বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বৈবাহিক ধর্ষণ: আদালতের রায় বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা 
ফাইজুল ইসলাম

বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ: আদৌ আইন সমর্থন করে কি না

ফাইজুল ইসলাম: বর্তমান যুগে সমান অধিকার বলবত থাকলেও নারীরা আইনে অনেক সুযোগ সুবিধা ভোগ করেন। কিন্ত এই সুযোগ ভোগ করতে গিয়ে যখন তা কারো ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় তখন তা নিঃসন্দেহে অপরাধ। সেই সাথে আইনের অপব্যাখ্যা দেয়াও অপরাধের শামিল। আজ আমরা আলোচনা করবো বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ নামে এই স্পর্শকাতর বিষয়টি নিয়ে। আমাদের বিদ্যমান আইনে ধর্ষণের শাস্তি আছে, কিন্ত বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ নামে কোন শাস্তিযোগ্য অপরাধের কথা উল্লেখ নেই।

ধর্ষণের সংজ্ঞায় বিদ্যমান আইন কি বলে?

দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারা অনুযায়ী ধর্ষণের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যদি কোন ব্যক্তি কোন স্ত্রীলোকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অথবা সম্মতির বিরুদ্ধে অথবা সম্মতি নিয়েই যেক্ষেত্রে মৃত্যু বা গুরুতর যখমের ভয় প্রদশর্ন করা হয় অথবা স্ত্রীলোকের সম্মতি নিয়েই যেক্ষেত্রে পুরুষটি জানে সে স্ত্রীলোকটির স্বামী নয় এবং পুরুষ লোকটি এটাও জানে যে, স্ত্রী লোকটি তাকে এমন একজন পুরুষ মনে করেছে যার সাথে সে আইনগত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ বলে বিশ্বাস করে অথবা স্ত্রীলোকটির সম্মতিক্রমে অথবা সম্মতি ছাড়া যদি স্ত্রী লোকটির বয়স চৌদ্দ বছরের কম হয় এমন স্ত্রীলোকের যৌনাঙ্গ যৌনাচার সম্পন্ন করলে তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে।

সংজ্ঞাটি বড় হলেও দণ্ডবিধি অনুযায়ী এটিই ধর্ষণের সংজ্ঞা।

দণ্ডবিধি অনুযায়ী ধর্ষণ প্রমাণ করতে হলে ৫ টি বিষয় প্রমাণ করতে হবে।

প্রথমত, স্ত্রীলোকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে

দ্বিতীয়ত, স্ত্রীলোকটির সম্মতির বিরুদ্ধে

তৃতীয়ত, স্ত্রীলোকটির সম্মতি নিয়েই যেক্ষেত্রে তাকে মৃত্যু বা গুরুতর যখমের ভয় প্রদশর্ন করা হয়।

চতুর্থত, স্ত্রীলোকের সম্মতিক্রমেই যেক্ষেত্রে পুরুষটি জানে সে স্ত্রীলোকটির স্বামী নয় এবং পুরুষ লোকটি এটাও জানে যে, স্ত্রী লোকটি তাকে এমন একজন পুরুষ মনে করেছে যার সাথে স্ত্রীলোকটি আইনগত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ বলে বিশ্বাস করে।

পঞ্চমত, স্ত্রীলোকটির সম্মতিক্রমে অথবা সম্মতি ছাড়া যদি স্ত্রী লোকটির বয়স চৌদ্দ বছরের কম হয়

এমন স্ত্রীলোকের যৌনাঙ্গ যৌনাচার সম্পন্ন করলে তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে।

Jejma Bai Vs Firoz Bashir, AIR,1982 এই মামলায় এলাহবাদ হাইকোর্ট ঘোষণা দিয়েছেন, “ধর্ষণ প্রমাণ করতে হলে without any reasonable doubt স্ত্রীলোকটির সম্মতির বিরুদ্ধে যৌনাচার হয়েছে তা প্রমাণ করতে হবে।”

