মো. আরিফ হুসাইন: আমরা হরহামেশাই নেতিবাচক শব্দ হিসাবে ❝টাউট, চিটার, বাটপার, ফ্রড❞ ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু আমাদের অধিকাংশের এই শব্দ গুলো দ্বারা কাদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয় বা শব্দগুলোর আইনি প্রয়োগ অজানা । আমি আমার এই লেখনিতে শব্দ গুলোর অর্থ উল্লেখপূর্বক আইনগত প্রয়োগ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি।
টাউট (Tout)
‘টাউট (Tout)’ শব্দটি আমাদের আইন অঙ্গনে ও বাস্তব জীবনে একটি বহুল পরিচিত ইংরেজি শব্দ। অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে এ শব্দটিকে প্রথম চিহ্নিত করা হয়। Cambridge English Dictionary তে টাউট (Tout) শব্দের অর্থ করা হয়েছে “to advertise, talk about, or praise something or someone repeatedly, especially as a way of encouraging people to like, accept, or buy something”
তবে ভারতীয় উপ-মহাদেশ এবং কালের পরিক্রমায় স্বাধীন বাংলাদেশে টাউটের উৎপত্তি হল কবে থেকে সেদিকে লক্ষ্য করলে আমরা ১৮৭৯ সনের টাউট আইনের (The Touts Act, 1879) ৩ নং ধারায় টাউটের সংজ্ঞা ও ৩৬ ধারায় টাউটের তালিকা প্রণয়নের বিধান খুঁজে পাই। পরবর্তীতে ১৯২৬ সনের বার কাউন্সিল এ্যাক্ট, ১৯৬৫ সনের দি লিগ্যাল প্রাকটিশনার্স অ্যান্ড বার কাউন্সিল এ্যাক্ট এই সকল আইনের সব গুলোতেই টাউট সম্পর্কিত ধারা যুক্ত করা হয়। কিন্তু ১৯৭২ সনের বার কাউন্সিল অর্ডারে টাউট সম্পর্কিত সরাসরি কোন ধারা না থাকলেও টাউটিং এর পর্যায়ে পড়ে এমন কর্মকাণ্ড করতে নিষেধ করা হয়েছে। তবে রেজিশট্রেশন এ্যাক্ট, ১৯০৮-এ টাউট এর সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে এবং টাউট তালিকা প্রস্তুত করার কথা বলা হয়েছে।
The Touts Act, 1879 এর ৩ ধারা অনুযায়ী টাউট (Tout) বলতে এইরূপ ব্যক্তিকে বুঝাবে-
• যারা আইন পেশাদারীর নিকট হতে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে আইন পেশাদারীর কর্ম সংগ্রহ করার প্রস্তাব দেয়; অথবা
• যে এইরূপ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে দেওয়ানী, ফৌজদারী অথবা রাজস্ব আদালতের পরিপার্শ্বে জনসাধারণের আশ্রয়ের অন্যান্য স্থানে ঘন ঘন আসা-যাওয়া করে; অথবা
• এই আইনের ৩৬-ক ধারার বিধানের অধীনে হাইকোর্ট ডিভিশন কতৃর্ক প্রণীত বিধিমালা অনুসারে টাউট (Tout) হিসাবে গণ্য মর্মে ঘোষিত কোন ব্যক্তি।
টাউট আইনের ৩৬ ধারা অনুসারে, সুপ্রিম কোর্ট, জেলা জজ, দায়রা জজ, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং কালেক্টরের নিচে নন এ রকম রাজস্ব কর্মকর্তা প্রত্যেকেই তাঁদের বা নিজ নিজ আদালতের এবং তাঁর অধস্তন আদালত থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে টাউটদের তালিকা তৈরি করতে পারে এবং কোনো ব্যক্তি টাউট হিসাবে কাজ করলে তাকে তিন মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড বা পাঁচশত টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হতে পারেন।
