সিরাজ প্রামাণিক:
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) এ ম্যাজিস্ট্রেট নামে কোন পদ নেই। বিসিএস (প্রসাশন) ক্যাডার পদে যাঁরা যোগদান করেন, তারা কিন্তু জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার হিসেবে যোগদান করেন। প্রশাসনিক কাজই তাদের মূল কাজ এবং তাদের পদবী হল সহকারী কমিশনার (প্রশাসন), মোটেই ম্যাজিস্ট্রেট নয়। তবে ফৌজদারী কার্যবিধির ধারা ১০(৫) ধারায় বলা হয়েছে যে, সরকার প্রয়োজন মনে করলে বিসিএস (প্রসাশন) নিযুক্ত কোন ব্যক্তিকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ দান এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দিতে পারবেন। কাজেই বিসিএস (প্রশাসন) এডমিন ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্তরা মোটেই এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট বা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মূল পদ নয় বরং দায়িত্বপ্রাপ্ত দায়িত্ব।
তাঁরা যখন এ দায়িত্বপ্রাপ্ত দায়িত্ব পালন করেন তখন সর্বোচ্চ ২ বছরের কারাদণ্ড যোগ্য অপরাধের বিচার করতে পারেন। তবে অপরাধমূলক কাজটি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সংঘটিত হতে হবে এবং স্বেচ্ছায় অপরাধমূলক কাজটি স্বীকার করতে হবে। নতুবা তিনি কোন প্রকার কারাদন্ডের আদেশ দিতে পারবেন না। এ বিষয়ে ভ্রাম্যমান আদালত আইন, ২০০৯ এর ৬ ধারায় স্পষ্ট করে লেখা আছে। যদিও এ নির্বাহী কর্মকর্তাদের দ্বারা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা ইতিমধ্যে হাইকোর্ট বিভাগ অবৈধ ঘোষণা করেছে। এই রায়ের বিরুদ্ধে মহামান্য আপিল বিভাগে আপিল পেন্ডিং রয়েছে। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, ভ্রাম্যমান আদালদের দেয়া ক্রুটিপূর্ণ ৯৮ ভাগ রায় বাতিল করে দেন দায়রা জজ আদালত। আমরা সবাই জানি, ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় অভিযোগকারী এবং অভিযুক্ত মুখোমুখী বিজ্ঞ বিচারকের সামনে তাঁদের নিযুক্ত আইনজীবী দ্বারা মামলা প্রমাণ বা মিথ্যা প্রমানে আইনি লড়াই করে। উপস্থাপিত সাক্ষ্য প্রমানের আলোকে বিজ্ঞ বিচারক তাঁর সুচিন্তিত এবং সুসিদ্ধান্তিত রায় প্রদান করে। অথচ মোবাইল কোর্ট আইন সেই সকল বিষয়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করছে। মোবাইল কোর্টে বিচার ও দণ্ড প্রদানের প্রাক্কালে কোনো জনসাধরণকে উক্ত স্থানে র্যাব, পুলিশ এবং বিজ্ঞ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কাউকেই থাকতে দেন না। মোবাইল কোর্টের এহেন আচরণ জনসন্মুখে বিচার অস্বীকার করে, যা সংবিধানের ৩৫(৩) অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করে চলেছেন। মানবাধিকার আইনের নীতিমালা মতে, একজন অভিযুক্তকে অবশ্যই নিম্ন লিখিত সুযোগ দিতে হবে।
ক) সুস্পষ্ট অভিযোগ লিখিতভাবে আনতে হবে। খ) অভিযোগ সমর্থনে প্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে। গ) অভিযোগ প্রমাণে সাক্ষীদের জবানবন্দি নিতে হবে। ঘ) অভিযুক্তকে অভিযোগকারী ও তাঁর সাক্ষীদের জেরার সুযোগ দিতে হবে। ঙ) অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য প্রস্তুুতির পর্যাপ্ত সুযোগ ও সময় দিতে হবে। চ) অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আত্মপক্ষ সমর্থনে নিজ পছন্দ মোতাবেক বিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগের এবং পরামর্শ গ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। ছ) আত্মপক্ষ সমর্থনে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সাক্ষ্য ও সাক্ষী উপস্থাপনের সুযোগ দিতে হবে।
তবে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মূল কাজ হল- লাইসেন্স প্রদান, লাইসেন্স বাতিলকরণ, প্রসিকিউশন অনুমোদন বা প্রত্যাহারকরণ ইত্যাদি যেসব কাজের প্রকৃতি প্রশাসনিক বা নির্বাহী ধরণের তা সম্পাদন করা। শুধুমাত্র “ম্যাজিস্ট্রেট” বলতে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে বুঝায়। ফৌজদারী কার্যবিধির ধারা ৪অ(ধ) তে বিষয়গুলি স্পষ্ট করে বলা আছে। কাজেই কেউ যদি পরিচয় দেন “আমি ম্যাজিস্ট্রেট।” ধরে নিতে হবে তিনি জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। কোন এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট নিজেকে শুধুমাত্র “ম্যাজিস্ট্রেট” হিসেবে পরিচয় দিতে পারেন না। কারণ একজন জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের বেতন স্কেল আর যিনি বিসিএসের মাধ্যমে সহকারী কমিশনার (প্রশাসন) হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন, তার বেতন স্কেল এক নয়।
লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা, সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’।
seraj.pramanik@gmail.com