অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে বর্তমানে দেশে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন সূচকে নারীর অগ্রগতি হয়েছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, স্পিকার নারী, বিরোধীদলীয় নেতাও নারী। বিচার কাজেও পিছিয়ে নেই নারীরা। এ পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টে আলো ছড়িয়েছেন মোট নয়জন নারী বিচারপতি।
২০০০ সালের ২৮ মে মাসে প্রথমবারের মতো উচ্চ আদালতে নিয়োগ পান নারী বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। এরপর ২২ বছরে এ সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে নয়জনে।
তবে যিনি পথ দেখিয়েছেন সেই প্রথম নারী বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে ২০১৭ সালের জুলাই মাসে অবসর নেন। অবসর নিয়েছেন আপিল বিভাগের দ্বিতীয় নারী বিচারপতি জিনাত আরাও।
এ দুই বিচারপতির অবসরের পর বর্তমানে আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগে রয়েছেন সাতজন নারী বিচারপতি। এর মধ্যে একজন রয়েছেন আপিল বিভাগে। বাকি ছয়জন হাইকোর্ট বিভাগে।
এ পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টে নারীদের প্রতিনিধিত্ব করা বিচারপতিদের সংক্ষিপ্ত জীবনী ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম পাঠকদের জন্য নিম্নে তুলে ধরা হল-
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা
বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৭৫ সালের ২০ ডিসেম্বর মুনসেফ (সহকারী জজ) হন। হয়ে যান ইতিহাসের অংশ। দেশ ও বিচার বিভাগের ইতিহাসে তিনিই প্রথম নারী বিচারক।
পরবর্তীতে যোগ্যতাই তাকে ১৯৯১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জেলা জজের আসনে উন্নীত করে। আর এটাও প্রথম কোনো নারীর জেলা জজ হওয়ার ঘটনা।
তবে অধস্তন আদালতেই থেমে থাকেননি বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার কর্মজীবন। ২০০০ সালের ২৮ মে তিনি হাইকোর্টে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। এর দুই বছর পর হাইকোর্টে স্থায়ী হন তিনি। হাইকোর্টেও তিনি প্রথম।
সর্বশেষ ২০১১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি আপিল বিভাগের প্রথম নারী বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন। এর মধ্যে ২০১৩ সালের ১ এপ্রিল তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন আপিল বিভাগের একটি বেঞ্চের নেতৃত্বে বসান বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানাকে।
বিচারিক কাজের পাশাপাশি বিচারপতি নাজমুন আরা সুলাতানা প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন বাংলাদেশ ওমেন জাজেস অ্যাসোসিয়েশনের। দুই বার সেক্রেটারি ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব ওমেন জাজেসের। পরে তিনি ২০১৭ সালে অবসরে যান। বর্তমানে তিনি বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন।
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জিনাত আরা
বিচারপতি জিনাত আরা আপিল বিভাগে নিয়োগ পাওয়া দ্বিতীয় নারী বিচারপতি। তিনি বিএসসি ও এলএলবি ডিগ্রি অর্জনের পর ১৯৭৮ সালে মুনসেফ (সহকারী জজ) হিসেবে বিচার বিভাগে নিয়োগ পান। ১৯৯৫ সালে পদোন্নতি পেয়ে জেলা ও দায়রা জজ হন।
পরবর্তীতে ২০০৩ সালের ২৭ এপ্রিল হাইকোর্টে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। দুই বছর পরে তিনি স্থায়ী হন। পরে ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর আপিল বিভাগের বিচারপতি নিয়োগ পান। পরে ২০২০ সালের ১৪ মার্চ তিনি অবসরে যান।
বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ
বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ গত ৯ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি আপিল বিভাগের তৃতীয় নারী বিচারপতি।
১৯৫৫ সালের ১০ অক্টোবর বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ রাজবাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। ১৯৮১ সালের ৮ ডিসেম্বর জুডিশিয়াল সার্ভিসে মুনসেফ (সহকারী জজ) হিসাবে যোগদান করেন। ১৯৯৮ সালের ১ নভেম্বর পদোন্নতি পান জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে।
১২ বছর জেলা জজ হিসাবে দায়িত্ব পালনের পর ২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। দুই বছর দক্ষতার সঙ্গে অতিরিক্ত বিচারকের দায়িত্ব পালনের পর তাকে স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভাড ল’ স্কুলে সার্টিফিকেট কোর্সে অংশ নেন বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ। ১৯৯৬ সালে কানাডায় অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল উইমেন জাজেস অ্যাসোসিয়েশনের সম্মেলনে যোগ দেন। ২০১২ সালে যোগ দেন যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত ন্যাশনাল উইমেন জাজেস অ্যাসোসিয়েশনের সম্মেলনে।
বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী
বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরীর বাবা সাবেক বিচারপতি এ টি এম মাসুদ। ১৯৮১ সালের ২২ আগস্ট তিনি ঢাকা জেলা জজ আদালতে আইন পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৮৩ সালের ২১ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট বিভাগের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। পরে ১৯৯৬ সালের ১৪ মে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন তিনি।