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ধারা ৯ (১) ধর্ষণের ব্যাখায় বলা হয়েছে যে, “কোন পুরুষ বিবাহবন্ধন ছাড়া ১৬ বছরের অধিক বয়সের কোন নারীর সঙ্গে তার সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে অথবা ১৬ বছরের কম বয়সের কোন নারীর সঙ্গে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ছাড়া যৌন সঙ্গম করেন, তাহলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করেছেন বলে গণ্য হবেন।”

বিদ্যমান আইনের কোথাও প্রলোভন কথাটির লেশমাত্র নাই। আইনে কোন নারীকে মাদক দিয়ে বা জোরপূর্বক যৌনসঙ্গম করা হলে তা ধর্ষণ হবে। ব্লাকমেইলিং করে বা কোন নারীর অশ্লীল ভিডিও ধারণ করে ভয়ভীতি দেখিয়ে যৌনাচারে বাধ্য করলেও তা ধর্ষণ হবে। যদিও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন বিশেষ আইন কিন্ত ধর্ষণের ক্ষেত্রে দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারাই সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য। এই আইনের কোথাও বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের বিষয়টি সংজ্ঞায়িত করা হয়নি।

সম্মতি, প্রলোভন ও ধর্ষণ

ধর্ষণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় নারীর সম্মতি ছিল কি না যৌনাচারে। সম্মতি থাকলে ধর্ষণ হবে না। সম্মতি না থাকলে ধর্ষণ হবে। কোন নারীকে যদি কোন পুরুষ এই আশ্বাস দেয় ভবিষ্যতে সে তাকে বিয়ে করবে। যার ফলে নারীটি স্বেচ্ছায়, স্বজ্ঞানে, সম্মতিতে পুরুষটির সাথে যৌনসঙ্গম করে। পরবর্তীতে ঐ পুরুষ যদি ওই নারীকে বিয়ে না করে তবে সেখানে ধর্ষণের প্রশ্নই ওঠে না। কারণ সেখানে নারীর প্রত্যক্ষ সম্মতি ছিল। সম্মতি নিয়ে দৈহিক সম্পর্ক হলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না, তবে বয়স হতে হবে ষোলো বছরের বেশি।

বিয়ের প্রলোভনে সম্মতি কোন বৈধ চুক্তি কি না?

বিয়ের প্রলোভনে সম্মতি যদি ধর্ষণ না-ই হয় তবে প্রশ্ন মনে আসতেই পারে যে, বিয়ের প্রলোভনে সম্মতি আদায় কোনো বৈধ চুক্তি হতে পারে কি না? সেক্ষেত্রে ধর্ষণ না হয়ে চুক্তি ভঙ্গের মামলা দায়েরের কোনো সুযোগ রয়েছে কি না?

আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে আপাতত না। কারণ, মুসলিম শরীয়াহ আইনের বিধানানুযায়ী, “ভবিষ্যতে বিবাহের প্রতিশ্রুতি সংক্রান্ত কোনো মৌখিক চুক্তি অনুমোদিত না। উপরন্তু, বিবাহের চুক্তি সর্বদা লিখিত ও নিবন্ধিত হতে হবে।”

তথাপি, চুক্তি আইন ১৮৭২ এর ২ (জ) ধারানুযায়ী, যে কোনো সম্মতি বা কোনো বিষয়ে কথা দিলেই তা চুক্তিতে রূপান্তর হয় না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সম্মতিটি আইন দ্বারা বলবৎ যোগ্য হয়।

আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ধর্ষণের ব্যাখ্যা

15 DLR 155 তে বলা হয়, “ধর্ষণের অপরাধে কোন পুরুষকে শাস্তি প্রদান করতে হলে শুধু নারীর বক্তব্য অনুযায়ী তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্ষণ করা হয়েছে এরূপ ভাষা গ্রহণ সঠিক নয়। ওই নারীর বক্তব্য অবশ্য অপরাপর সাক্ষীর মাধ্যমে সমর্থিত হবে।”

মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট হানিফ শেখ বনাম আছিয়া বেগম মামলায়, 51 DLR 129 পৃষ্ঠায় এবং আরেকটি একই ধরণের মামলা যা 17 BLT 25 উল্লেখ আছে “১৬ (ষোল) বছরের অধিক বয়সী কোন মেয়েকে যদি কোন পুরুষ বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে তাহলে তা ধর্ষণের আওতায় আসবে না।”