এছাড়াও অত্র আইনে আরো বলা হয়েছে, যেক্ষেত্রে টাউট তার অপরাধ স্বীকার করে সেক্ষেত্রে তার আটক, বিচার ও শাস্তির বেলায় ১৮৯৮ সনের ফৌজদারী কার্যবিধি ৪৮০ ও ৪৮১ ধারার বিধানাবলী প্রযোজ্য হবে । যদি উক্ত টাউট তার অপরাধ স্বীকার না করে উক্ত কার্যবিধির ৪৮২ ধারার বিধান একইভাবে প্রযোজ্য হবে।
The Registration Act,1908 এর ২(১১) ধারা অনুযায়ী টাউট (Tout) বলতে বুঝায়-“যিনি বিনা লাইসেন্স-এ দলিল লেখকের কাজ করে বা রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত কাজের দালালি করে থাকেন”।
অত্র আইন অনুযায়ী সাব-রেজিস্ট্রার তার অফিসে টাউটের একটি তালিকা তৈরি করতে পারেন তবে টাউট ঘোষণার আগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে শো-কজ নোটিশ দিয়ে তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনে সুযোগ দিবেন। সাব-রেজিস্ট্রার টাউট কে ২০০ টাকা জরিমানা দন্ডে দন্ডিত করতে পারেন এবং জরিমানার অর্থ পরিশোধ না করলে দ্য কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর, ১৮৯৮ এর ৪৮০ ধারার বিধান অনুসারে তাকে ৩০ দিনের কারাদন্ডে দন্ডিত করতে পারেন।
মোটকথা, টাউট হলো এমন ব্যক্তি যার কোন বিশেষ করার আইনগত অধিকার বা বৈধতা না থাকলেও সে যদি সেই কাজ করে তাহলে সে টাউট।
বাটপার
‘বাটপার’ শব্দটিও আমাদের সমাজের প্রাত্যহিক জীবনের একটি বহুল ব্যবহৃত শব্দ। বাটপার শব্দটির কোন আইনগত সংজ্ঞা আমি আমার ক্ষুদ্র চেষ্টা ও জ্ঞানে খুঁজে পাইনি। তবে আধুনিক বাংলা অভিধান তালাশ করে শব্দটির অর্থ পেয়েছি-প্রতারক, ঠক, রাহাজানকারী, লুটেরা ইত্যাদি। উইকিপিডিয়া ‘বাটপার’ এর ব্যাখ্যায় লিখেছে- ❝এক চোরের চোরাই মাল অরেকজন চুরি করলে দ্বিতীয়জনকে বাটপার বলে। যেমন: কথায় বলে,”চোরের উপর বাটপারি”। বাটপার সরাসরি চুরি না করেও বাটপার হতে পারে। যেমন বলা যায়, একজন লোক কিছু একটা বিক্রি করবে, সেই জিনিসের ত্রুটিগুলো গোপন করে বাড়তি গুণাগুণ যোগ করে সেই দ্রব্য বিক্রি করাও বাটপারি।
জেলা ও দায়রা জজ এম আলী আহমেদ স্যার তার ‘লিগ্যাল নোটস অন সিভিল এন্ড ক্রিমিনাল ম্যাটারস’ বইতে লিখেন- ❝আমার ধারণা বাটপার শব্দটি ইংরেজি শব্দ ‘BARTER’ থেকে এসেছে। মূলত বার্টার শব্দটি ব্যবসায়িক লেনদেনে ব্যবহার করা হয় যেমন- কাউকে কোন কাজের সুবিধ নিয়া অর্থ উপার্জন করা। স্যার এখানে বাংলা আরো একটি বাংলা প্রবাদ “ঠগের উপর বাটপারি” মেনশন করে বলেন- টাউটকে ঠকিয়ে যে অর্থ উপর্জান করে তাকে বাটপার বলা হয়।❞
তবে আমার দৃষ্টিতে কোন প্রতারক, চোর বা চিটারকে ঠকিয়ে যে অর্থ উপার্জন সেই হলেন বাটপার।
টাউট-বাটপার কারা তা না হয় আমরা কিছুটা হলেও বুঝেছি, এবার আমরা জানার চেষ্টা করব ❝ফ্রড ও চিটার (চিটিং)❞ কারা
