সিরাজ প্রামাণিক: আইন পেশায় থাকার সুবাদে অনেকে আমার কাছে জানতে চান জমির রেজিস্ট্রির পর দলিলে দাগ নম্বরে ভুল আছে, খতিয়ানে ভুল, মৌজা, চৌহদ্দিতে ভুল আবার অনেকে বলে থাকেন নামের বানানে ভুল আবার অনেকে বলে থাকেন দলিল লেখার বিবরণে বর্ণিত তারিখ, দলিল নম্বর কিংবা তথ্যের যথার্থ ভুল হয়েছে, এখন কি করা যায়।
তাদের উদ্দেশ্যে বলছি এ ধরণের ভুল আপনি সংশোধন করতে পারেন। কিন্তু কিভাবে সংশোধন করবেন, সংশোধন না করলে ভবিষ্যতে ওই দলিল নিয়ে আপনি কি কি সমস্যার মুখোমুখী হতে পারেন, আর দলিল সংশোধনের জন্য আপনাকে কোথায় যেতে হবে, কত টাকা খরচ হবে, কত সময় লাগবে-সেসকল বিষয়ে আইনী আলোচনা জানুন।
শুরুতেই জানিয়ে রাখি, এরকম অশুদ্ধ দলিল হলে আপনি যার কাছ থেকে জমি কিনেছেন তাকে বলুন রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে ভ্রম সংশোধনী দলিল করে দিতে। কারণ জমি রেজিস্ট্রি করিয়ে দেওয়ার সময় দাতা একটি হলফনামা সম্পাদন করে যে, দলিলে বর্ণিত কোন তথ্য ভুলভাবে লিপিবদ্ধ হইয়া থাকিলে তজ্জন্য আমি/আমরা দায়ী হইব এবং আমার/ আমাদের বিরুদ্ধে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা করা যাইবে। হস্তান্তরিত জমি সম্পর্কে কোন ভুল, অসত্য বা বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদান করিয়া থাকলে প্রয়োজনে নিজ খরচায় ভুল শুদ্ধ করিয়া ক্ষতিপূরণসহ নুতন দলিল প্রস্তুত ও রেজিস্ট্রি করিয়া দিতে বাধ্য থাকিব।
দলিলের মূল কাঠামো বা স্বত্বের কোন পরিবর্তন ঘটবে না সেরূপ ভুল সংশোধনের জন্য সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রার বরাবরে আবেদন করা যাবে। সাব-রেজিস্ট্রার এই ধরনের ছোট-খাটো ভুল সংশোধন করতে পারেন। এটাকে ভ্রম সংশোধনী দলিল বলা হয়। কিন্তু জমির দলিল দাতা যদি মৃত্যুবরণ করেন তাহলে তার মৃত্যুর পর ওয়ারেশগণ আপনার দাবী অনুযায়ী উক্ত দলিল সংশোধন করে দিতে পারেন। তবে ওয়ারেশরা অনিচ্ছুক হলে এ ভুল সংশোধনের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩১ ধারা অনুযায়ী উপযুক্ত আদালতে দলিল সংশোধনের মোকদ্দমা করতে হবে।
১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩১ ধারায় বলা হয়েছে, যেক্ষেত্রে প্রতারণা অথবা পক্ষগণের পারস্পরিক ভুলের জন্য কোন লিখিত দলিল হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে দলিলের যে কোন পক্ষ অথবা তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধি দলিলটি সংশোধনের জন্য মামলা দায়ের করতে পারে। তবে মনে রাখবেন, দলিল সংশোধনের মামলায় প্রতারণা বা পারস্পরিক ভুল অবশ্যই থাকতে হবে। তা না হলে দলিল সংশোধনের মামলা দায়ের করা যাবে না। মনে রাখবেন দলিল রেজিস্ট্রির তারিখ থেকে ৩ বছরের মধ্যে দেওয়ানি আদালতে দলিল সংশোধনের মোকদ্দমা করতে হয়।
তবে এ সময়ের মধ্যে দলিলের ভুল উদঘাটিত না হলে তামাদি আইনের ৯১ ও ৯৬ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দলিলের ভুল উদঘাটনের তারিখ থেকে ৩ বছরের মধ্যে মামলাটি আনয়ন করতে হয়। কারণ ৩ বছর পর এই ধরনের মোকদ্দমা তামাদির কারণে বারিত হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে তখন আর দলিল সংশোধনের মোকদ্দমা করা যায় না, তখন ঘোষণামূলক মোকদ্দমা দায়ের করা যায়। এ মামলা ১০০ বছর পরে ভুল উদঘাটিত হলেও করা যায়।
এক্ষেত্রেও আদালত কর্তৃক মামলার যে রায় দেয়া হয়, সেটাই হচ্ছে সংশোধন দলিল। অর্থাৎ রায়ের একটি সার্টিফাইড কপি আদালত থেকে সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রার এর কাছে পাঠানো হলে সাব-রেজিস্ট্রার উক্ত রায়ের আলোকে সংশ্লিষ্ট ভলিউম সংশোধন করে নিবেন। এক্ষেত্রে আর নতুন করে কোন দলিল করার প্রয়োজন নেই। মনে রাখবেন দলিল সংশোধনের মামলায় আরজিতে ক্ষতিপূরণের বিকল্প প্রার্থনা রাখতে হবে। তবে আরজিতে ক্ষতিপূরণের বিকল্প প্রার্থনা না থাকলেও আদালত তার সুবিবেচনা প্রয়োগ করে ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে পারেন।
এবার আমরা জেনে নিই কখন দলিল সংশোধন করা যায় না। যখন তৃতীয় ব্যক্তি যথাযথ মূল্যের বিনিময়ে সরল বিশ্বাসে জমি ক্রয় করেন তখন তার অধিকার হস্তক্ষেপ করে দলিল সংশোধন করা যায় না।
একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আপনাদের মাঝে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। ধরুন কুলসুম খাতুন ৪৯৬ দাগের সম্পত্তি হানিফা খাতুনের নিকট বিক্রি করেন। হানিফা খাতুন দলিল লেখকের সাথে যোগসাজশ করে কুলসুম খাতুনের ৪৯৭ দাগের সম্পত্তিটিও দলিলে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। পরবর্তী সময়ে হানিফা খাতুন ৪৯৭ দাগের সম্পত্তিটি চম্পা খাতুনের নিকট বিক্রি করে। চম্পা খাতুন সরল বিশ্বাসে জমিটি ক্রয় করে। এক্ষেত্রে কুলসুম খাতুন ৪৯৭ দাগের সম্পত্তির জন্য দলিল সংশোধনের প্রতিকার পাবে না। কারণ চম্পা খাতুন সরল বিশ্বাসে জমিটি ক্রয় করেছে। এখানে কুলসুম খাতুন ৪৯৭ দাগের সম্পত্তির জন্য হানিফা খাতুনের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ পাবে।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক।