সিরাজ প্রামাণিক: মানবতাবাদ শব্দটির মর্মকথা হচ্ছে মানবতন্ত্র, মানুষ ও তার কর্ম অর্থাৎ ‘মানুষই সবকিছুর মাপকাঠি’। লালন মানবীয় বিচ্যুতির সব সীমাবদ্ধতাকে কাটিয়ে, ব্যক্তিগত লোভ-লালসা-মোহ-হিংসা-দ্বেষ বর্জন করে, কেবল মানুষের সম্প্রীতির বাণীই তাঁর গানে প্রচার করেছেন। সমাজ সচেতনতার ক্ষেত্রে তাঁর সঙ্গে তুল্য-মূল্যে বিচার চলে এমন মানুষ পৃথিবীতে খুবই বিরল। বাঙালির এক শ্রেষ্ঠ সন্তান লালন আজ বিশ্বসমাজের মহান আদর্শ, পবিত্র প্রতীক-প্রতিমা, আর মানবতাবাদী চিন্তার ক্ষেত্রে লালন আজ মহান আইকন। তবে তাঁর মানবতাবাদী চিন্তার সঙ্গে অপেক্ষাকৃত রাজনৈতিক রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তুলনা চলে। লালনের কাছে মানুষের ধর্ম বলতে ছিল মানুষের মঙ্গল চিন্তা; বঙ্গবন্ধু ধর্মকে দেখেছিলেন একান্ত ব্যক্তিগত অনুষঙ্গ হিসেবে। আর লালনের অহিংসার বাণী বিশ্বের রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তনের ওপর যে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রেখেছে তাও আমাদের অমূল্য পাওয়া। সন্ত্রাসবাদ-মৌলবাদ ও সামাজিক বৈষম্যে ক্ষতবিক্ষত বিশ্বে লালন-মুজিবের অহিংসাবাদ, মানববাদের সমন্বয় হতে পারে আমাদের মুক্তির অনন্য হাতিয়ার। তবে এ কথা বলতেই হবে, এসব মনীষীর অর্জনের পেছনে একান্ত সহায় ছিল হাজার বছর লালিত বাংলার বৌদ্ধ-উর্বর, সুফি-উর্বর, বৈষ্ণব-উর্বর সমাজমন। আড়াই হাজারেরও বেশি বছর আগে জন্মগ্রহণকারী গৌতম বুদ্ধের জীবনদর্শনে মানবতাবাদের যে স্ফুরণ ঘটেছিল তা আজও প্রবাহমান।
বিশ্ব জগতের সৃষ্টির রহস্যময় আলো-আঁধারির বিষয় নিয়ে এবং জীবনকে ঘিরে মানবমনে যত প্রকার মৌলিক প্রশ্নের উদয় হতে পারে লালনের তত্ত্বসঙ্গীতে আমরা তা দেখতে পাই। সেদিক বিবেচনায় লালন সাঁইজি একজন ভাববাদী দার্শনিক। লালনকে সন্ধান করতে গেলে ফাঁপরে পড়তে হয়। কে এই লালন, কী তাঁর জাত পরিচয় অথবা কেমন তাঁর ধর্ম-জীবনপ্রণালী, প্রশ্ন জাগে। মানুষের মতামতের যেমন শেষ নেই, তেমনি গবেষকরাও তাঁর সব বিষয়ে একমত পোষণ করেননি। লালনের গানে তাঁর অনুসারীরা খুঁজে পান অমৃতের সন্ধান। লালন বলেছেন মানবধর্মের কথা। অমৃতের সন্ধান করেছেন আত্মজ্ঞানের মধ্য দিয়ে। সেই অমৃতের সন্ধানেই কুষ্টিয়ায় সাঁইজির ধামে দেশ-বিদেশ থেকে হাজার হাজার ভক্ত অনুরাগী, অনুসারীরা ছুটে আসেন লালন স্মরণোৎসবে। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
লালনকে বিশ্লেষণ করতে হলে অবশ্যই তার সমকালীন সমাজকে জানতে হবে। সমাজে যখন জাতিভেদ প্রথার ছোঁয়াছুঁয়ির কবলে পড়ে নীচুতলার মানুষ ঊণমানবে পরিণত হয়ে মুক্তির আকুতি নিয়ে আকুলি বিকুলি করছিল কিন্তু প্রতিবাদের অস্ফুট স্বর কণ্ঠ পেরিয়ে মুখে আসছিল না লালন তখন এই জাতপাতের উপর খড়গ ধরলেন এবং তাদের মুখে ভাষা দিলেন। তিনি বলিষ্ঠভাবে সমাজ আরোপিত জাতপাতকে অস্বীকার করে ঘোষণা করলেন,
জাত গেল জাত গেল বলে একি আজব কারখানা/সত্য পথে কেউ নয় রাজি সব দেখি তা না না।।
যখন তুমি ভবে এলে /তখন তুমি কি জাত ছিলে/কি জাত হবা যাবার কালে/সেই কথা ভেবে বলো না।।
ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল, চামার, মুচি /এক জলেই সব হয় গো শুচি/দেখে শুনে হয় না রুচি /যমে তো কাউকেই থুবে না।।
গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায় /তাতে কি ধর্মের ক্ষতি হয় /লালন বলে জাত কারে কয়এ ভ্রম তো গেলো না।।
লালনের গানে মানবিকতা, অসাম্প্রদায়িকতা, সমাজবাস্তবতার প্রেক্ষিতে তার দর্শণের যে প্রতিফলন দেখা যায় তা দেশকালের গ-ি ছাড়িয়ে বিশ্বমানবিক মূল্যবোধের পরিচয় তুলে ধরে। লালন তাই কেবল বাঙ্গালি মরমী কবি বা গীতিকবিদের গ-িতে আবদ্ধ নন, বিশ্ব লোকসংস্কৃতির অঙ্গনেও তার অবস্থান অনেক উঁচুতে। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে জাত-ধর্মের বাহ্যিক আচরণ ও ব্যক্তির সাম্প্রদায়িক মনোভাবের বিরুদ্ধে লালন ছিলেন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। তার গান জাত-পাতের বিরুদ্ধে মৌলিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে উপস্থিত হয়। গানে তিনি বলছেন:
‘একই ঘাটে আসা যাওয়া, একই পাটনি দিচ্ছে খেওয়া
কেউ খায় না কারও ছোঁয়া বিভিন্ন জল কে কোথায় পান’
সমাজের নানা অসঙ্গতির চিত্র তাঁর গানে প্রস্ফুটিত। লোক ঠকানো, দেশি লোকের সঙ্গে বিদেশির সখ্য, লাম্পট্য, ঠকবাজ এবং প্রতারকের দৌরাত্ম্য, ভ–সাধু এবং ইংরেজ শাসনের কুফল, সর্বোপরি ধর্মভিত্তিক জাত্যাভিমান, ধর্মীয় ক্লেশ ও ধর্মীয় অসহিষুষ্ণতা যে সমাজকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে ছিল সেই চিত্র তাঁর গানের মধ্যে উঠে এসেছে। সমাজের এসব বিচ্যুতি দূর করতে তিনি নিজস্ব এক অনন্য দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করেছেন তাঁর গানে। তিনি হাজার বছরের সমাজের নির্যাস থেকে এবং সমকালের সমাজ থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে এক নতুন পথের সন্ধান দিয়েছেন। যোগবাদ-বৈষ্ণববাদ-সুফিবাদ ও বাংলার চৈতন্যবাদ তিনি আত্মস্থ করেছিলেন এবং তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে এসব চিন্তাধারার সমন্বয় করেছিলেন। তাই বলা চলে, মানবতাবাদের এক অমোঘ নিশান লালন উড্ডীন করেছিলেন। আমরা আগেই বলেছি, লালন ছিলেন বস্তুবাদী চিন্তার অধিকারী।
লালনের গানে পাই বিশ্বজনীন বা সর্বজনীন মানববন্দনার আহ্বান। তাঁর গানের মূল কথা হচ্ছে মানুষের কোনো ‘জাতি নাই’। জাত হাতে পেলে তা আগুন দিয়ে পোড়ানোর বাসনা করেছেন। এটা কোনো আধ্যাত্মিক কথা নয় বা কোনো কথার কথা নয়; এটার মধ্যে রয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদের আভাস। আর জাতি শব্দটি কিন্তু রাজনীতি বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমনটি বলেছিলেন, ‘আমার ধর্ম আমার কাছে, তোমার ধর্ম তোমার কাছে আর বাইরে সবাই ভাই ভাই।’ এটা বিশ্বজনীন মানবতাবাদের কথা এবং একই সঙ্গে এ কথায় ধর্মনিরপেক্ষতার ইঙ্গিত ব্যক্ত হয়েছে। মসজিদ-মন্দির-গির্জা-বৌদ্ধমঠ যার যার উপাসনাগারে সে যাও কোনো বাধা/বিপত্তি নাই; কিন্তু বাইরে সবাই ভাই ভাই। কেননা কাজ করতে হবে সবাইকে একসঙ্গে, জগতের সব মানুষকে থাকতে হবে মিলিতভাবে। লালন সব সময় ইঙ্গিত করেছেন মানুষের মনুষ্যত্ব গুণের প্রতি। এই মনুষ্যত্ববোধকে যদি আমরা সর্বোচ্চ বিবেচনায় নিতে পারি তাহলে যুদ্ধ-সন্ত্রাস, হানাহানি, ঝগড়া-বিবাদ একদিন দুনিয়া থেকে তিরোহিত হবে।
