হবিগঞ্জের বিভিন্ন নদ-নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। বিষয়টি সরেজমিনে তদন্ত করে সংশ্লিষ্টদের আগামী ৩১ মে -এর মধ্যে আদালতে সবিস্তারে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। সেইসাথে তদন্তকালে ধর্তব্য (Cognizable) অপরাধ উদ্ঘাটিত হলে নিয়মিত মামলা করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে একটি জাতীয় দৈনিকের অনলাইন ভার্সনে ও স্থানীয় পত্রিকাসমূহে প্রকাশিত সংবাদ আমলে নিয়ে মঙ্গলবার (১২ এপ্রিল) হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জাকির হোসাইন স্বপ্রণোদিত হয়ে এ আদেশ দেন।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে যা বলা হয়
হবিগঞ্জের বিভিন্ন নদ-নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। নদীতে সৃষ্ট চর থেকে বালু মাটি উত্তোলন করছে একটি প্রভাবশালী চক্র। জেলার কুশিয়ারা, রত্না, বিজনা, সুতাং, করাঙ্গী নদী, বিশেষ করে খোয়াই ও কুশিয়ারা নদীর বিভিন্ন স্থান থেকে ইজারা বহির্ভূতভাবে চক্রটি বালু উত্তোলন করছে।
তারা নদীগুলোতে ছোট আকৃতির অসংখ্য ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু-মাটি তুলে দিন-রাত ট্রাক ও ট্রাক্টরযোগে জেলা সদরসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করছে। মাটিবাহী ট্রাক-ট্রাক্টরের বিকট শব্দে এবং ধুলো বালিতে হবিগঞ্জ শহর ও নদী তীরবর্তী এলাকায় জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। নদী থেকে অব্যাহতভাবে অবৈধ ও অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন করায় নদী তীর ভাঙনের সম্মুখীন হওয়া ছাড়াও ফসলি জমি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বাড়ি ঘর নদী গর্ভে বিলীন হচ্ছে। নদী হারাচ্ছে শাশ্বত রূপ।
স্থানীয়দের অভিযোগ, কোনো নদীর উপর নির্মিত ব্রিজের ১৫০ গজের মধ্যে বালু তোলার ক্ষেত্রে বিধি নিষেধ থাকলেও তা নিয়মিত লঙ্ঘিত হচ্ছে। ফলে খোয়াই নদীর উপর নির্মিত কয়েকটি ব্রিজ হুমকির সম্মুখীন রয়েছে। চুনারুঘাট উপজেলার সীমান্তবর্তী বাল্লা থেকে বানিয়াচং উপজেলার সুজাতপুর ইউনিয়নের প্রান্ত সীমানা পর্যন্ত খোয়াই নদীর উভয় পাশে নদী থেকে বালু উত্তোলনের ফলে নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধও দুর্বল হয়ে পড়ছে।
নদী সংশ্লিষ্ট হবিগঞ্জ সদর, আজমিরীগঞ্জ, নবীগঞ্জ, চুনারুঘাট উপজেলা প্রশাসন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে নদী থেকে অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের নিয়মিত জরিমানা করা সত্ত্বেও কিছুতেই থামছে না এ তৎপরতা।
আদালত কর্তৃক সংবাদ বিশ্লেষণ
বিষয়টি আদালতের নজরে সংবাদ বিশ্লেষণে দেখা যায়, জেলার কুশিয়ারা, রত্না, বিজনা, সুতাং, করাঙ্গী নদী, বিশেষ করে খোয়াই ও কুশিয়ারা নদীর বিভিন্ন স্থান থেকে ইজারা বহির্ভূতভাবে চক্রটি বালু উত্তোলন করছে। এই বালু ও নদীর তীরবর্তী মাটি বিভিন্ন ধরনের ট্রাক্টর দিয়ে পরিবহন করে নদীর ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করছে। পাশাপাশি এর মাধ্যমে নদীর বাধঁকে হুমকির মধ্যে পরছে, নদী তীরবর্তী ব্রীজসমূহ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এবং এতে নদী ভাঙ্গন তীব্র হবে।
সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী বেআইনীভাবে ট্রাক্টর দ্বারা বালি ও মাটি পরিবহন এবং হবিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন শহরে বালু ও মাটি ছড়ানোর প্রেক্ষাপটে বায়ূতে প্রচুর পরিমানে বালু প্রবাহিত হওয়ায় বাতাসে ধুলাবালি ছড়িয়ে পড়া ও বায়ূ দুষণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হয়।
সাম্প্রতিককালে হবিগঞ্জ জেলায় নদীর বালু ও মাটি পরিবহনকালে অবৈধভাবে পরিচালিত ট্রাক্টর দ্বারা বেশ কয়েকেটি মারাত্মক সড়ক দূর্ঘটনা হয় এবং বেশ কয়েকজন ব্যক্তি গুরুতর আহত ও নিহত হন। এই ঘটনাসমূহের বিষয়ে ইতোমধ্যে সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ এর অধীনে বেশ কয়েকটি মামলা বিচারাধীন আছে।
প্রকাশিত সংবাদে বর্ণিত অভিযোগ ও পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী বেআইনীভাবে বালু ও মাটি উত্তোলন ও অভিযোগে বর্ণিত অপরাধ “বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০ এর ধারা ৪, ১৫ ও বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১৩ এবং বিধিমালা, ২০১৮ এবং দ্যা পেনাল কোড, ১৮৬০ এর ৪৩১ ধারা ও সড়ক পরিবহণ আইন, ২০১৮ এর ধারা ৪৩, ৪৫, ৪৬, ৬৬, ৭৫, ৮৬, ৮৯, ৯৮ লঙ্ঘন ও অপরাধ মর্মে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়।
এই অবস্থায় জনস্বার্থে, স্থানীয় নদীর স্বাভাবিক জীবন ও পানি প্রবাহ রক্ষার স্বার্থে, জেলার বায়ূ ও পরিবেশ রক্ষার উদ্দেশ্যে এবং সর্বোপরি ন্যায় বিচারের উদ্দেশ্যে উল্লেখিত নদীসমূহের অত্র জেলাধীন প্রবাহিত এলাকায় সংবাদ ও অভিযোগে বর্ণিত অপরাধ উদ্ঘাটন, সুষ্ঠ তদন্ত, আসামীদের চিহ্নিতকরণ ও সংবাদে প্রকাশিত ঘটনা ও ব্যক্তিদের বিষয়ে বিস্তারিত তদন্ত প্রয়োজন মর্মে আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয়।
আদালতের আদেশ
ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০(১)(সি) ধারা অনুযায়ী সংবাদটি আমলে নিয়ে বিস্তারিত ও সুষ্ঠ তদন্তের লক্ষ্যে হবিগঞ্জের র্যাব-৯ এর কমান্ডারকে ঘটনা তদন্তে জেলাধীন প্রতিটি থানা এলাকার জন্য আলাদাভাবে একজন করে দক্ষ ও অভিজ্ঞ তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগের নির্দেশ দেন আদালত। সরেজমিনে তদন্তপূর্বক প্রতিটি থানা এলাকায় মামলায় বর্ণিত ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তিদের বিষয়ে আলাদাভাবে বিস্তারিত প্রতিবেদন আগামী ৩১ মে এর মধ্যে দাখিলের নিদের্শ প্রদান করা হয়। র্যাব কমান্ডারকে তদন্ত কাজের সমন্বয় করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
একইসঙ্গে আদেশে তদন্তকালে হবিগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ও সকল সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) তথ্য উপাত্ত দিয়ে সার্বিক সহযোগিতার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে নদীর বালু উত্তোলনে ইজারাপ্রাপ্ত বৈধ ব্যক্তিদের তালিকা আদেশ প্রাপ্তির সাত দিনের মধ্যে আদালতে দাখিলের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। একইসঙ্গে সংবাদে উল্লেখিত বাঁধের বিষয়ে আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য হবিগঞ্জের পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীকে নির্দেশ প্রদান করা হয়।
এ ঘটনা তদন্তকালে অবৈধভাবে বালু ও মাটি উত্তোলন কাজে ব্যবহৃত স্কেভেটর, ট্রাক্টর, ড্রেজার মেশিনসহ যন্ত্রপাতি পাওয়া গেলে জব্দ করার নির্দেশ প্রদান করা হয়। পাশাপাশি তদন্তকালে ধর্তব্য (Cognizable) অপরাধ উদ্ঘাটিত হলে নিয়মিত মামলা রুজুর নির্দেশ প্রদান করা হয়।