সোয়েব আক্তার: বিবাহ এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে ধর্ম ও সমাজ স্বীকৃত উপায়ে বৈধ জৈবিক চাহিদা মেটানোর সাথে সাথে বংশ পরম্পরা রক্ষায় সন্তান উৎপাদন করাই প্রধান লক্ষ্য। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে যেসব ধর্ম রয়েছে সেগুলোর মধ্যে ইসলাম এবং হিন্দু ধর্ম অনুসরণকারীই সংখ্যাগরিষ্ঠ, এছাড়াও রয়েছে খ্রিস্টান, বৌদ্ধসহ আরো অনেক ধর্ম পালনকারীর বসবাস। সকল সমাজ ও ধর্মে বিয়ে একটি সামাজিক ও বৈধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত। বৈধ বিয়ে মানুষের জন্য অবৈধ এবং অনৈতিক যৌন চাহিদা মেটানোর পাপ থেকে একপ্রকার রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে।
ইসলাম ধর্মে বিয়েকে একটি চুক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অন্যদিকে, হিন্দু ধর্মে বিয়েকে সংস্কার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রতিটা ধর্মের কিছু বিধান রয়েছে যেসব অনুসরণ করে বিয়ে করা অত্যাবশ্যকীয় কাজ। বিভিন্ন ধর্মের বিবাহ আইনগুলো একে অন্যের চেয়ে আলাদা। যেমন বলা যায়- কখন বিয়ে করা যাবে, কাকে করা যাবে, কাকে যাবে না, কয়জন সাক্ষী লাগবে, ধর্মীয় কি কি আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হবে ইত্যাদি!
ইসলামি শরীয়া আইনে বিয়েকে খুব সহজ করা হয়েছে। তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান থাকলে সাধারণত বৈধ বিয়ে হয়ে গেছে বলে ধরে নেয়া হয়, ১. প্রস্তাব দেয়া ২. গ্রহণ/কবুল করা ৩. সাক্ষীর উপস্থিতি। কোন একটি মিটিংয়ে যেকোন এক পক্ষ থেকে প্রস্তাব দিবে এবং অন্য পক্ষ সেই প্রস্তাব গ্রহণ করবে নির্ধারিত সাক্ষীর সম্মুখে। এটা হলো ইসলামি আইনে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা।
যাইহোক, একজন মুসলমান পুরুষ যেকোন একজন কিতাবিয়ান নারীকে বিয়ে করতে পারবে, কিন্তু একজন মুসলমান নারী শুধু একজন মুসলমান পুরুষকেই বিয়ে করতে পারবে। মূর্তিপূজক কোন নারীর সাথে বিয়ে ইসলামে বৈধ নয়। এছাড়া আরও অনেক বিধিনিষেধ আছে। হিন্দু ধর্মেও এমন অনেক বিধিনিষেধ রয়েছে বিয়ের ক্ষেত্রে যেগুলো অনুসরণ করা অতীব জরুরি।
এসব নিয়মকানুন ও ধর্মীয় বিধিনিষেধের বাইরে গিয়েও মানুষের প্রণয়, প্রেম কিংবা ভালোবাসা হতে পারে অন্য কোন ধর্মের ছেলে/মেয়ের সাথে। জটিলতা গুরুতর আকার ধারণ করে যখন ভিন্ন ধর্মের প্রেমিকযুগল তাদের প্রণয়কে বিয়েতে গড়াতে চান, স্বামী-স্ত্রী হিসেবে সমাজে বসবাস করতে চান। তখন ধর্মীয় বিধিনিষেধ এরকম বিয়ের জন্য অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় কেননা ধর্মীয় অনুশাসনে এরকম বিয়ের অনুমতি নেই। তবে এরকম পরিস্থিতির বিয়েকে আইনগত বৈধতা দেয়ার জন্য রাষ্ট্রীয় আইন রয়েছে, বিশেষ বিবাহ আইন ১৮৭২, যার মাধ্যমে ভিন্ন ধর্মী প্রেমিকযুগল চাইলে বিয়ে করতে পারেন। এই আইনে বিশেষ বিয়ের জন্য যেসব বিধান রয়েছে তার সারসংক্ষেপ তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
এই আইনের প্রস্তাবনা দেখলে বুঝা যায়, এ আইন ঐসব মানুষের জন্য করা হয়েছে যারা ইসলাম, ইহুদি, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, হিন্দু, পার্সি, শিখ, জৈন ধর্মে বিশ্বাস করেন না কিংবা এসব ধর্মের অনুসারী হয়েও নিজ ধর্মের বাইরে গিয়ে কাউকে বিয়ে করতে চান তাদের মধ্যকার বিয়ে এবং যারা হিন্দু, জৈন, শিখ, বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী তাদের মধ্যকার বিয়ের বৈধতা প্রদানের জন্য করা হয়েছে।
এ আইনের ধারা ২ অনুযায়ী ভিন্ন ধর্মী দুজন ছেলে মেয়ে বিয়ে করতে চাইলে তাদেরকে কয়েকটি নিয়ম মানতে হবে, যেমনঃ পুরুষ/মহিলা কারোরই কোন স্ত্রী/স্বামী বর্তমান থাকতে পারবে না, পুরুষের বয়স ১৮’র উপরে এবং নারীর ১৪’র উপরে হতে হবে, পুরুষ এবং নারী এমনভাবে জন্মসূত্রে আত্মীয় হতে পারবেন না যেটা তাদের নিজ নিজ ধর্মে বিয়ের জন্য বৈধ নয়, এছাড়াও যদি তারা উভয়ে ২১ বছরের বেশি না হয় তাহলে তাদের পিতামাতা কিংবা অভিবাকের অনুমতি নিতে হবে। এর পরেও বেশ কিছু আনুষ্ঠানিকতা অনুসরণ করতে হয়। এই আইনের অধীনে বিশেষ বিবাহ সম্পন্ন করার জন্য সরকার রেজিস্ট্রারার নিয়োগ করেছেন। পুরুষ/নারী উভয়ের পক্ষ থেকে যেকোন একজন তার জেলায় নিযুক্ত উক্ত রেজিস্ট্রারার এর কাছে লিখিত নোটিশ পাঠাতে হবে, যার মাধ্যমে পুরো বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয়ে থাকে।
নোটিশ পাওয়ার পর, যদি কারো থেকে কোন প্রকার আপত্তি (অবজেকশন) না আসে, উক্ত রেজিস্ট্রারার বিয়ে সম্পন্ন করার একটি নির্দিষ্ট তারিখ দিবেন (যদি আপত্তি আসে তাহলে সেটি নিষ্পত্তি করার পদ্ধতি নিয়ে উক্ত আইনে বলা আছে)। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা রেজিস্ট্রেশন অফিসে হতে পারে কিংবা উক্ত অফিসের কাছাকাছি অন্য কোন জায়গায়ও হতে পারে। তবে, বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার জন্য তিনজন সাক্ষী ও উক্ত রেজিস্ট্রারের উপস্থিতি থাকতে হবে যাদের সামনে বর-কনে নিজেদেরকে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে মেনে নেয়ার ঘোষণা দিবেন।
এখানে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এ আনুষ্ঠানিকতার পূর্বেই উভয়কে একটি ডিক্লারেশনে স্বাক্ষর করতে হবে এই বলে যে তারা ইসলাম, ইহুদি, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, হিন্দু, পার্সি, শিখ, জৈন ধর্মে বিশ্বাস করেন না (এক্ষেত্রে পূর্বে ২জন সম্পূর্ণ আলাদা ধর্মের বিশ্বাসী হতে পারে, যেমন: মুসলিম ছেলে হিন্দু মেয়ে, খ্রিস্টান ছেলে মুসলিম মেয়ে, আবার এমনটাও হতে পারে উভয়ে এর একটিতেও বিশ্বাস করতেন না), কিংবা তারা হিন্দু, জৈন, শিখ, বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী (যেমন হতে পারে, হিন্দু ছেলে শিখ মেয়ে, জৈন ছেলে হিন্দু মেয়ে)। একটি কেস ল’তে বলা হয়েছে যদি তারা এরকম ডিক্লারেশন না দিয়ে বিয়ে করে থাকে তাহলে সেই বিয়ে বৈধ বলে বিবেচিত হবে না (১৮ ডিএলআর ৫০৯)।
উক্ত ডিক্লারেশনে উভয় পক্ষ, সাক্ষী এবং রেজিস্ট্রারের স্বাক্ষর থাকবে। যদি বর-কনে উভয়ের কারো বয়স ২১ এর নিচে হয় তাহলে সেক্ষেত্রে তাদের পিতামাতা কিংবা অবিভাবকের স্বাক্ষর লাগবে। আনুষ্ঠানিক কাজগুলো শেষ হওয়ার পর উক্ত রেজিস্ট্রেশন অফিস থেকে বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার একটি সার্টিফিকেট দিবেন যা এই আইনের অধীনে তাদের বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার দলিল বলে বিবেচিত হবে। সমাজে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বসবাস করার জন্য আইনগত স্বীকৃতি পেয়েছন বলে বিবেচিত হবেন।
বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সামাজিক স্বীকৃতি অর্জনের জন্য খুবই জরুরি। একই সাথে নিজ নিজ ধর্মীয় বিশ্বাসের বাইরে গিয়ে বিয়ে করতে চাইলে রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী করা সম্ভব হলেও সামাজিক স্বীকৃতি অর্জনের ক্ষেত্রে অনেক বেগ পেতে হয়। এমনকি এরকম বিয়ে করার কারণে উভয়কে এবং উভয়ের পরিবারকে সমাজে একঘেয়ে করে রাখার মতো পরিস্থিতিও দেখা যায়।
অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রীয় জীবন কাঠামো এবং জীবনবোধে আধুনিক চিন্তা ধারার ছোয়া এরকম বিশেষ বিবাহের ব্যবস্থা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। যদিও এ আইনের কিছু কমতি রয়েছে তথাপি প্রেম-ভালোবাসাকে শেষ পরিণতি দেয়ার জন্য এ আইন বিয়েকে আইনী বৈধতা দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসীদের জন্য বিয়েকে করেছে সহজ, সরল ও স্বাভাবিক।
লেখক: শিক্ষার্থী; আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।