মানুষ এক জাতি। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-জৈন-খ্রিস্টান এসব ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু এবং এ পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে ওঠা জীবন-সংগ্রামের বা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর ভিত্তি করে। ভিন্ন ভিন্ন সমাজের সংস্কার-সংস্কৃতির কিছু উদাহরণ লালন তুলে ধরে জাতের অসারতার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন। যেমন : সুন্নত দিলে হয় মুসলমান, পৈতা ব্যবহার করলে হিন্দু; কিন্তু সেটা পুরুষ লোকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, সেখানে নারী লোককে চেনার উপায় কী? সবচেয়ে বড় কথা যখন কোনো শিশু মায়ের পেট থেকে ভূমিষ্ঠ হয় তখন কি কোনো জাতের চিহ্ন থাকে; সুতরাং এটা মানবসমাজের সংস্কার মাত্র। তা ছাড়া মোল্লা-পুরোহিত-চ-াল-চামার-তাঁতি-ধোপা-মেথর-নাপিত সব তো একই পানি পান করে। জগতের কারও জন্য কি আলাদা পানি আছে? এমনকি গোপনে পতিতার রান্না ভাত খেলে তাতে জাতের ক্ষতি হয় কি-না এমন প্রশ্নও তিনি করেছেন। এসব প্রশ্নে লালন উচ্চস্তরের মানবতার, সেই সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতার বাণী ব্যক্ত করেছেন। পৃথিবীতে আসার এবং যাওয়ার সময় যখন জাতের কোনো বালাই থাকে না, তাহলে দু’দিনের এই দুনিয়ায় মানুষে মানুষে ভেদ-বিভেদ ও মতপার্থক্য কেন? আবারও বলি, লালনের এসব কাব্যবাণীতে সুস্পষ্টভাবে ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদের কথা ব্যক্ত হয়েছে। লালন সমাজের তৃণমূল স্তরের মানুষের মুক্তির প্রবক্তা। মানুষের প্রতি মানুষের শোষণ-বঞ্চনা-অবিচার-অবজ্ঞার অবসান কামনা করেছেন তিনি। উঁচু-নিচু-ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান লালন অনুমোদন করেননি: ‘কেমন ন্যায় বিচারক খোদা কনগো আমায়। তাহলে ধনী গরীব কেন এ ভুবনে রয়।’ তাঁর আন্তরিক প্রত্যাশা ধর্ম-গোত্র-সম্প্রদায়হীন সাম্যশাসিত ন্যায়নীতির সমাজ।
আগেই বলেছি, লালন তার গানে মানবতাবাদের জয়গান গেয়েছেন। এটা কোনো বিচ্ছিন্ন প্রকরণ নয় বরং যুগের চাহিদাই ছিলো। বৃটিশদের ক্ষমতা দখল, চিরস্তায়ী বন্দোবস্ত, সিপাহী বিদ্রোহ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, সামন্তবাদের উত্থান সবকিছু মিলিয়ে উপমহাদেশে একটি ভাঙনের অধ্যায় চলছিল। আর সেই ভাঙনে ‘আগুনে ঘি ঢালা’র মতো তাঁতানোর অন্যতম উপাদান ছিলো ধর্মান্ধতা। জাতিভেদ, বর্ণপ্রথা ইত্যাদি বিষয় প্রকট আকার ধারণ করেছিল সমাজব্যবস্থায়। ঠিক তখনই কিছু শিক্ষিত, বোধসম্পন্ন ও মানবদরদী মহৎ মানুষ মানবতার জয়গান গেয়ে মানুষকে এই সমূহ বিপদ থেকে রক্ষা করতে এগিয়ে এলেন। তাদের মাঝে ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ, রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলামসহ কতিপয় কলমসৈনিক। উল্লেখিত ব্যক্তিদের মাঝে কেউ কেউ ভাববাদী ছিলেন, অন্যরা ছিলেন বিদ্রোহী। ফকির লালন সাঁই ছিলেন সেই বিদ্রোহীদের পক্ষে। তিনি সবসময় চেয়েছেন যেনো মানুষ নিজের সত্তাকে চিনে ধর্মান্ধতা, ধর্মীয় বাড়াবাড়িকে উপেক্ষা করে মানবধর্মের পথে হাঁটতে পারে। ফকির লালন শাহ্ এর মানতবতাবাদ আর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অহিংসবাদ বাস্তবায়ন হোক জয় হোক মানবতার।
লেখক: গবেষক, কলামিস্ট, আইনগ্রন্থ প্রণেতা, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী।