরাধিকার সংশ্লিষ্ট সমস্যা সুরাহা করা যায়। ২০ জনের তালিকা: (১) পুত্র (২) পুত্রের পুত্র (৩) পুত্রের পুত্রের পুত্র (৪) বিধবা স্ত্রী। এই ৪ শ্রেণী কখনো উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হয় না। তবে বিধবা শুধুমাত্র জীবনসত্ব হিসেবে তাঁর স্বামীর উত্তরাধিকারী হয়। বিধবার মৃত্যুর পর উক্ত সম্পত্তি স্বামীর উত্তরাধিকারীদের উপর বর্তায়। (৫) কন্যা (৬) কন্যার পুত্র (৭) পিতা (৮) মাতা (৯) ভাই (১০) ভাইয়ের পুত্র (১১) ভাইয়ের পুত্রের পুত্র (১২) বোনের পুত্র (১৩) দাদা (১৪) দাদী (১৫) পিতার ভাই (১৬) পিতার ভাইয়ের পুত্র (১৭) পিতার ভাইয়ের পুত্রের পুত্র (১৮) পিতার বোনের পুত্র (১৯) দাদার পিতা (২০) দাদার মাতা ইত্যাদি।

হিন্দু উত্তরাধিকার নির্ণয়ের ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে ৬টি পর্যায় বা ধাপ মনে রাখলে সহজে হিন্দু ব্যক্তির সম্পত্তি তাঁর উত্তরাধিকারী বরাবর বন্টন করা যায়। ধাপগুলো হলো: (ক) প্রথম ৪ শ্রেণীর ব্যক্তি (ক্রম ১-৪) কখনো সম্পত্তি হতে বঞ্চিত হবে না। বরং তারা সবাই সমান অংশ পাবে। যেমন: পবিত্র কুমার বর্মন এক পুত্র, পুত্রের পুত্র ও স্ত্রী রেখে মারা গেলেন। এক্ষেত্রে তাঁরা সকলেই ১/৩ অংশ করে সম্পত্তি পাবে। এক্ষেত্রে যদি প্রথম ৪ জনই উপস্থিত থাকতো তাহলে সবাই ১/৪ অংশ করে সম্পত্তি পেত। কেননা তালিকা ১-৪ এর মধ্যে কেউ বঞ্চিত হয়না। উল্লেখ্য যে, ১৯৩৭ সালের The Hindu Women’s Rights to Property Act প্রণয়নের মাধ্যমে বিধবা স্ত্রী ১ পুত্রের সমান অংশ পায়। অত্র আইন প্রণয়নের পূর্বে বিধবা স্ত্রী সম্পত্তির কতটুকু অংশ পাবে বা আদৌ পাবে কি-না এ বিষয়ে আইনে স্পষ্ট কোন বিধান ছিল না। (খ) প্রথম ৪ শ্রেণীর সকলের অনুপস্থিতিতে নিম্নপর্যায়ের ব্যক্তিরা ক্রমানুসারে সম্পত্তি পাবে এবং বাকীরা বঞ্চিত হবে। যেমন: গৌতম এক কন্যা, মাতা ও পিতা রেখে মারা গেলেন। এক্ষেত্রে গৌতমের সমুদয় সম্পত্তি তাঁর কন্যা পাবে। কেননা কন্যার ক্রম ৫ অন্যদিকে পিতা ও মাতার ক্রম যথাক্রমে ৭ ও ৮। ক্রমের দিক থেকে যেহেতু কন্যা মৃতের পিতা ও মাতার উপরে অবস্থান করছে সেহেতু কন্যা উত্তরাধিকারী হবে এবং পিতা ও মাতা বঞ্চিত হবে। একইভাবে যদি মৃতের শুধুমাত্র ১ কন্যা ও ১ পুত্র থাকে তাহলে কন্যা বঞ্চিত হবে। কেননা ক্রমের দিক থেকে কন্যার আগে পুত্রের অবস্থান। হিন্দু উত্তরাধিকার বন্টনের ক্ষেত্রে এটি অবশ্যই মনে রাখতে হবে, যিনি ক্রমের দিক থেকে প্রথম তিনি সব সম্পত্তি পাবে এবং ক্রমের নিচে থাকা ব্যক্তিরা বঞ্চিত হবে। তবে এ নিয়মটি শুধুমাত্র ক্রম ১-৪ এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। বরং তাঁরা ক্রম অনুযায়ী উপর নিচে থাকলেও সকলেই সমান অংশ পাবে।

