অ্যাডভোকেট মোঃ সাজিদুর রহমান (শুভ):
সাধারন ভাষায় তামাদি আইনকে বলা হয় শান্তির আইন। তামাদি আইনকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আইনও বলা যায়। তামাদি আইন বলতে সেই আইনকে বুঝায়, যে আইনের দ্বারা আদালতে মামলা, আপীল বা অন্য কোন প্রকার দরখাস্ত দায়েরের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়।
তামাদি আইনে ‘তামাদি’ একটি আরবি শব্দ যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ‘বিলুপ্ত হওয়া’ বা ‘অতিক্রান্ত হওয়া’ অর্থাৎ ‘তামাদি’ বলতে বুঝায় যেখানে দাবির নির্ধারিত কাল বিলুপ্ত হয়েছে বা অতিক্রান্ত হয়েছে। 21 DLR (SC) 139 A. Ali Vs. District Judge মামলায় আদলত ‘তামাদি’ শব্দটি সম্পর্কে অভিমত প্রদান করেন যে – তামাদি আইনে নির্দিষ্ট মামলার জন্য যে নির্দিষ্ট সময়সীমা আইনে উল্লেখ আছে তার মাঝে মামলা দায়ের করতে না পারলে আদালত ঐ সমস্ত মামলা বাধ্যতামূলক খারিজ করে দিবেন। নির্দিষ্ট সময় পর মামলা, আপীল বা দরখাস্ত দায়ের এবং আদালত হতে তা বাধ্যতামূলক খারিজ হবার এই প্রক্রিয়াকেই সংক্ষেপে ‘তামাদি’ বলা হয়। তামাদি আইনের উদ্দেশ্য স্পষ্ট করার জন্য AIR 1973 (SC) 2537 Rajendra Vs. Shanta মামলায় আদালত বলেন যে – কোন তর্ক, প্রশ্ন এবং বিবাদকে অনন্তকাল বাচিয়ে রাখা মানুষ্য সমাজের পক্ষে নিতান্তই ক্ষতিকর। উপরন্ত সামাজিক শৃঙ্খলার কারণে এক সময় তাহার উপর ছেদ টানতে হয় এবং তামাদি আইন সেই ছেদে টানার ব্যবস্থা করে। সেই সাথে AIR 1972 (SC) 1935 New Delhi Vs. Employes Asso. মামলায় আদালত আরো অভিমত দেন যে- তামাদি আইন শক্ত ভাবে দেওয়ানী প্রতিকারে বাধা প্রদান করে। তামাদি আইন কখনই কোন ব্যক্তিকে মামলা করিতে বলে না, তবে তামাদি আইন ঘোষণা করে যে, একটি বিশেষ সময়সীমা অতিক্রান্ত হবার পর আর মামলা করা চলবে না।
আমাদের তামাদি আইনের ইতিহাসের দিকে আলোকপাত করলে দেখা যায় তামাদি আইন উপমহাদেশে প্রথম প্রণীত হয় ১৭৯৩ সালে। যা ইংরেজ লর্ড চার্লস কর্নওয়ালিস প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু সে সময়ের তামাদি আইন সঠিক ভাবে বিধিবদ্ধ ছিলো না। প্রথম প্রণীত হবার ৬৬ বছর পর ১৮৫৯ সালে তামাদি আইন বিধিবদ্ধ হয় এবং বিধিবদ্ধ আইনটি ১৮৬২ সালে কার্যকর করা হয়। এরপর তামাদি আইনের ব্যাপক পরিবর্তন পরিমার্জন করে ১৯০৮ সালের ৭ই আগস্ট পুনরায় প্রকাশ করা হয় এবং যা কার্যকর হয় ১৯০৯ সালের ১ জানুয়ারী থেকে। বর্তমান তামাদি আইনের ধারা ১ অনুসারে এই আইন ১৯০৮ সালের ৯ নং আইন বলে পরিচিত। বর্তমান তামাদি আইন সর্বশেষ সংশোধিত হয়েছে ২০০৪ সালের ২৮ নং আইন দ্বারা। যেখানে তামাদি আইনের ১ম তফসিলের ১১৩ এবং ১১৪ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হয়।
সমগ্র তামাদি আইন মূলত ৫টি খন্ডে বিভক্ত। যেখানে কার্যকর ২৯টি ধারা এবং ১টি তফসিল রয়েছে। প্রথমে তামাদি আইনে মোট ধারা সংখ্যা ছিলো ৩২টি কিন্তু বর্তমানে বলবৎ আছে ২৯টি। তেমনি তামাদি আইনে ৩টি তফসিল থাকলেও কার্যকর আছে ১ম তফসিল।
তামাদি আইনের ২৯টি ধারার মধ্যে ৩ থেকে ২৫ ধারায় তামাদির মেয়াদ গণনার পদ্ধতি, নির্ধারিত সময়ের পর মামলা দায়েরের ফলাফল এবং তামাদির বিলম্ব মওকূফ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ২৬ থেকে ২৮ ধারায় আলোচনা করা হয়েছে প্রেসক্রিপশন বা কোন কিছু নতুন করে অর্জন সম্পর্কে। তামাদি আইনের ধারা গুলোর দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় এই আইনের ২৬ ও ২৮ ধারা ব্যতীত বাকি সব ধারা হচ্ছে Procedural Law এবং ২৬ ও ২৮ ধারা হচ্ছে Substantive Law । সেই সাথে তামাদি আইনের ১ম তফসিলে ১৮৩ টি অনুচ্ছেদ আছে যা ৩টি খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খন্ডে মামলা দায়েরের সময় সম্পর্কে (১-১৪৯) টি অনুচ্ছেদ, দ্বিতীয় খন্ডে আপীল দায়েরের সময় সম্পর্কে (১৫০-১৫৭) টি অনুচ্ছেদ এবং তৃতীয় খণ্ডে আবেদন/দরখাস্ত দায়েরের সময় সম্পর্কে (১৫৮-১৮৩) টি অনুচ্ছেদ রয়েছে।
তামাদি আইনের আইনগত বিশ্লেষণ:
তামাদি আইনের আইনগত বিশ্লেষণ শুরু হয় এই আইনের প্রস্তাবনা থেকে। যেখানে উল্লেখ আছে, ‘’দেওয়ানী মামলার সময় বিষয়ক আইন একীভূত ও সংশোধন করণার্থে ও অন্যান্য লক্ষ্যে প্রণীত আইন’’। যা থেকে স্পষ্ট ধারনা হয় তামাদি আইনের সৃষ্টি হয়েছে দেওয়ানী বিবাদের সময় নির্ধারণ করে দেয়ার জন্য। সে জন্য সমগ্র তামাদি আইনে বিভিন্ন প্রকার দেওয়ানী বিবাদের স্পষ্ট সময়সীমা উল্লেখ করা হয়েছে। সেই সাথে উল্লেখ করা হয়েছে দেওয়ানী এবং ফৌজদারী আপীল দায়েরের সময় সম্পর্কে এবং বিভিন্ন প্রকার দরখাস্ত বা আবেদন দায়ের সময় সীমা সম্পর্কে।
সাধারণত মূল মামলায় তামাদির মেয়াদ গণনা শুরু হয় Cause of action বা মামলার কারণ উদ্ভবের সময় থেকে এবং তামাদি মেয়াদ গননা করা হয় বাদীর বিরুদ্ধে। বিবাদী মূল মামলায় তামাদিতে দূষিত হয় না।
তামাদি আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, বাদীর করা কোন মামলায় বিবাদী যদি আদালতে তামাদীর প্রশ্ন নাও তুলে তারপরেও মামলা খারিজ হবে যদি বাদী এই আইনের ধারা ৪-২৫ এবং ১ম তফসিলের নির্ধারিত সময়ের মাঝে আদালতে মামলা উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়। এই ধারাতে আইনের ‘Equity aids the vigilant not the indolent’ নীতির প্রকাশ পেয়েছে অর্থাৎ যিনি সতর্ক আছেন তার জন্যই ইকুইটি প্রাপ্য; যিনি তার অধিকার আদায়ে উদাসীন তার জন্য ইকুইটি নয়। 20 DLR (West Pakistan) 133 মামলায় আদালত তামাদি আইনের ৩ ধারা সম্পর্কে বলেন যে, মামলা করার সময় অতিবাহিত হয়ে গেলে উক্ত মামলা খারিজ হয়ে যাবে আর এইক্ষেত্রে আদালত কর্তৃক আরজি প্রত্যাহারের আদেশও মামলা খারিজ বলে গন্য হবে। আর অনুরূপ মামলার বিষয়বস্তু বা কারণের উপর পরবর্তীতে আনীত একই পক্ষগণের মধ্যে রেসজুডিকাটা দ্বারা বারিত হবে। সহজ ভাষায় বলা যায়, তামাদি আইনের ৩ ধারায় কোন মামলা বাধ্যতামূলক খারিজ হলে সে ক্ষেত্রে দেওয়ানী কার্যবিধি, ১৯০৮ এর ১১ ধারার রেস জুডিকাটার বিধার প্রযোজ্য হবে।
তামাদি আইনের ৪ ধারায় বলা হয়েছে, মেয়াদ অতিক্রান্তের সময় আদালত যদি বন্ধ থাকে এবং ঐ বন্ধের সময় যদি তামাদির মেয়াদ শেষ হয়ে যায় সেই ক্ষেত্রে পরবর্তী প্রথম কার্য দিবসে অর্থাৎ আদালত খোলার দিন উক্ত মামলা, আপীল কিংবা দরখাস্ত দায়ের করা যাবে। যদি বিচারক ছুটিতে থাকেন তবে সেদিনও আদালত বন্ধ বলে ধরা হবে। এই সম্পর্কে AIR 48 Mad 521 মামলায় উচ্চ আদালত অভিমত দেন যে, সপ্তাহে যে দিন বিচারক বসিবেন, ঠিক সেই দিনগুলিতে মামলার আরজি, আপীল ও আবেদন সমূহ গ্রহণ করা হইবে। যদি ছুটির দিন সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপনে মাধ্যমে বিচারক আদালতে বসেন তবে সে দিন আদালত বন্ধ নয় বলে ধরতে হবে।
তামাদি আইনের কঠোরতা লাঘবের জন্য এই আইনে যুক্ত করা হয়েছে ‘কতিপয় বিশেষ ক্ষেত্রে মেয়াদ বৃদ্ধিকরণ’ শিরোনামে ৫ ধারা। যেখানে বলা হয়েছে, কোন পক্ষ শুধুমাত্র আপীল, রিভিউ, রিভিশন, লিভ টু আপীল এবং বিভিন্ন প্রকার দরখাস্ত দায়েরে ক্ষেত্রে তামাদির সময় বৃদ্ধি করার আবেদন করতে পারে। এই সকল আবেদন করার সময় উল্লেখ করতে হবে ‘কেন সঠিক সময় আবেদন দায়ের করা যায়নি তার কারণ’। আদালত উক্ত ‘কারণ’ বিবেচনায় নিয়ে সন্তুষ্টচিত্তে ক্ষেত্র বিশেষে সময় বৃদ্ধির আবেদন মঞ্জুর করতে পারেন। তবে মূল মামলার ক্ষেত্রে তামাদি আইনের ৫ ধারা কখনো গ্রহণযোগ্য হয় না। এই ৫ ধারায় মূলত ’Equity will not suffer a wrong to be without a remedy’- অর্থাৎ ‘ইকুইটিতে ভুলের প্রতিকার বিদ্যমান’ নীতির প্রকাশ পেয়েছে। তামাদি আইনের ৫ ধারার বক্তব্য বুঝার জন্য এই ধারার ব্যাখ্যা অংশে বলা আছে- হাইকোর্ট বিভাগের কোন আদেশ, প্রথা কিংবা সিদ্ধান্তের দ্বারা তামাদির সময়কাল হিসাব কিংবা নির্ধারণে বিভ্রান্ত হলে তা বর্তমান ধারা অনুযায়ী ‘যথার্থ কারণ’ বলে বিবেচিত হতে পারে। তবে বর্তমান আইনে বা আরও যেসব আইনে ‘যথার্থ কারণ/Sufficient cause’ শব্দগুলি ব্যবহার করা হয়েছে সে সকল কোন আইনেই শব্দ গুলোর ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। উচ্চ আদালতের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত থেকে বলা যায় ১.অসুস্থতা (অবশ্যই গুরুতর বা মারাত্মক) ২.কারাবাস ৩.সরল বিশ্বাসে ভুল ৪.কৌসুলি বা উকিলের ভুল ৫.আদালতের সংঘাতপূর্ণ সিদ্ধান্ত ৬.রায় বা ডিক্রি তুলতে আদালতের কর্মচারীর ভুল ইত্যাদি ‘যথার্থ কারণ/Sufficient cause’ হিসেবে আদালত বিবেচনায় নিতে পারে। তবে কোন ভাবেই এই ৫ ধারার সময় বৃদ্ধির আবেদন কোন পক্ষ অধিকার হিসেবে আদালতে দাবি করতে পারবে না।
