রতন কুমার রায়:
পরিপত্র বাCircular হলো Ministerial written statement of policy মাত্র। কোন আইন নয়। পরিপত্র দ্বারা বিভিন্ন information, guidance ইত্যাদি দেয়া হয়। এটির কোন enforceable legal rights or obligations থাকে না। কারণ এটি Notification নয়। কিন্তু আমরা ভূমি মন্ত্রণালয়ের বিগত ২৯ জুলাই ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের একটি পরিপত্র দেখছি যার মাধ্যমে সহকারী কমিশনার (ভূমি)কে বি. এস. খতিয়ান বা সর্বশেষ জরীপের রেকর্ড বা খতিয়ান (Record of Rights) চূড়ান্তভাবে মুদ্রিত ও প্রকাশিত (Final publication) হওয়ার পর খতিয়ানের কতিপয় ভুল সংশোধনের ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে। ইতিপূর্বে বাংলাদেশ আইন কমিশন উক্তরূপ ক্ষমতা অর্পণসহ দেওয়ানী আদালতের কিছু এখতিয়ার খর্ব করে তা ভূমি প্রশাসনের উপর ন্যস্ত করে বহু মাত্রিক ক্রুটিতে পরিপূর্ণ একটি ভূমি আইনের খসড়া প্রকাশ করেছিল। কিন্তু দেশব্যাপী ব্যাপক সমালোচনার মুখে তা আপাতত স্থগিত হয়ে আছে। বর্তমান পরিপত্রটি কি উক্ত প্রস্তাবিত ভূমি আইনের অংশ বিশেষ বা ধারাবাহিকতা? এ প্রশ্ন জেগেছে আইন অঙ্গনে।
এবার আমরা ভূমি মন্ত্রণালয়ের উক্ত পরিপত্রটি পর্যালোচনা করি। উক্ত পরিপত্রে বলা হইয়াছে State Acquisition & Tenancy Act 1950 এর ১৪৩ ও ১৪৯ ধারা এবং The Tenancy Rules 1955 এর বিধি ২৩ এর ৩ ও ৪ উপবিধি মতে ভূমি প্রশাসন চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত সর্বশেষ খতিয়ানের করণিক ভুল (Clerical Mistake), প্রতারণামূলক অন্তর্ভুক্তি (Fraudulent Entry) ও প্রকৃত ভুল (Bonafide Mistake) সংশোধন করতে ক্ষমতাবান এবং তৎ মতে উক্ত পরিপত্র দ্বারা নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। State Acquisition & Tenancy Act 1950 এর ১৪৩ ধারায় বর্ণিত আছে যে,
- Maintenance of the Record-of-Rights- The Collector shall maintain up-to-date, in the prescribed manner, the record-of-rights prepared or revised under Part IV, [or under this Part] [by correcting clerical mistakes and] by incorporating therein the changes on account of-
(a) the mutation of names as a result of transfer or inheritance;
(b) the subdivision, amalgamation or consolidation of holdings;
(c) the new settlement of lands or of holdings purchased by the Government; and
(d) the abatement of rent on account of abandonment or diluvion or acquisition of land.
State Acquisition & Tenancy Act 1950 এর ১৪৩ ধারা মতে সহকারী কমিশনার (ভূমি) চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত মালিকের সম্পত্তি বা ইহার কোন অংশ বিশেষ নিবন্ধিত দলিল মূলে হস্তান্তরিত হলে কিংবা তার মৃত্যুতে তার ত্যাজ্যবিত্তের সম্পত্তি ওয়ারিশ বা ওয়ারিশরা প্রাপ্ত হলে বা বিভাগ মোকদ্দমা সহ দেওয়ানী মোকদ্দমার রায়-ডিক্রী মূলে ডিক্রী প্রাপ্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের উপর স্বত্ব বর্তালে বা শুধু মাত্র কোনরূপ করণিক ভুল পরিলক্ষিত হলে নামজারী কার্যক্রম (Mutation Proceeding) এর মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত খতিয়ানের অধীনে নামজারী ও জমাভাগ খতিয়ান সৃজনের আদেশ দিতে পারেন। কিন্তু পরিপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী ১৪৩ ও ১৪৯ ধারার অধীনে কোনরূপ প্রতারণামূলক অন্তর্ভুক্তি (Fraudulent Entry) বা প্রকৃত ভুল (Bonafide Mistake) সংশোধন করতে অধিকারী নহেন। এ কথা সত্যি যে, সহকারী কমিশনার Mutation Proceeding এর মাধ্যমে করণিক ভুল (Clerical Mistake) সংশোধন করতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে তারা সে টি করেন না। ফলে ছোট খাট করণিক ভুলের জন্য সাধারণ জনগণকে দেওয়ানী আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়। এতে দেওয়ানী আদালতে মোকদ্দমার চাপ বেড়ে যায়। পরিপত্রের এ দিকটা প্রশংসনীয় ও নিঃসন্দেহে ভালো উদ্দ্যোগ। পরিপত্রে State Acquisition & Tenancy Act, 1950 এর ১৪৯ ধারার ভুল ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হয়েছে। ১৪৯ ধারায় বলা হয়েছে রাজস্ব কর্মকর্তার আদেশের বিরুদ্ধে Collector ও Collector এর আদেশের বিরুদ্ধে বিভাগীয় কমিশনার এবং বিভাগীয় কমিশনার এর আদেশের বিরুদ্ধে ভূমি আপীল বোর্ড Revisional Jurisdiction প্রয়োগ করতঃ আদেশ সংশোধন করতে পারেন। যেভাবে উক্ত আইনের ১৪৭ ধারায় আপীল এখতিয়ারের বিধান বর্ণিত আছে। প্রকৃত পক্ষে ১৪৯ ধারা মতে কোন নতুন কার্যক্রম শুরু করা যায় না। এটি হচ্ছে নিন্মতর পর্যায়ের আদেশের যথার্থতা নিরুপনের একটি প্রক্রিয়া মাত্র।
চ‚ড়ান্ত ভাবে মুদ্রিত ও প্রকাশিত সর্বশেষ খতিয়ানের প্রতারণামূলক অন্তর্ভুক্তি বা প্রকৃত ভুল নিরুপন করতে গেলে একাধিক ব্যক্তির স্বত্ব-স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিরোধ উপজাত হওয়া একটি স্বাভাবিক বিষয়। যা দেওয়ানী বিরোধ হিসেবে গণ্য হয় এবং দেওয়ানী আদালত কর্তৃক বিচার্য হয়। Mutation Proceedings এর মাধ্যমে স্থাবর সম্পত্তি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করা যায় না। এ প্রসঙ্গে মাননীয় হাইকোর্ট এর সিদ্ধান্ত নিন্মরূপ: “Mutation Proceedings are not judicial proceedings in which title to immovable property is determined.” (৩৮ ডি.এল.আর. ২৭৩ পৃষ্ঠা)। উল্লেখ্য যে, উক্ত পরিপত্রের এক অংশে বলা হয়েছে প্রতারণামূলক অন্তর্ভুক্তি ও প্রকৃত ভুল সংশোধন করা কালীন যদি স্বত্ব-স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিরোধ বিদ্যমান বলে প্রতীয়মান হয়, তাহলে মামলা নথিভ‚ক্ত করে আবেদনকারীকে দেওয়ানী আদালতের মাধ্যমে প্রতিকার নিতে পরামর্শ দিতে হবে। এর দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, State Acquisition & Tenancy Act, 1950 সহকারী কমিশনার (ভূমি) কে তদ্রুপ ভুল সংশোধনের ক্ষমতা প্রদান করে নি। যা পরিপত্রে স্বীকারও করা হয়েছে। উক্তরুপ ভুল সংশোধনের জন্য এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে সহকারী কমিশনার কোন কার্যক্রম গ্রহণ করলে তা একদিকে আইনের ব্যত্যয় ঘটবে, অন্যদিকে সহকারী কমিশনার তৎপর দেওয়ানী আদালত-এ দু প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে করতে বিচার প্রার্থী জনগণের সার্বিক ভোগান্তি বাড়বে বৈ কমবে না। সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসের হয়রানীর Open-secret বিষয়টি এখানে না-ই বা বললাম। আর এ জাতীয় এখতিয়ার বহির্ভূত সুযোগে এক শ্রেণীর ভূমিদস্যু বা দুষ্ট প্রকৃতির লোক নিরীহ মানুষকে হয়রানী করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হবে। প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তার ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের সমূহ সম্ভাবনাও থাকবে। The Tenancy Rules 1955 মূল আইন নহে। মূল আইনের কোন বিধানকে কার্যকর করার জন্য Rules বা বিধি প্রণয়ন করা হয়। বিধিতে মূল আইনের পরিপন্থি বিধান করা যায় না। তেমনি The Tenancy Rules 1955 হলো State Acquisition & Tenancy Act, 1950 এর অধীনে একটি Rules মাত্র। তাই মুল আইনের বিধান ছাড়া শুধুমাত্র বিধির আলোকে পরিপত্রে বর্ণিতমতে সহকারী কমিশনার (ভূমি) কে খতিয়ানের প্রতারণামূলক অন্তর্ভুক্তি ও প্রকৃত ভুল সংশোধনের ক্ষমতা অর্পন করা যায় না।
খতিয়ানের ভুল লিপি হলো একটি ভুল জরীপের ফলাফল। যার প্রেক্ষিতে প্রচুর দেওয়ানী বিরোধ আছে। সহকারী কমিশনার (ভূমি) কর্তৃক অন্তত খতিয়ানের করণিক ভুল (Clerical Mistake) নামজারী কার্যক্রমের মাধ্যমে সংশোধন করা হলে জনগণের ভোগান্তি অনেকাংশে লাঘব হবে এবং দেওয়ানী আদালতে মোকদ্দমার চাপও কমবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। অপর দিকে আইনী শিক্ষা (Law Background) ছাড়া প্রশাসনিক কর্মকর্তা দ্বারা প্রতারণামূলক অন্তর্ভুক্তি বা Fraudulent Entry এবং প্রকৃত ভুল বা Bonafide Mistake (যা হতে স্বত্ব-স্বার্থ সংশ্লিষ্ট দেওয়ানী বিরোধ উপজাত হতে বাধ্য) সংশোধন করার ক্ষমতা অর্পনের সিদ্ধান্ত হবে চরম আত্মঘাতী। এর দ্বারা জনগণের ভোগান্তি বাড়বে এবং দেওয়ানী আদালতের এখতিয়ার ক্ষুন্ন হবে। এ সিদ্ধান্ত বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ ও স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপের সামিল।
লেখক- অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট এবং সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি।