চলতি বছরেই চট্টগ্রামে হাইকোর্ট বিভাগের সার্কিট বেঞ্চ স্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। তিনি জানান, কিছু দিনের মধ্যেই এ বিষয়ে ঘোষণা দেওয়া হবে।
আজ শনিবার (১৫ জানুয়ারি) চট্টগ্রাম বার এসোসিয়েশন আয়োজিত আইনজীবীদের বার্ষিক মিলনমেলা অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে এ কথা বলেন তিনি।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আইনমন্ত্রী বলেছেন, বর্তমান মাননীয় প্রধান বিচারপতির সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ হয়েছে। তিনি দ্রুতই এটি কনসিডারেশনে নেবেন। এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও রাজি। আমার মনে হয়, এই বছর শেষ হওয়ার আগেই চট্টগ্রামে সার্কিট বেঞ্চ স্থাপন করা হবে। কিছুদিনের মধ্যেই এ ব্যাপারে ঘোষণা দিবো আমরা।
বক্তব্যের শুরুতে আইনজীবীদের প্রশংসা করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের আগে ও পরে সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আইনজীবীরা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। আইনজীবীদের এ অবদান জাতি কখনো ভুলবে না।
সরকার বিচার বিভাগের প্রতি আন্তরিক উল্লেখ করে তিনি বিলেন, বর্তমান সরকার ৬৪টি চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজেএম) আদালত ভবন নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে। এছাড়া ২৭টি দায়রা জজ আদালত ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণের কাজ চলমান। ঢাকা, চট্টগ্রাম বাদ দিলে অন্যান্য জেলা শহরে সবচেয়ে বড় বহুতল ভবন সিজেএম আদালত ভবন।
আদালতে তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদানের কথা উল্লেখ করে আনিসুল হক বলেন, ২০২০ সালে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে দেশে লকডাউন শুরু হয়। তখন সব আদালত বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন কারাগারে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত বন্দী রয়েছে। যেখানে সারাদেশের কারাগারের ধারণক্ষমতা ছিল সর্বসাকুল্যে ৭৫ হাজার সেখানে বন্দী ছিল ৯৩ হাজার। আদালত বন্ধ থাকায় মামলা নিষ্পত্তির সুযোগ ছিলোনা, উপরন্তু নতুন মামলা হওয়ায় মামলার সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছিল।
তিনি আরও বলেন, এমন সমস্যায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে করলাম। তিনি (প্রধানমন্ত্রী) বললেন, ভার্চুয়াল কোর্ট চালু করতে। প্রধানমন্ত্রীর এ প্রস্তাবে তৎকালীন প্রধান বিচারপতিও রাজি হলেন। ওই বছরের মে মাসে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পেয়ে প্রথম সাত দিনের মধ্যেই তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে আদালত পরিচালনার অধ্যাদেশ তৈরি করা হল। এক মাসের মধ্যেই সেটি আইনে পরিণত করা হল।
কোন রকম পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই ভার্চুয়াল কোর্টে অংশগ্রহণ করা আইনজীবীদের ধন্যবাদ জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, আপনারা পিছপা হননি। সরকারকে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করে আপনারা ওই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছেন। বার এবং বেঞ্চের পারস্পরিক সহযোগিতায় ভার্চুয়াল কোর্ট সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে। বিচারপ্রার্থীদের সেবা দিয়েছেন। মহামারির এ সময় প্রায় সাড়ে তিন লাখ মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ভার্চুয়াল আদালতে। তবে ভার্চুয়াল কোর্টকে আরও এগিয়ে নিতে আইনে কিছু সংযোজন, পরিমার্জন করা প্রয়োজন।
বিচারকদের প্রশিক্ষণের বিষয়টি উল্লেখ করে আইনমন্ত্রী বলেন, এই সরকার প্রথমবারের মতো বিচারকদের বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। অস্ট্রেলিয়া, জাপান, চীন ও ভারতে বিচারকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতেও এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
মন্ত্রী বলেন, মাদারীপুরের শিবচর উপজেলায় প্রথম বারের মতো একটি জুডিসিয়াল একাডেমি নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এই একাডেমিতে বিচারকদের পাশাপাশি আইনজীবীদেরও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। ইতোমধ্যে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ১৬৭ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছি। চলতি বছরেই এর কাজ শুরু হবে।
দায়িত্ব নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনায় উদ্বুদ্ধ করতে সারাদেশের সরকারি আইন কর্মকর্তা জিপি, পিপি, বিশেষ পিপি, অতিরিক্ত জিপি, অতিরিক্ত পিপি, এজিপি, এপিপিদের মাসিক রিটেইনার ফি চার-পাঁচ গুণ বাড়িয়েছে সরকার। এছাড়া মামলা শুনানির জন্য দৈনিক ও ভ্যালুয়েশন ফি-ও বাড়ানো হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন বিভাগীয় জিপি, পিপি ও বিশেষ পিপিদের মাসিক ফি বাড়িয়ে ১৫ হাজার টাকা এবং জেলা শহরের ক্ষেত্রে ১২ হাজার টাকা করা হয়েছে। পূর্বে যা ছিল মেট্রোপলিটনের ক্ষেত্রে ৩ হাজার ও জেলা শহরের ক্ষেত্রে মাত্র ১ হাজার ৫০০ টাকা। এছাড়া জিপিদের প্রতি মাসেই মামলা ভ্যালুয়েশন ৩০০০ থেকে ৫০০০ টাকা করা হয়েছে। পাশাপাশি মামলা শুনানির জন্য পিপি ও বিশেষ পিপিদের দৈনিক ফি পূর্ণ দিবসের জন্য ৬০০ ও অর্ধদিবসের জন্য ৩০০ টাকা করা হয়েছে, যা পূর্বে ছিল ৫০০ ও ২৫০ টাকা।
মন্ত্রী বলেন, আমি সরকারের কাছে প্রস্তাব রেখেছি জেলা পর্যায়ে দেশের সরকারি আইন কর্মকর্তাদের বেতন তিন ক্যাটাগরিতে ভাগ করে দিতে। এরমধ্যে বড় জেলার পিপিদের বেতন হবে ৫০ হাজার টাকা, মাঝারি জেলার ৪৫ হাজার ৪০ হাজার টাকা। সেই প্রপরসানে অন্যান্য সরকারি আইন কর্মকর্তাদের বেতন নির্ধারিত হবে। সেই প্রস্তাব এখনো বিবেচনাধীন রয়েছে।
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আমরা বদ্ধপরিকর। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় যা যা প্রয়োজন এ সরকার তার সবই করতে প্রস্তুত। এসব শুধু কথায় নয়, কাজেও আমরা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। দেশে ৩৪ বছর পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার রুখে দিতে জারি করা ইমডেমনিটি অধ্যাদেশ এই সরকারের আমলে ১৯৯৬ সালে সংসদে ওই কালো আইন বাতিল করা হয়েছে। একাত্তরে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারও প্রায় শেষ হয়েছে। এছাড়া স্পর্শকাতর বেশকিছু মামলার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। আমরা অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি। যাতে অপরাধীরা বুঝতে পারে অপরাধ করলে এদেশে শাস্তি হবেই।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, মহানগর দায়রা জজ আশফাকুর রহমান, বার কাউন্সিলের অ্যাডহক কমিটির সদস্য মুজিবুল হক এবং সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। এছাড়া ভার্চুয়ারি যুক্ত হয়ে বিশেষ অতিথিদের মধ্যে আরও বক্তব্য রাখেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, আইন সচিব মো. গোলাম সারওয়ার, চট্টগ্রামের জেলা ও দায়রা জজ মো. ইসমাইল হোসেন।