তামাদি আইনের ৬,৭,৮ এবং ৯ ধারায় আইনগত অপারগতার নিয়ম উল্লেখ করা হয়েছে। তামাদি আইনের ৬ ধারায় বৈধ অপারগতা (Legal disability) নিয়ে সরাসরি আলোচনা করেছে। যেখানে বলা আছে, যে ক্ষেত্রে মামলা কিংবা কার্যব্যবস্থা কিংবা ডিক্রি জারিরি জন্য কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে তামাদি মেয়াদ গণনা শুরু হয় সেই সময় উক্ত ব্যক্তি যদি নাবালক, উন্মাদ বা চরম বুদ্ধিহীনতার রোগে ভুক্তে থাকে তবে তার বিরুদ্ধে তামাদি মেয়াদ গণনা স্থগিত থাকবে। যখন উক্ত ব্যক্তির জীবন হতে অপারগতা অবসান হবে তখন তামাদি মেয়াদ গণনা আরম্ভ হবে। যদি একটি অপারগতা অবসান হবার আগেই আরেকটি অপারগতায় উক্ত ব্যাক্তি আক্রান্ত হন তবে দুটি শেষ হবার পর তামাদি মেয়াদ গণনা শুরু হবে। এর মাঝে যদি উক্ত ব্যাক্তি মৃত্যুবরণ করে তাহলে তার আইনগত প্রতিনিধির উপর তামাদি মেয়াদ গণনা শুরু হবে। তার আইনগত প্রতিনিধি যদি বৈধ অপারগতায় আক্রান্ত থাকেন তবে প্রতিনিধির আইনগত অপারগতা অবসান হবার পর তামাদি মেয়াদ গণনা আরম্ভ হবে। তামাদি আইনের ৬ ধারার এই বিধান আপীল, রিভিউ, রিভিশন বা আবেদন ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না। বৈধ অপারগতার বিধান শুধুমাত্র বাদী’র ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বিবাদী’র জন্য তামাদি আইনে বৈধ অপারগতার বিধান গ্রহণযোগ্য না।
এরপর ধারা -৭ উল্লেখ করে, একাধিক বাদী অথবা দরখাস্তকারীর মধ্যে একজন বা কয়েকজনের অপারগতা সম্পর্কে। যেখানে বলা আছে, যদি এক বা একাধিক বাদী বৈধ আপারগতায় আক্রান্ত হয় এবং তার বা তাদের অনুমতি ছাড়া আইনগত কার্যধারা পরিচালনা করা সম্ভব নয় সেই ক্ষেত্রে সকলের বিরুদ্ধে তামাদি মেয়াদ গণনা স্থগিত থাকবে। কিন্তু বৈধ অপারগতায় আক্রান্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের অনুমতি ছাড়া আইনগত কার্যধারা পরিচালনা করা যদি সম্ভব হয় তাহলে সেই ক্ষেত্রে তামাদি মেয়াদ গণনা যথাযথ ভাবে চলবে।
ধারা ৬ এবং ধারা ৭ এর বৈধ অপারগতার ব্যতিক্রম ধারা হচ্ছে ৮ ধারা। যার শিরোনাম ‘Special exceptions’। যেখানে বলা আছে, অগ্রক্রয়ের অধিকার কার্যকরের মামলায় ৬ এবং ৭ ধারার বৈধ অপারগতার অজুহাত গ্রহণযোগ্য হবে না এবং বৈধ অপারগতা অবসানের পর তামাদি মেয়াদ সাপেক্ষ তার মেয়াদ ৩ বছরের অধিক হবে না।
সেই সাথে তামাদি আইনের ৯ ধারা উল্লেখ করে- ‘’একবার তামাদি সময়কাল অতিবাহিত হতে শুরু করলে পরবর্তী কোন অপারগতা কিংবা আযোগ্যতা দ্বারা তা বন্ধ করা যাবে না’’।
তামাদি আইনের ১০ ধারায় বলা আছে, ট্রাস্টী ও তাদের এজেন্টবৃন্দের প্রতিকূলে মামলা সম্পর্কে। ট্রাস্টী বা এজেন্টের উপর যে সম্পত্তি অর্পিত হয়েছে সেই সম্পত্তির হিসেব বা লাভ্যাংশ আদায়ের জন্য এই আইনে কোন প্রকার তামাদি মেয়াদ গণনা করা হবে না। এই সম্পর্কে 23 DLR (SC) 81 Nayem Vs. Bashir মামলায় উচ্চ আদালত অভিমত দেন – তামাদি আইনের প্রয়োগ সব ক্ষেত্রে নাই। যেসব ক্ষেত্রে এই আইনের প্রয়োগ নাই তার মাঝে ট্রাস্ট সম্পত্তির উপকার উদ্ধার করার মামলা অন্যতম। যাহার উপর ট্রাস্ট সম্পত্তির পরিচালনারভার ন্যস্ত, তিনি ঐ সম্পত্তি নিজের ব্যবহারে পরিণত করলে তার বিরুদ্ধে যে কোন সময় মামলা দায়ের করা যায়।
তামাদি আইনের ১১ ধারার বিষয় বস্তু হচ্ছে বিদেশে অনুষ্ঠিত চুক্তির উপর তামাদি আইনের প্রভাব নিয়ে। বিদেশে অনুষ্ঠিত চুক্তি নিয়ে যদি বাংলাদেশের আইন আদালতে মামলা হয়, তবে তামাদি আইনে যেরকম বিধান আছে সেই ক্ষেত্রেও একই বিধান প্রযোজ্য হবে। সেই সাথে বিদেশের আদালতে তামাদির বিধান যেমনি থাকুক তা বাংলাদেশের আইন আদালতে গ্রহণযোগ্য হবে না।
তামাদি আইনে তামাদির মেয়াদকাল কখন থেকে শুরু হবে, কখন শেষ হবে, কোন সময় গুলো তামাদি মেয়াদ থেকে বাদ যাবে ইত্যাদি সকল কিছু নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে তামাদি আইনের তৃতীয় খন্ডে। যার শিরোনাম- (Computation of period of Limitation) যেখানে ১২ থেকে ২৫ ধারা বিদ্যমান। নিচে এই সম্পর্কিয় আলোচনা তুলে ধরা হলো-
তামাদি আইনের ১২ ধারায় বলা আছে, আইনানুগ কার্যক্রমে যে সময় গুলো বাদ দিতে হবে সেই সম্পর্কে। আপীল, লিভ টু আপীল, রিভিউ, রিভিশন ইত্যাদির ক্ষেত্রে যে ডিক্রী বা আদেশের জন্য এমন আবেদন করা হচ্ছে তা প্রচারের দিন এবং উক্ত ডিক্রী বা আদেশের সইমুহূরী নকল উত্তলনের সময় তামাদি মেয়াদ গণনা থেকে বাদ দিতে হবে। মূল মামলার ক্ষেত্রে যে দিন মামলার কারণ উদ্ভব হয়েছে সেই দিনটিও বাদ দিয়ে তামাদি মেয়াদ গণনা আরম্ভ করতে হবে।
১৩ ধারায় বলা হয়েছে বাংলাদেশের বাইরে হতে বিবাদীর অনুপস্থিতির সময় কাল তামাদির সময় থেকে বাদ যায়। এ ধারা শুধু বিবাদীর বৈধ অক্ষমতাকেই নির্নয় করে।
১৪ ধারায় বলা হয়েছে, এখতিয়ারবিহীন আদালতে অর্থাৎ ভুল আদালতে সৎ উদ্দেশ্যে মামলা দায়ের করলে সেই মামলায় যে সময় ব্যয় হবে তা তামাদি মেয়াদ থেকে বাদ যাবে। তবে এখানে অবশ্যই With due diligence এবং Good faith প্রমাণ করতে হবে। কোন বিশেষ আইনের ক্ষেত্রে তামাদির বিধান উল্লেখ থাকলে সে আইনে মামলার ক্ষেত্রেও Limitation Act-এর ১৪ ধারার বিধান প্রযোজ্য হবে। 6 ADC 488, 2 BLC (HCD) 262 পৃষ্ঠায় প্রকাশিত মামলায় কোন বিশেষ আইনের ক্ষেত্রে Limitation Act এর ১৪ ধারার বিধান প্রযোজ্য হবে মর্মে আলোচনা করা হয়েছে।
১৫ ধারায় বলা আছে, আদালতের নির্দেশে যদি নির্দিষ্ট কোন বিষয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা বা স্থগিতাদেশ থাকে তবে সেই সময় তামাদি মেয়াদ গণনা থেকে বাদ যাবে। এবং যে সকল মামলার ক্ষেত্রে অপর পক্ষ বা কোন অথরিটি কে নোটিশ প্রদানের বিধান থাকে তবে নোটিশে উল্লেখ করা সময় তামাদি মেয়াদ গণনা থেকে বাদ দিতে হবে।
তামাদি আইনের ১৬ ধারা নিলাম বিক্রয় সম্পর্কে। যেখানে বলা আছে, ’ডিক্রি জারির জন্য কোন সম্পত্তি বিক্রয়’ অর্থাৎ নিলাম বিক্রয় রদ করার জন্য মামলা দায়ের করা হলে, মামলা যতদিন চলবে সেই সময় নিলাম গ্রহিতার বা যিনি নিলাম কিনেছেন তার উক্ত সম্পত্তি উদ্ধারের জন্য মামলা করার প্রয়োজন হলে নিলাম রদ করার মামলায় যে সময় ব্যয় হয়েছে তা তামদি মেয়াদ থেকে বাদ যাবে।
মামলার অধিকার সৃষ্টি হবার পূর্বে কারো মৃত্যু হলে তামাদি আইন কেমন আচরণ করবে সেই সম্পর্কে বলা আছে তামাদি আইনের ১৭ ধারায়। যে ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি জীবিত থাকলে মামালা দায়ের বা দরখাস্ত দাখিল করার অধিকারী হতো অথবা তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের বা দরখাস্ত দাখিল করা যেত, কিন্তু উক্ত অধিকার লাভ করার পূর্বেই উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে সেই ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির আইনগত প্রতিনিধিরা যোগ্যতাসম্পন্ন হওয়ার সময় থেকে তামাদির মেয়াদ গণনা শুরু হবে। তবে এই ধারার বিধান অগ্রক্রয়, স্থাবর সম্পত্তির দখল এবং বংশগত পদ লাভের মামলার ক্ষেত্রে গ্রহণ যোগ্য হবে না।
তামাদি আইনে প্রতারণার প্রভাব কেমন হবে তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে তামাদি আইনের ১৮ ধারায়। ‘প্রতারণার ফলাফল’ শিরোনামে উক্ত ধারায় বলা আছে- ‘’যখন কোন লোক একটি মামলা দায়েরের কিংবা দরখাস্ত দাখিলের অধিকারী হয়, অথচ প্রতারণা করে তাহাকে সে অধিকারের বিষয় কিংবা যে মালিকানার উপর ঐ অধিকার প্রতিষ্ঠিত, সে বিষয় অবগত হতে দেওয়া হয় নাই, কিংবা যখন ঐ অধিকার পাওয়ার লক্ষে যে দলিল প্রয়োজন, তা প্রতারণা করে তার নকট হতে গোপন রাখা হয়েছে, তখন প্রথম যেদিন উক্ত ব্যক্তি প্রতারণার বিষয় অবগত হবে সে দিবস হতে তার বিরুদ্ধে তামাদি মেয়াদ গণনা শুরু হবে।‘’ এই সম্পর্কে 32 DLR (AD) 167 মামলায় আদালত স্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করেন যে- ‘’If fraud is proved then there is no question of limitation’’।
তামাদি আইনের ১৯ ধারায় ‘লিখিতভাবে প্রাপ্তি স্বীকারোক্তি’ অর্থাৎ Effect of Acknowledgement in writing নিয়ে আলোচনা করেছে। যখন কোন সম্পত্তি বা অধিকার সম্পর্কে মামলা দায়ের বা দরখাস্ত দাখিল করার জন্য তামাদির মেয়াদ উত্তীর্ণ হবার পূর্বেই যে পক্ষের নিকট থেকে উক্ত সম্পত্তি বা অধিকার দাবি করা হচ্ছে, সেই পক্ষ লিখিত ও স্বাক্ষরিত করে উক্ত সম্পত্তি সম্পর্কে দায় স্বীকার করে। তখন উক্ত স্বীকৃতি স্বাক্ষরিত হওয়ার সময় থেকে তামাদির মেয়াদ নতুনভাবে গণনা শুরু হবে।
২০ ধারায় বলা আছে ধারের অর্থ বা ধার নেয়া বস্তু শোধ করার ফলাফল কিংবা কোন প্রকার সুদ শোধ করার ফলাফল সম্পর্কে। যেক্ষেত্রে কোন দেনা বা দায়ের সুদ পরিশোধ করার নির্ধারিত মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পূর্বে উক্ত দেনা বা দায় পরিশোধকারী নিজে বা তার পক্ষেরে ক্ষমতা প্রাপ্ত প্রতিনিধির মাধ্যমে কোন অর্থ প্রদান করে সেক্ষেত্রে উক্ত অর্থ প্রদানের তারিখ থেকে নতুন করে তামাদি মেয়াদ গণনা শুরু হবে।
ধারা ১৯ এবং ধারা ২০ এর ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি যদি অক্ষম হয় তবে তার প্রতিনিধি বলতে বুঝাবে- তার আইনগত অভিভাবক বা ম্যানেজার বা তার পক্ষে নিযুক্ত কোন আইনগত কমেটিকে যা ধারা ২১ বর্ননা করে।
ধারা ২২’এ বলা আছে, নতুন কোন বাদী বা বিবাদীকে স্থলাভিষিক্ত বা পক্ষভুক্ত করার ফলাফল সম্পর্কে। যে ক্ষেত্রে মামলা দায়ের করার পর নতুন কোন বাদী বা বিবাদীকে পক্ষভুক্ত করা হয় বা কারও স্থলাভিষিক্ত করা হয় সেক্ষেত্রে সেই ব্যক্তির জন্য পক্ষভুক্তির তারিখেই মামলাটি করা হয়েছে বলে গণ্য হবে।
