রাজীব কুমার দেব
এমন যদি হয় – দায়েরকৃত নালিশী দরখাস্তে (Complaint Petition) এমন কিছু অভিযোগ আনা হয়েছে যা মূলত অভিযোগ নয়; বরং বিচারাধীন মামলার ডিফেন্স। যেমনঃ- অভিযুক্ত নালিশী দরখাস্তে দাবি করেছেন যে, তিনি একটি বিচারাধীন মামলার অভিযুক্ত এবং অভিযুক্ত সেই মামলার অভিযোগকারী। তিনি অভিযোগ করেছেন যে, অভিযুক্ত ব্যক্তি (বিচারাধীন মামলার অভিযোগকারী) বিচারাধীন মামলায় প্রতারণার উদ্দেশ্যে দলিল (ওয়ারিশান সনদ/চেক/ভিসা/চুক্তিপত্র/রশিদপত্র/রেজিস্টার্ড বা নোটারিকৃত দলিল ইত্যাদি) দাখিল বা ব্যবহার করে ফৌজদারি অপরাধ করেছেন অথবা বিচারাধীন মামলায় যে দলিল দাখিল করা হয়েছে তা জাল,মিথ্যা।
ফৌজদারি অনুশীলনে দেখা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ধরনের নালিশী দরখাস্ত আমলে গ্রহণ করে তদন্ত বা প্রসেস দেওয়া হয়। ভারাক্রান্ত (Overburdened) আদালত কে আরো ভার বহন করার সুযোগ করে দেওয়া হয়।
এখন দেখা যাক এই ধরনের নালিশী দরখাস্ত রক্ষণীয় (Maintanable) কিনা?
এই ধরনের নালিশা দরখাস্ত যদি আমলে নিয়ে তদন্তে দেয়া হয়, আই. ও. কি প্রক্রিয়ায় বিচারাধীন মামলায় সাক্ষ্য হিসেবে দাখিলকৃত দলিল টি সংগ্রহ করবেন তদ বিষয়ে আইনে সুস্পষ্ট বিধান না থাকায় দলিলটি সংগ্রহ করা সম্ভব হবে না এবং ফলতঃ সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে তদন্তে ঘটনা মিথ্যা প্রমাণিত হবে। অন্যদিকে যদি মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে আসেও প্রচলিত আইনে বিচারিক আদালতের (Trial Court) বিরোধীয় দলিলটি কিভাবে সাক্ষ্য হিসেবে উপস্থাপন করা হবে সুস্পষ্ট বিধান না থাকায় সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে অভিযুক্ত খালাস পাবে। যদিও আইনের অনুপস্থিতি পক্ষকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না; তথাপি ভিন্ন ভিন্ন আদালত কর্তৃক একই সাক্ষ্য একই বিচার্য্য বিষয় নিষ্পত্তিতে ব্যবহৃত হলে উভয় মামলার ফলাফল Frustrated হতে পারে।
নালিশী দরখাস্তে যে দলিল প্রতারণামূলকভাবে দাখিল, জাল, মিথ্যা ইত্যাদি দাবি করা হয়েছে, সেই দলিল বিচারাধীন মামলার বিরোধীয় বিষয় এবং সেই মামলায় সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহারের জন্য দাখিল করা হয়েছে। সুতরাং এটি আইনি শর্তে উত্তীর্ণ হলে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য (Admissible) হয়ে বিচারাধীন মামলায় বিরোধ নিষ্পত্তি হতে পারে। অন্যদিকে বিচারাধীন মামলায় এই দলিল যদি প্রতারণামূলক/জাল ইত্যাদি প্রমাণিত হয়, তাহলে বিচারিক আদালতের (Trial Court) ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ৪৭৬ ধারা মতে প্রতারণামূলক/জাল/মিথ্যা ইত্যাদি মর্মে সংশ্লিষ্ট ফৌজদারি আদালতে অভিযোগ প্রেরণ করার ক্ষমতা রয়েছে। এমনকি বিচারিক মামলার অভিযুক্ত (নালিশী দরখাস্তের অভিযোগকারী) নিজেও দরখাস্ত মূলে উক্ত বিধানের আলোকে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বিচারিক আদালতে নিবেদন করার সুযোগ আছে। মোদ্দাকথা, নালিশী দরখাস্তে অভিযোগকারী যে যে প্রতিকার প্রার্থনা করেছেন, বিচারাধীন মামলায় সে সকল প্রতিকার প্রদানের/ পাওয়ার সুযোগ আছে।
