মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ্ আল-গালিব: আমরা আমাদের বাড়ি ঘর সুরক্ষিত রাখার জন্য প্রাচীর দিই যাতে করে অনাকাঙ্ক্ষিত কোন দুর্ঘটনা না ঘটতে পারে। রাজা-বাদশাহর যুগে বহিঃশক্র আক্রমণ থেকে বাঁচতে উঁচু উঁচু দেয়াল তৈরী করা হত। কিন্তু একবার ভাবুন তো যদি পাশের দেশ থেকে অদৃশ্য কোন অপশক্তি আমাদের আক্রমণ করে তাহলে আমরা তো ঠেকাবো কি করে?
সম্প্রতি বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য প্রায় ৩০ ভাগ দায়ী ভারত ও মিয়ানমারের মতো প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা অতি সূক্ষ্ম পদার্থ। অ্যামোনিয়া, নাইট্রিক অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, সীসা, কার্বন, ভোলাটাইল অর্গানিক কম্পাউন্ড, ওজন গ্যাসের মতন পরিবেশের জন্য মারাত্বক ক্ষতিকারক পদার্থ ভেসে আসছে এবং দূষিত করছে আমাদের বায়ুমণ্ডলকে।
এসব মারাত্বক ক্ষতিকর পদার্থগুলো ৫০ থেকে ১০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত উড়ে যেতে পারে। সব থেকে বেশি দূর পর্যন্ত যেতে পারে ওজন গ্যাস যা ১০০০ কি.মি. পর্যন্ত যেতে পারে। কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রিক অক্সাইড এগুলো ৫০ থেকে ৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত উড়তে পারে দেখানো হয়েছে এই গবেষণা প্রতিবেদনে।
২০১৭ থেকে ২০২০ এই তিন বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে এনভায়রনমেন্ট এন্ড সোশাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন বা এসডোর চালানো গবেষণার বরাত দিয়ে বিবিসি এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
এর ফলাফল আমরা দেখেছি গত ১৩ জানুয়ারী দূষিত শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান ছিল দ্বিতীয় এবং দিল্লির ছিল শীর্ষ অবস্থানে।
সম্প্রতি আল জাজিরার এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় ২০২০ সালে বিশ্বের দূষিত ১০০টি শহরের তালিকা প্রকাশিত হয়েছে যার সবই এশিয়া মহাদেশের। এই তালিকায় দিল্লির পাশাপাশি ভারতের ৪৬টি শহর জায়গা পেয়েছে। বাংলাদেশেও এই তালিকায় স্থান লাভ করেছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর পরিবেশ এবং বায়ু দূষণের ফলে আমরা অতিউচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছি।
বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, যা দেশের জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশ। পরিবেশ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্রিন পিসের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
বায়ুদূষণজনিত রোগে দেশে শিশুর অকালমৃত্যুর একটি হিসাবও দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ৯৬ হাজার শিশুর অকালমৃত্যু হয়েছে শ্বাসকষ্ট জনিত কারণে।
আমরা দেখেছি ধারাবাহিকভাবে প্রতি বছর বায়ু দূষণের হার উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর মতে, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে বায়ুদূষণ ১০ শতাংশ বেশি হয়েছে। সংখ্যার হিসেব গড়ে ২০২০ সালে বায়ুমান সূচক (একিউআই) অনুযায়ী দূষণের মাত্রা ছিল ১৪৫; যা বৃদ্ধি পেয়ে ২০২১ সালে এসে হয়েছে ১৫৯ দশমিক ১।
প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে আমাদের তিন দিক সীমানা রয়েছে। আর দেশের দক্ষিণ পূর্বে মায়ানমার সীমান্ত। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে শিল্পকলকারখানা এবং মায়ানমার থেকে জীবাশ্ম পোড়ানোর দরুন এসব দূষণ মাত্রাতিরিক্ত ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে সহজে দূষিত কণা আমাদের দেশে প্রবেশ করছে আর মারাত্বক দূষণের শিকার হচ্ছি আমরা।
দিল্লিতে দূষণের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিলো। কার্যত আমাদের দেশে এমন উদ্যোগ চোখে পড়েনা উপরন্তু উন্নয়ন কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হয়েছে। রাজধানী ঢাকা শহরে উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়াতে একদিকে যেমন শহর ক্রমে কংক্রিটের নগরে পরিণত হচ্ছে সাথে হচ্ছে মারাত্বক পরিবেশ দূষণ। আমরা অবশ্যই উন্নয়নের বিরুদ্ধে নই বরং কিভাবে পরিবেশ রক্ষা করে উন্নয়ন কার্যক্রম চালিয়ে নেয়া যায় সেদিকে মনোযোগ বৃদ্ধি করা একান্ত জরুরী।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) -এর বিভিন্ন মামলার মধ্য দিয়ে সুস্থ পরিবেশ বেঁচে থাকা (Right to Life) মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে উচ্চ আদালত দ্বারা। সাথে সাথে সংবিধানের ১৮ ক অনুচ্ছেদ পরিবেশ ও জীববৈচিত্র রক্ষাকে সাংবিধানিক নিশ্চয়তা প্রদান করেছে। দেশে প্রচলিত পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ ও পরিবেশ আদালত আইন ২০১০ মত আইন রয়েছে বটে, তবে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে ক্ষতিকর দূষণের হাত থেকে কিভাবে রক্ষা পাওয়া যাবে কিভাবে সেদিকে নজর দেবার সময় এসেছে।
গত ২৭ জানুয়ারি দেশে প্রথম জাতীয় অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের প্রথম পর্বে যোগ দিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহর। এ কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। আর এজন্য ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ক্যানসার রোগী উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।
উপরের তথ্য উপাত্তগুলো মেয়রের কথাকে যথাযথভাবে সমর্থন করে।
যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট- ইপিআইসি পরিচালিত (২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে) এক গবেষনায় দেখা যায়, নয়াদিল্লির বাতাসে থাকা ফুসফুসের জন্য ক্ষতিকর ক্ষুদ্র বস্তুকণা পিএম ২ দশমিক ৫–এর পরিমাণ ঘরের বাইরের চেয়ে, ঘরের ভেতরে আশঙ্কাজনক মাত্রায় বেশি। বাংলাদেশে বায়ুদূষণের হারের যে উর্ধ্বোগতি তাতে দিল্লীর মত এমন চিত্র আমাদের দেশে হতে হয়ত আর বেশি দূরে নয়! কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে না পারলে ঘরে মধ্যে থেকেও আমরা নিরাপদ থাকতে পারবো না। পরিবেশ দূষণের জন্য শুধু প্রতিবেশী দেশগুলো দায়ী নয়, দায় আমাদের নিজেদেরও রয়েছে। সেদিকে অবশ্যই নজর দিতে হবে।
এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে সকলকে। দেশের মানুষদের আর বেশি সচেতন ও সোচ্চার হতে হবে। দেশীয় আইনের যথাযথ প্রয়োগের সাথে সাথে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চুক্তিগুলোর যেমন বাস্তবায়ন প্রয়োজন তেমনি প্রতিবেশী দেশসমূহের সাথে যুগপৎ কাজের মাধ্যমে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় আমরা ভবিষ্যতের জন্য সুন্দর, সুস্থ বসবাসযোগ্য দেশ উপহার দিতে ব্যর্থ হবে।
লেখক: অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ঢাকা।