57 DLR 591 তে অভিযুক্তের সঙ্গে কথিত ধর্ষিতা প্রাপ্তবয়স্ক নারী যখন যৌন সঙ্গমে অভ্যস্ত বলে প্রমাণ পাওয়া যায় এবং উক্ত নারী যৌন সঙ্গমে কোন ধরনের বাধা প্রদান করেননি বা বাধা প্রদানের চেষ্টাও করেননি অথবা কোন চিৎকার করেননি তখন কথিত ধর্ষিতা একজন যৌন সঙ্গমে ইচ্ছুক অংশীদার হওয়ায় তা ধর্ষণের অপরাধ বলে গণ্য হবে না বলে উচ্চ আদালত অভিমত প্রকাশ করেছেন

বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ

২০০৭ সালে মনোয়ার মল্লিক বনাম রাষ্ট্র মামলায় বিচারপতি ছিদ্দিকুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি রেজাউল হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ একটি রায় দিয়েছিল। এতে বলা হয়, ‘অভিযোগকারী নারী বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে স্বেচ্ছায় যৌন মিলনে সম্মত হয়েছেন। তবে এ কারণে আসামিকে ধর্ষণের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না।’

২০১৬ সালে নাজিম উদ্দিন বনাম রাষ্ট্র মামলায় বিচারপতি মো. এমদাদুল হক ও বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাসের হাইকোর্ট বেঞ্চও রায়ে বলেন, “ধর্ষণের ক্ষেত্রে সম্মতিই মুখ্য, বিয়ের প্রলোভন বলে কোন কিছুই সম্মতিকে বৈধ করতে পারে না। প্রলোভনে সম্মতি হলেও লোভের বশবর্তী হয়ে যৌনাচার হয়েছে, এক্ষেতে পুরুষকে ধর্ষণের শাস্তি দেয়া যায় না যেখানে নারীর সম্মতি ছিল।”

Ameerzan Vs Julfikar Desai, AIR 2008 মামলায় কর্নটক আদালত মন্তব্য করেন, বিয়ের প্রতিশ্রুতিকে কোনোভাবেই দীর্ঘায়িত ও একান্ত যৌন সম্পর্কের প্ররোচনা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে না।’

Soshi Bansal Vs Binod Rasman মামলায় দিল্লি হাইকোর্ট রায়ে বলেন, “কোনো নারী স্বেচ্ছায় দীর্ঘদিন ধরে কারো সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক বজায় রাখার পর ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে তিনি ‘বিয়ের প্রলোভন’ দেখিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ আনতে পারবেন না।”

মন্তব্য

পরিশেষে আদালতের রায় ও বিদ্যমান আইন কোনটিই বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ এই বাক্যটিকে ধর্ষণের আওতাভুক্ত করে না। মূলত এটা হয়রানির জন্য অনেক সময় মৌখিক স্বীকৃতির জন্য ব্যবহার করা হয়।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিজ্ঞ আইনজীবী ফাওজিয়া করিমের একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য, ‘আমি আইনজীবী হিসেবে দেখেছি অনেক ক্ষেত্রে দুই পক্ষের সম্মতিতেই সম্পর্ক হয়ে থাকে। পরে কোনো এক পর্যায়ে দেখে যে সুবিধা হচ্ছে না, তখনই মামলা মোকদ্দমা করা হয়। ধরেন কোনো পুরুষ সম্পর্কে জড়ানোর পরে যদি সে তার পছন্দসই অন্য কাউকে বিয়ে করতে চায়, কিংবা তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে, তখনই নারী তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করে দেন। এক্ষেত্রে আমার অভিমত হলো, এখানে ধর্ষণের অভিযোগে নয়, প্রতারণা বা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অভিযোগে মামলা হওয়া উচিত।’

অতএব বিজ্ঞ আদালতের রায় ও দেশের বিদ্যমান আইনে বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ বলে কোন কিছুই নেই। এটি মূলত পুরুষকে হয়রানি করার একটা যোগসাজশ মাত্র।

লেখক: শিক্ষার্থী; আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।