তাছাড়া বিরোধীয় দলিল টি আইনানুগ পদ্ধতি অনুসরণ করে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় (Due Process of Law) নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ফোরাম অব ল’ (বিচারিক আদালত বা Trial Court) তে দাখিল করা হয়েছে। সুতরাং একটি ফোরাম অব ল’ বিরোধীয় বিষয় সংক্রান্তে নিষ্পত্তি অন্তে সিদ্ধান্ত না দেওয়া পর্যন্ত একই বিষয় নিয়ে আরেকটি ফোরামে নতুন অভিযোগ আনয়ন করলে বিচারাধীন মামলার নিষ্পত্তি তে প্রভাব ফেলবে এবং Multicipylicity of Cases এর প্রত্যেক্ষ কারণ হবে।
সাক্ষ্য আইনের বিধি বিধান অনুসারে Custody of document দাখিলকারীর পক্ষে একটি Legal presumption তৈরি করার জন্য যথেষ্ট। যেমন – নালিশী দরখাস্তে বিরোধীয় চেক (Cheque) বিষয়ে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা নিষ্পত্তি করতে গিয়ে দেখতে হবে চেকটি কার custody তে আছে? এক্ষেত্রে Contrary evidence না আসা অবদি চেক দাখিলকারীর পক্ষে Legal presumption যাবে। যেহেতু অভিযোগকারী চেক দাখিলকারী নন; সেহেতু নালিশী দরখাস্ত প্রসিড করা উচিত হবে না।
সাক্ষ্য আইনের ১০১ ধারার বিধান মোতাবেক বিরোধীয় দলিল প্রমাণ করার দায়িত্ব দাখিলকারীর এক্ষেত্রে Burden of Proof বিচারাধীন মামলার অভিযোগকারীর উপর বর্তায়;, Contrary evidence না আসা পর্যন্ত burden of proof shift হওয়ার সুযোগ নেই। যেমন – নালিশী দরখাস্তে যে দলিল টি চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে সেটির burden of proof বর্তাবে বিচারাধীন মামলার অভিযোগকারীর উপর; নালিশী দরখাস্তের অভিযোগকারীর উপর নয়। কিন্তু বিচারাধীন মামলার অভিযুক্ত জেরা ও ৩৪২ পর্বে বিরোধীয় দলিলটি প্রতারণামূলক, মিথ্যা, জাল ইত্যাদি দাবি করবেন উক্ত আইনের ১০৫ ধারার বিধান মতে burden of proof তার উপরই বর্তাবে। আর এটি সম্ভব হবে বিচারাধীন মামলায়; নালিশী দরখাস্তে নয়।
তাছাড়া সি আর পি সি এর ১৯৫(১)সি এর বিধান মতে আদালতে কোন মামলায় কোন পক্ষ জাল দলিল ব্যবহার করলে সেই আদালতের লিখিত নালিশ ছাড়া দণ্ডবিধির ৪৬৩ ধারায় সংজ্ঞায়িত (অর্থাৎ দণ্ডবিধির ৪৬৬, ৪৬৭ ,৪৬৮, ৪৬৯ ধারায় শাস্তিযোগ্য) কোন অপরাধ বা দণ্ডবিধির ৪৭১, ৪৭৫, ৪৭৬ ধারার কোন অপরাধ আমলে গ্রহণ করা যাবে না। আর সি আর পি সি এর ৪৭৬ ধারা মোতাবেক এই বিচারিক আদালতের বিচারক স্বাক্ষর করে ১ম শ্রেণির আমলি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নালিশ পাঠাবেন বলে বিধান রয়েছে। অতএব নালিশী দরখাস্তের অভিযোগকারী যদি তার ডিফেন্সগুলো প্রমাণ করতে পারেন বিচারিক আদালত ফৌজদারি কার্যবিধি,১৮৯৮ এর ৪৭৬ ধারা মতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। বর্ণিত পর্যবেক্ষণাদির চুলচেরা বিশ্লেষণে দেখা যায়, নালিশী দরখাস্তের এমন অভিযোগ ফোজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ৪(১এইচ) ধারা অনুসারে আদৌ “অভিযোগ” নয়। তদ বিবেচনায় নালিশী দরখাস্ত রক্ষণীয় নয়; গ্রহণযোগ্যও নয়। সুতরাং সহজেই সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়, নালিশী দরখাস্তে বর্ণিত ঘটনার প্রাইমা ফ্যাসি নেই; সত্যতাও নেই। অতএব, নালিশা দরখাস্ত ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ২০৩ ধারায় খারিজযোগ্য।
তবে বাস্তবে দেখা গেছে, খারিজা আদালত (Court of Dismissal) যদি বিচারিক আদালত (Trial Court) হয়, খারিজা আদেশের সাথে খারিজকৃত নথির ছায়া কপি বিচারাধীন মামলার নথির সাথে ট্যাগ করার নির্দেশনা দিলে ন্যায়বিচার লংঘিত হবে না।
লেখক- সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কক্সবাজার।