(গ) কুমারী কন্যা থাকলে অন্য কন্যারা বঞ্চিত হবে। তবে কুমারী কন্যার অবর্তমানে পুত্রবতী কন্যা ও পুত্রসম্ভবা কন্যা সমান অংশ পাবে। যেমন: প্রদীপের এক কুমারী কন্যা ও এক পুত্রবতী কন্যা আছে। এক্ষেত্রে কুমারী কন্যা সমুদয় সম্পত্তি পাবে এবং পুত্রবতী কন্যা বঞ্চিত হবে। হিন্দু আইনে অসতী, বন্ধ্যা, বিধবা, যেসব কন্যাদের শুধুমাত্র কন্যা সন্তান আছে তাঁরা সম্পত্তি পায় না। যেমন: প্রশান্ত ১ পুত্রসম্ভবা কন্যা, ১ পুত্রবতী কন্যা ও বন্ধ্যা কন্যা রেখে মারা গেলেন। এক্ষেত্রে পুত্রসম্ভবা কন্যা ১/২ ও পুত্রবতী কন্যা ১/২ অংশ করে সম্পত্তি পাবে এবং বন্ধ্যা কন্যা বঞ্চিত হবে। (ঘ) কন্যা পুত্র রেখে মারা গেলে তাঁর পুত্ররা সংখ্যাগুণে সম্পত্তির অংশ পাবে। যেমন: পলি ৩ পুত্র রেখে মারা গেলেন। এক্ষেত্রে তাঁরা সকলেই ১/৩ অংশ করে সম্পত্তি পাবে। যদি পলির ৫ পুত্র থাকতো তাহলে সবাই ১/৫ অংশ করে সম্পত্তি পেতো। অর্থাৎ কন্যা মারা গেলে এবং পুত্র রেখে গেলে কন্যা যে কয়জন পুত্র রেখে যাবে, তাঁরা সবাই সমান অংশ পাবে। (ঙ) ভাইয়ের পুত্র থাকলে কন্যার পুত্রের মতো ভাইয়ের পুত্রগণও সংখ্যাগুনে অংশ পাবে। যেমন: সুকান্ত নিজের সন্তান সন্তুতি, স্ত্রী, পিতা, মাতার অনুপস্থিতিতে ৩ জন ভাইয়ের পুত্র রেখে মারা গেলেন। এক্ষেত্রে তাঁর ভাইয়ের পুত্ররা ১/৩ অংশ করে সম্পত্তি পাবে। উল্লেখ্য যে, কোন ভাইয়ের ৩ পুত্র আবার কোন ভাইয়ের ৪ পুত্র থাকলেও সকল ভাইয়ের পুত্র ১/৭ অংশ করে সম্পত্তি পাবে। অর্থাৎ তাঁরা সকলেই সমান অংশ পাবে। (চ) পুত্রের পুত্র থাকলে তাঁরা তাদের পিতার অংশ অনুযায়ী সম্পত্তি পাবে। যেমন: অনিলের দুই পুত্র  রাম ও শাম। রাম ৩ পুত্র ও শাম ২ পুত্র রেখে মারা গেলেন। এক্ষেত্রে অনিলের সম্পত্তি রামের ৩ পুত্র তাঁদের পিতার অংশটুকু পাবে। অনুরূপভাবে শামের ২ পুত্র তাঁদের পিতার অংশটুকু পাবে। অর্থাৎ রামের ৩ পুত্র ১/৩ অংশ করে এবং শামের ২ পুত্র ১/২ অংশ করে সম্পত্তি পাবে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, কন্যা, কন্যার পুত্র এবং ভাইয়ের পুত্রের যে বিধান এখানে আলোচিত হয়েছে সেগুলো পুত্র, পুত্রের পুত্র, পুত্রের পুত্রের পুত্র বা বিধবার অনুপস্থিতিতে তথা ক্রম/সিরিয়াল অনুযায়ী প্রযোজ্য হবে। যেমন: যদি পুত্র উপস্থিত থাকে তাহলে কন্যা নিয়ে ভাবার যৌক্তিকতা নেই। একইভাবে কন্যা উপস্থিত থাকলে ভাইয়ের পুত্র নিয়ে ভাবার যৌক্তিকতা নেই। অর্থাৎ যদি ক্রমের প্রথম সারির কেউ না থাকে তাহলেই পর্যায়ক্রমে নিচের ক্রমের দিকে আসতে হবে। হিন্দু আইন অনুযায়ী দত্তক পুত্র সাধারণ পুত্রের ন্যায় সম্পত্তি পায়। তবে দত্তক পুত্র গ্রহণ করার পর যদি স্বাভাবিক পুত্র জন্মগ্রহণ করে তাহলে দত্তকপুত্ত সমুদয় সম্পত্তির ১/৩ অংশ পাবে। অন্যদিকে স্বাভাবিক পুত্র বাকী ২/৩ অংশ পাবে। যেমন: গৌরঙ্গ ১ পুত্র ও ১ দত্তক পুত্র রেখে মারা গেলেন। এক্ষেত্রে পুত্র ২/৩ অংশ ও দত্তক পুত্র ১/৩ অংশ সম্পত্তি পাবে। এ নিয়ম বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তবে শূদ্রের ক্ষেত্রে দত্তক পুত্র স্বাভাবিক পুত্রের সাথে সমান অংশ পাবে। অন্যদিকে বেনারস মতবাদ অনুযায়ী দত্তক পুত্র ১/৪ অংশ সম্পত্তি পাবে। এছাড়া বোম্বে ও মাদ্রাজ মতপন্থী অনুযায়ী দত্তক পুত্র ১/৫ অংশ সম্পত্তি পাবে।

হিন্দু আইনে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার কতিপয় কারণ রয়েছে। কার্যত অসতীত্ব, জাতিচ্যুত, ধর্মান্তরিত, কুষ্ঠরোগী, দৈহিক বা মানসিক ত্রুটি (অন্ধ, বোবা, জন্মগত প্রতিবন্ধী, পুরুষত্বহীন ইত্যাদি) সম্পন্ন ব্যক্তিরা উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। বাংলাদেশে সাধারণত পুত্র থাকলে কন্যা কোন সম্পত্তি পায় না। তবে ভারতে ১৯৫৬ সালে Hindu Disposition of Property Act পাশ হওয়ার পর সেখানে এখন পিতার মৃত্যুর পর সম্পত্তিতে পুত্র ও কন্যা সমান অংশীদার। কন্যা, বিধবা এবং অন্যান্য মহিলা উত্তরাধিকারীগণ এখন জীবনসত্ত্বের পরিবর্তে সম্পূর্ণ স্বত্বের অধিকারী হয়। অসতীত্বের কারণে ভারতে এখন কোন মহিলা উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হয় না। বরং তাঁদের যুক্তি হলো, চরিত্রহীন একজন পুরুষ যদি উত্তরাধিকারী হতে বাঁধাপ্রাপ্ত না হয় তাহলে একজন অসতীত্ব নারী কেন উত্তরাধিকারী হওয়ার ক্ষেত্রে বাঁধাপ্রাপ্ত হবে? দীর্ঘদিন পুরুষ শাসিত সমাজে মহিলাদের প্রতি এই বৈষম্যমূলক আচারণ এখন ভারতে আইনগতভাবেই বিলোপ করা হয়েছে। সর্বক্ষেত্রে নর-নারীর সমান অধিকার এই নীতি বাস্তবায়নে ভারতে হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে এক বৈপ্লবিক ও ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। এই আইনবলে ভারতে শারীরিক ও মানসিক অসমর্থতা বা দুরারোগ্য ব্যাধির কারণে এখন আর কেউ সেখানে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হয় না। ১৯৫৬ সালের হিন্দু উত্তরাধিকার আইন এবং ভারত বিভাগের পর হিন্দু আইনের অন্যান্য সংশোধনী ভারতের সকল শ্রেণীর হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মাবলম্বীদের উপর সমানভাবে প্রযোজ্য। হিন্দু আইনের ভারতীয় সংশোধনী বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য নয়। ফলশ্রুতিতে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশে হিন্দু আইন সংস্কারের প্রয়োজন এখন সময়ের দাবী।

লেখক- শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

abujar.gifary.5614@gmail.com