Continuing breaches of contract বা অবিরাম চুক্তিভঙ্গের ক্ষেত্রে তামাদির মেয়াদ গণনা কেমন হবে সেই সম্পর্কে বলা আছে তামাদি আইনের ২৩ ধারায়। এই ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ দিয়ে বলা যেতে পারে, ‘ক’ এবং ‘খ’ এর মাঝে কর্জের বা ধারের টাকা সম্পর্কের একটি চুক্তি ছিল। ধারের টাকা পরিশোধের তারিখে ‘ক’ চুক্তিভঙ্গ করলো এবং পরবর্তী একটি তারিখে টাকা পরিশোধের দিন দিলো। উক্ত তারিখেও সে টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলো এবং পুনরায় তারিখ দিলো। ‘ক’ যতবার চুক্তিভঙ্গ করবে ততোবার নতুন করে ধারের টাকা আদায়ের মামলা দায়েরের তামাদি মেয়াদ শুরু হবে।
তামাদি আইনের ২৪ ধারায় বলা আছে কোন ক্ষতি সাধিত না হলে বা কোন মামলা করার করণ উদ্ভব হবার আগ পর্যন্ত তামাদি মেয়াদ গণনা শুরু হবে না।
তামাদি আইনে ধারা ২৫ উল্লেখ করে তামাদি আইন, ১৯০৮ এর সকল সময় গণনা করা হবে গ্রেগরীয়ান বর্ষপঞ্জীকা বা ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুসারে।
সময়ের অবিরাম চলাচলের ফলে অনেক সময় মানুষের অধিকারের উদ্ভব হয়, যাকে Acquisition of ownership by possession বলে। এই সম্পর্কে তামাদি আইনের চতুর্থ খন্ডে ২৬,২৭ এবং ২৮ ধারায় নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম বর্ণনা করা হয়েছে। নিচে এই সম্পর্কে আলোচনা তুলে ধরা হলো-
২৬ ধারার আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে ’সুখাধিকার’। যেখানে সুখাধিকার সম্পর্কে বলা যায়- অপরের সম্পত্তিতে একাধারে, শান্তিপূর্নভাবে, জ্ঞাতানুসারে ও নির্দিষ্ট সময়কাল ধরে আলো, বাতাস, পানি বা পথ চলার দরূন যে অধিকার উদ্ভব হয় তাই সুখাধিকার। নির্দিষ্ট সময় বলতে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ক্ষেত্রে ২০ বছর সরকারী সম্পত্তির ক্ষেত্রে ৬০ বছর বুঝাবে। এবং সুখাধিকার অর্জনের মামলা করার তামাদি মেয়াদ হবে ২ বছর।
যে সম্পত্তি হতে অন্য কেউ সুখাধিকার ভোগ করছে। সেই ক্ষেত্রে উক্ত সম্পত্তির ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারীর অধিকার স্পষ্ট করার জন্য তামাদি আইনের ২৭ ধারায় আরো বিস্তার বিশ্লেষণ উল্লেখ আছে। যা সুখাধিকার প্রমাণের ক্ষেত্রে অবশ্যই লক্ষণীয়।
তামাদি আইনের ২৮ ধারায় বলা হয়েছে, কিভাবে বা কি কারণে একজনের মালিকানায় থাকা সম্পত্তিতে তার অধিকার বা মালিকানা বিলুপ্ত হয়ে যায়। যাকে ‘সম্পত্তির অধিকার বিলুপ্তি’ শিরোনামে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, আইনে মামলা দায়ের করার যে মেয়াদ নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে ঐ সময়সীমার মাঝে মামলা দায়ের না করলে তার অধিকার বিলুপ্ত হয়ে যাবে। যেমন ১ম তফসিলের অনুচ্ছেদ ১৪২-এ উল্লেখ করা হয়েছে বাদীর দখলে থাকাকালে সে যদি বেদখল বা নিজের দখল বজায় না রাখে তাহলে বেদখল হবার বা যেদিন থেকে দখল বজায় না রাখে সে তারিখ হতে ১২ বছরের মাঝে তার মামলা দায়ের করতে হবে। যদি সে মামলা দায়ের না করে তাহলে ২৮ ধারার বিধান অনুযায়ী তার অধিকার বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং যে ব্যক্তি দখলে আছে সে যদি ১২ বছরের বেশী সময় তার নিরবিচ্ছিন্ন দখলে থাকা প্রমাণ করতে পারে তাহলে ঐ সম্পত্তিতে তার বিরুদ্ধ দখলজনিত স্বত সৃষ্টি হবে যাকে আদালতের ভাষায় Title by adverse possession বলা হয়। তামাদি আইনের ২৮ ধারা বা ১৪২ অনুচ্ছেদে Adverse Possession শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়নি। কিন্তু বহু বছর ধরে আদালতে এরুপ দখলকে Adverse দখল হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। Adverse Possession সম্পর্কে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট মতামত দেন যে- ‘Adverse possession implies that it commenced in wrong and is maintained against right’। ২৮ ধারার সাথে সম্পর্কিত অনুচ্ছেদ হচ্ছে ১৪২,১৪৪ এবং ১৪৯।
তামাদি আইনের কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে যা পঞ্চম খন্ডে শুধুমাত্র একটি ধারা (২৯ ধারা)’য় উল্লেখ করা হয়েছে। ২৯ ধারায় বর্ণনা নিচে উল্লেখ করা হলো-
২৯ ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বলবৎ চুক্তি আইনের ধারা-২৫’কে তামাদি আইন কোন ভাবেই প্রভাবিত করবে না। এরপর বলা আছে, যখন কোন বিশেষ আইনে মামলা, আপীল কিংবা অন্য কোন আবেদনের জন্য উক্ত আইনেই বিশেষ তামাদি বিধান থাকে, সে ক্ষেত্রে উক্ত তামাদির বিধান এমন ভাবে কার্যকর হবে যেন তা তামাদি আইনেরই বিধান। যদি বিশেষ আইনে তামাদির কোন বিধান উল্লেখ না থাকে, তবে এই ক্ষেত্রে শুধুমাত্র তামাদি আইনের ধারা ৪, ধারা ৯ থেকে ১৮ এবং ধারা ২২ কার্যকর হবে এছাড়া তামাদি আইনের অন্য কোন বিধান সেই বিশেষ আইনে কার্যকর হবে না। তামাদি আইনের কোন বিধান বিবাহ বিচ্ছেদ আইন, ১৮৬৯ এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। এবং যে সকল এলাকার ক্ষেত্রে স্পষ্ট ভাবে সুখাধিকার আইন বলবৎ থাকবে সেই সকল এলাকায় তামাদি আইনের ২৬ ও ২৭ ধারা গ্রহণযোগ্য হবে না।
শেষ কথা- তামাদি আইন, ১৯০৮ সকল কিছুর তামাদি মেয়াদ ব্যাখ্যা করলেও ভালোবাসার তামাদি মেয়াদ এই আইন ব্যাখ্যা করতে পারেনি। তবে তামাদি আইন বিচার প্রার্থী মানুষের মামলা, আপীল বা কোন দরখাস্ত আদালতের সামনে হাজির করার জন্য সময় নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। সময় নির্দিষ্ট করার এই প্রক্রিয়া বিচারপ্রার্থী মানুষের অধিকারকে শৃঙ্খলিত করেছে; আবার কোথাওবা হরণ করেছে। তাই এই আইন ব্যাখ্যা করার সময় আদালত, আইনজীবী, আইনের শিক্ষক এবং আইনের ছাত্রদের সর্বোচ্চ ঔদার্যতা প্রদর্শন করা উচিত। সেই সাথে খেয়াল করা উচিত ঔদার্যতা প্রদর্শন যেন অহেতুক না হয়। ধন্যবাদ।
লেখক : আইনজীবী; জজ কোর্ট, ঢাকা।