চিটিং (Cheating) এবং ফ্রড (Fraud) উভয় শব্দ দু’টি ইংরেজি শব্দ। ইংরেজি অভিধানে চিটিং শব্দের অর্থ করা হয়েছে – “act dishonestly or unfairly in order to gain an advantage” একইভাবে ফ্রড শব্দের অর্থ করা হয়েছে “wrongful or criminal deception intended to result in financial or personal gain” অর্থাৎ ইংরেজিতে ফ্রড ও চিটিং দুটো আলাদা শব্দ।
আমাদের আইনেও শব্দ দু’টিকে পৃথক আইন সংজ্ঞায়িত করেছে। ১৮৬০ সালের দন্ডবিধির ৪১৫ ধারায় চিটিং এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, ❝কেউ যদি অন্যকে অসৎ উদ্দেশ্যে ক্ষতিগ্রস্ত করে লাভবান হওয়ার জন্য কোন সম্পত্তি প্রদানে প্ররোচিত করেন তাহলে তাকে চিটিং (চিটার) বলে।❞
অন্যদিকে ১৮৭২ সালের চুক্তি আইনের ১৭ ধারায় ফ্রডের সজ্ঞায় বলা হয়েছে, ❝যে একটি বিষয় নিজে সত্য বলে বিশ্বাস না করেও তাকে সত্য বলে দাবী করে বা কোন ঘটনা জেনে শুনে গোপন করে কিংনা কোন কাজ পালন করার ইচ্ছা না থাকা সত্বেও প্রতিশ্রুতি পালনের অথবা অন্য কাউকে ঠকানোর উদ্দেশ্যে কাউকে চুক্তি করতে প্ররোচিত করে অথবা কারো সজ্ঞে চুক্তি করে।❞
আমার আইনের সজ্ঞায় দেখতে পেলাম ফ্রড এবং চিটিং দু’টি এক বিষয় নয়। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত আমাদের প্রচলিত আইনের বাংলা বইগুলোতে চিটিং এবং ফ্রডের বাংলা করা হয়েছে প্রতারণা। কিন্তু চিটিং এর অপরাধ হওয়ার জন্য ভিকটিমকে বা প্ররোচিত ব্যক্তিকে কোন সম্পত্তি অপরাধীর নিকট অর্পণ করতে হবে। অন্যদিকে ফ্রড হতে হলে সেখানে একটা চুক্তি লাগবে এবং চুক্তির একপক্ষ অন্যপক্ষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে লাভবান হওয়ার জন্য অসত্য বলবে বা কোন কথা গোপন করবে বা পালন করবে না জেনেও প্রতিশ্রুতি দেবেন ইত্যাদি।
আবার চিটিং এ তৎক্ষণাৎ ভাবে কোন সম্পত্তি হস্তান্তরের জন্য অপরাধী প্রলুব্ধ করে অপরদিকে ফ্রড হল চুক্তির এক পক্ষ অন্য পক্ষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে লাভবান হওয়ার জন্য চুক্তিতে উপনীত হতে প্ররোচিত করে। যেমন: একটি ছেলে একটি মেয়েকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিল আর মেয়েটি ওমনি তার সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক আচ্ছাদিত হল কিন্তু পরবর্তীতে ছেলেটি আর বিবাহ করল না এটি ফ্রড হবে চিটিং নহে। কেননা, বিবাহ করার ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মেয়েটির সঙ্গে দৈহিক মিলন করা হয়েছে, এটি চিটিং হবে না। কেননা, চিটিং (প্রতারণা) হওয়ার জন্য প্রয়োজন ছিল প্ররোচিত ব্যক্তি কর্তৃক অপরাধীর নিকট কোন সম্পত্তির হস্তান্তর। কিন্তু যিনি বিবাহের আশ্বাসে ছেলেটির সাথে দৈহিক মিলনে লিপ্ত হলেন তিনি কিন্তু কোন সম্পত্তি প্রদান করলেন না তাই এটি চুক্তি আইনের ভাষায় ফ্রড হতে পারে কিন্তু চিটিং না।
চিটিং ও ফ্রড উভয় শব্দের অর্থ বাংলায় প্রতারণা করা হলেও চিটিং এর জন্য হবে শাস্তি আর ফ্রডের জন্য হবে ক্ষতিপূরণ।
লেখক: প্রভাষক; গাজীপুর সেন্ট্রাল ল কলেজ এবং শিক্ষানবিশ আইনজীবী; জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ঢাকা।