বেলাল আজাদ: কক্সবাজার জেলা সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, গ্রামগঞ্জে বেশিরভাগ বাল্যবিবাহে কন্যা অল্প বয়সী নাবালিকা হওয়ার ফলে কাবিননামা নিবন্ধন করতে ব্যর্থ হয়ে, অনেকে নোটারি পাবলিকের ‘হলফনামা’ অথবা স্থানীয় ভাবে ৩শ’ টাকা মূল্যমানের নন-জুডিসিয়াল স্ট্যাম্পে লিখিত ‘বিবাহের চুক্তিনামা’ করে থাকেন। যা আইনে কোন বৈধতা বা গ্রহণযোগ্য নাই। সেসব হলফনামা বা চুক্তিনামা মূলে কেউ আইনগত ভাবে স্বামী/স্ত্রী বা বিবাহের স্বীকৃতি আদায় কিংবা কোন প্রতিকার পেতে পারে না। মুসলিম বিবাহ ও তালাক সংক্রান্ত আইন ও বিধি মতে, বিবাহের একমাত্র শর্ত কাবিননামা নিবন্ধন করা।
কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে কন্যার বয়স ১৮ বছরের কম (বাল্যবিবাহ), অসম বিবাহ, পরকীয়ার বিবাহ, একাধিক বিবাহ, অবৈধ ও অপ্রকাশ্য বিবাহ কার্যাদি সম্পাদনে এমন বিয়ের ‘হলফনামা/চুক্তিনামা” করা এবং তা আইনগত বিয়ের ডকুমেন্ট মনে করা হয়ে থাকে, যা সম্পূর্ণ ভুল ও অসচেতনতা। এমন ‘বিবাহের হলফনামা’ বা ‘বিবাহের চুক্তিনামা’ গুলো মূলতঃ ফেরেবি, অকার্যকর ও অবৈধ হিসেবে পরিগণিত হয়।
কাবিননামা ব্যতীত বিবাহ সংক্রান্তে অন্য কোন চুক্তিনামা/হলফনামা আইনে বৈধ না। এমন চুক্তিনামা/হলফনামা স্বামী বা স্ত্রী স্বীকৃতি প্রদান বা পরিচয় বহন করে না। দেশে, সমাজে অসংখ্য সংস্থা বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে নানা পদক্ষেপ নিলেও, বারবার সচেতনতা সৃষ্টি করলেও, গ্রামগঞ্জে তা তোয়াক্কা না করে বাল্যবিবাহ সমূহে প্রায় এমন ‘বিবাহের হলফনামা/চুক্তিনামা” দেদারসে হচ্ছে আর বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েরা এর পরিণামে ভুগছে। দু’একটি কেস স্টাডির কথা উল্লেখ করছি।
কেস স্টাডি-১
তানিয়া (ছন্মনাম) দুই শিশু সন্তান সহ আইনজীবীর চেম্বারে এসেছেন তার স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করবেন বলে। কিশোরী তানিয়ার জন্ম নিবন্ধন সনদ ও বিবাহের প্রমাণস্বরূপ তিন শ’ টাকা মূল্যমানের নন জুডিসিয়াল স্ট্যাম্পে লিখিত একটি ‘বিবাহের চুক্তিনামা’। বিজ্ঞ আইনজীবী নিজের মোবাইলে তানিয়ার জন্ম সনদ যাচাই করে দেখলেন, তানিয়া জন্ম তারিখ অনুযায়ী বর্তমান বয়স মাত্র সাড়ে ১৬ বছর। আর কম্পিউটার টাইপ করে স্ট্যাম্পে লেখা ‘বিবাহের চুক্তিনামা’ মতে, ৩ বছর আগে তার বাল্যবিয়ের সময় তার বয়স ছিল মাত্র সাড়ে ১৩ বছর! বিজ্ঞ আইনজীবী দ্বিধায় পড়ে গেলেন, কোন আইনে মামলা করবেন? একদিকে সাড়ে ১৩ বছর বয়সে নাবালিকা তানিয়ার স্বাক্ষর করা ‘বিবাহের চুক্তিনামা’ এতটুকু বৈধতা বহন করে না, অন্যদিকে তার কোলে দুই শিশু সন্তান। আইনের দৃষ্টিতে ঐ চুক্তিনামা অনুযায়ী একে তো কোন প্রতিকার মিলবে না, উল্টো এমন চুক্তিনামা করার অপরাধে মেয়েটির অভিভাবক ও চুক্তিনামা যারা করেছে, তারা সহ সাক্ষীরাও ফেঁসে যাবে! আবার এখনো নাবালিকা তানিয়ার কোলে দুই শিশু সন্তান ও স্বামী-সংসারের বোঝা!
কেস স্টাডি-২
লিমা (ছদ্মনাম) দরিদ্র পরিবারের এতিম ও নাবালিকা মেয়েটি স্বামী-সংসার চেনার আগেই অন্যের সংসারী হয়ে নানা লাঞ্চনা-গঞ্জনা সহ্য করে, অনাহারে-অর্ধাহারে ও অত্যাচারে আড়াই বছর সংসার করার পর, স্বামী তাকে তাড়িয়ে দিয়ে আরও বিয়ে করে বসে। ইতিমধ্যে স্বামী নামক অমানুষটা লিমার গর্ভের শিশুকে ঔষধ প্রয়োগে ভ্রূণে হত্যা করে। নির্যাতিত-বিতাড়িত লিমা স্বামীর বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নিতে গিয়ে বাঁধে বিপত্তি। তাদের বিয়ের ডকুমেন্ট বলতে একটা ৩শ’ টাকা মূল্যের স্ট্যাম্পে লিখিত ‘বিবাহ সংক্রান্ত চুক্তিনাম’ আছে, যা দিয়ে সে আইনগত ভাবে তার অত্যাচারী স্বামীকে নিজের স্বামী দাবী করতে পারে না। এই বিবাহের চুক্তিনামা কোন কাজে আসে না।
বিশেষজ্ঞ মত
বাল্যবিবাহে ‘বিবাহের হলফনামা/চুক্তিনামা’ প্রসঙ্গে কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিনিয়র অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ আবুল কাসেম (এপিপি) জানান, “বাল্যবিবাহ একটি সামাজিক ব্যাধি ও অপরাধ; এমন ব্যাধি ও অপরাধ কার্যে কোন ‘হলফনামা/চুক্তিনামা” করা আরও অপরাধ করা। এসমস্ত বিয়ের ‘হলফনামা/চুক্তিনামা’ আইনগতভাবে ভিত্তিহীন।”
কক্সবাজারের বিজ্ঞ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২’র পিপি অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোহাম্মদ রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে জনগণের মধ্যে আরও সচেতনতা সৃষ্টি ও আইনের প্রয়োগ করা প্রয়োজন। মুসলিম বিবাহের একমাত্র শর্ত কাজী অফিসে কাবিননামা ব্যতীত অন্য কোন চুক্তিনামা/হলফনামা করা যাবে না।’
সচেতন মহল মনে করেন, গ্রামগঞ্জে বাল্যবিবাহ বন্ধে আরও সচেতনতা সৃষ্টি ও আইনের প্রয়োগ করা এবং যে কোন বিবাহে কেবল কাবিননামা ব্যতীত অন্যকোন ‘চুক্তিনামা/হলফনামা’ বিবাহের ক্ষেত্রে না করতে সকলের সচেতন হওয়া উচিত।
বেলাল আজাদ: লেখক ও সাংবাদিক, কক্সবাজার।