২০০২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তাকে হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। দুই বছর পর ২০০৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তিনি হাইকোর্টের স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান।
বিচারপতি ফারাহ মাহবুব
বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ও এলএলএম পাসের পর ১৯৯২ সালে জেলা আদালতে আইন পেশা শুরু করেন। ১৯৯৪ সালের ১৫ অক্টোবর হাইকোর্টে এবং ২০০২ সালের ১৫ মে আপিল বিভাগে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন।
২০০৪ সালের ২৩ আগস্ট তিনি হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি নিযুক্ত হন। ২০০৬ সালে তিনি হাইকোর্ট বিভাগে পূর্ণাঙ্গ বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান।
তার আরও একটি পরিচয় তিনি সাবেক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমানের মেয়ে। তিনি অসংখ্য আলোচিত রায় দিয়ে সুনাম কুড়িয়েছেন।
বিচারপতি নাইমা হায়দার
সাবেক প্রধান বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীর মেয়ে বিচারপতি নাইমা হায়দার। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। এছাড়া, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, বার্কেল বিশ্ববিদ্যালয় ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৮৯ সালে জেলা আদালতে আইন পেশায় যোগ দেন নাইমা হায়দার । ১৯৯৩ সালে হাইকোর্টে আইনজীবী এবং ২০০৪ সালে আপিল বিভাগের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন।
২০০৯ সালের ৬ জুন তিনি হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হন। ২০১১ সালের ৬ জুন হাইকোর্টের স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। বিচারপতি নাইমা হায়দার অসংখ্য আলোচিত রায় দিয়ে সুনাম কুড়িয়েছেন।
বিচারপতি কাশেফা হোসেন
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মোহাম্মদ হোসেনের মেয়ে বিচারপতি কাশেফা হোসেন। তিনি ইংরেজি বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রি লাভ করেন। এছাড়া লন্ডনেও একই বিষয়ে পড়াশোনা করেন। এরপর ১৯৯৫ সালে জেলা আদালতে আইন পেশায় যোগ দেন।
২০০৩ সালে হাইকোর্ট বিভাগের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন কাশেফা হোসেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তা ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
২০১৩ সালের ৪ আগস্ট হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। ২০১৫ সালের ৫ আগস্ট তিনি হাইকোর্ট বিভাগের স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান।
বিচারপতি ফাতেমা নজীব
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএলবি) ডিগ্রি অর্জন করা ফাতেমা নজীব ১৯৮৪ সালের ১২ নভেম্বর জুডিসিয়াল সার্ভিসে মুনসেফ (সহকারী জজ) হিসেবে যোগদান করেন। এরপর ২০১১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর নরসিংদীর জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে পদোন্নতি পান।
বেগম ফাতেমা নজীব ২০১৮ সালের ৩১ মে হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। ২০২০ সালের ৮ জুন তাকে স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
বিচারপতি কাজী জিনাত হক
একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষা সৈনিক সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কাজী এবাদুল হক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক একুশে পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. শরীফা খাতুনের কনিষ্ঠ কন্যা বিচারপতি কাজী জিনাত হক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে প্রথম বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর লাভ করেন। এরপর ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ বিশ্ববদ্যালয় থেকেও এলএলএম করেন।
তিনি লন্ডনের সাউথ ব্যাংক ইউনিভার্সিটি থেকে আইনে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা এবং লন্ডনের ইনস অফ কোর্ট স্কুল অফ ল থেকে বার ভোকেশনাল কোর্সে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে উত্তীর্ণ হন। এরপর জিনাত হক লন্ডনের সোসাইটি অব মিডল টেম্পল থেকে ব্যারিস্টার-অ্যাট-ল হিসাবে ডাক পান।
১৯৯৭ সালের ৬ আগস্ট অধসতন আদালতের আইনজীবী হিসেবে আইন পেশায় নিযুক্ত হন। ২০০০ সালের ১৮ জুন হাইকোর্টে তালিকাভুক্ত হন। এরপর ২০১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের আইনজীবী হিসেবে প্র্যাকটিসের অনুমতি পান।
তিনি দুই মেয়াদে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর কাজী জিনাত হক হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান।
বিচারপতি কাজী জিনাত হক বাবা অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কাজী এবাদুল হকের সাথে সুপ্রিম কোর্টের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তসমূহ নিয়ে বই লিখেছেন, ২০১৯ সালে হাক্কানি পাবলিশার্স থেকে বইটি প্রকাশিত হয়।