ফাইজুল ইসলাম: আসামী আছে, উকিল নেই। সাক্ষীরও দরকার হয় না। যিনি বিচার করবেন সেই বিচারকও নেই। কাঠগড়াও নেই। কিন্তু আদালত আছে, বিচারও চলে। তবে উক্ত আদালতে কোনো আসামির জামিন হয় না। কেউ খালাসও পান না। এমন নজিরও নেই। শুধুই শাস্তি হয়। এই বিচার প্রহসনের নামান্তর। এর নাম মোবাইল কোর্ট।
জনপ্রিয়তা আর ন্যায়বিচার একই বিষয় নয়। ন্যায়বিচারের স্বার্থে অনেক বিষয় বিবেচনা করা হয়। শুধু আইনের সীমানা দিয়ে ন্যায়বিচার সম্ভব না। ন্যায়বিচারের স্বার্থে বিচারককে আইনের পাশাপাশি প্রজ্ঞা, ঘটনাক্রম, আইনের নজির দিয়ে কোন বিষয় বিবেচনা করা হয়। বিচারের দায়িত্ব বিচারকের। আর এই বিচার যে কেউ করতে পারে না। কারণ বিচারের সাথে অনেকগুলো বিষয় জড়িত। এজন্য যে কেউ ইচ্ছা করলেই বিচারক হতে পারে না।
ন্যায়বিচারের মূলনীতি
Principle of natural Justice এর শর্ত হচ্ছে তিনটি। এই তিনটি নীতি এসেছে আদি রোমান আইন jus Natural থেকে। কোন মামলায় যদি এই নীতি মানা না হয় তবে সেখানে কস্মিনকালেও ন্যায়বিচার সম্ভব না। পৃথিবীর প্রতিটি দেশ ন্যায়বিচারের স্বার্থে এই নীতিগুলোর উপর নির্ভরশীল। ন্যায়বিচারের নীতি নিম্নরূপঃ
প্রথমত, Audi Alteram Partem or hear from the other side অর্থাৎ প্রতিটি মামলায় প্রতিটি পক্ষকে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করার ন্যায্য সুযোগ দেওয়া হবে। যদি কোন পক্ষকে আত্মপক্ষ সমর্থন এর সুযোগ বঞ্চিত করা হয় তবে তা ন্যায়বিচার হয়নি বলে ধরে নেয়া হবে।
দ্বিতীয়ত, No one can not be judge in his own case (Rule against bias) অর্থাৎ কেউ তার নিজের মামলায় বিচারক হতে পারবেন না। কোন মামলার সিদ্ধান্ত অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে দেওয়া হবে যা প্রাকৃতিক ন্যায়বিচারের শাসনকে পরিপূর্ণ করতে পারে এবং
তৃতীয়ত, Speaking order অর্থাৎ বিচারক কোন রায় দিলে সেই রায়ের কারণ বর্ণনা করতে হবে। যা বলে যে আদেশ, সিদ্ধান্ত বা আদালতের রায় একটি বৈধ এবং যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি সহ প্রেসাইডিং কর্তৃপক্ষ প্রদত্ত।রায়ের মধ্যেই রায়ের যথাযথ কারণ উল্লেখ থাকবে।
এই হচ্ছে ন্যায়বিচারের নীতি।পৃথিবীর প্রতিটি মামলায় ন্যায়বিচারের এই নীতি মেনে চলতে হবে।
রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগ
আধুনিক সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের বিভাগ মূলত তিনটি।
১. আইন বিভাগ
২. শাসন বিভাগ
৩. বিচার বিভাগ
আইন বিভাগ বা সংসদের কাজ আইন তৈরি করা, শাসন বিভাগের কাজ আইন বাস্তবায়ন করা আর বিচার বিভাগের কাজ ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।
গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল রাষ্ট্র পরিচালনার সফলতার জন্য ত্রিমাত্রিক ক্ষমতা বিভাজনের কথা বলেছিলেন: Public Assembly, Magistrate এবং Judiciary। এখানে Magistrate নির্বাহী শাসনের প্রতীক। ফরাসী দার্শনিক মন্টেস্কু তাঁর বিখ্যাত The Spirit of Laws বইয়ে Theory of Separation of powers সম্পর্কে বলেছেন- Each power should be checked & balanced. যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট ফেডারেল জুডিসিয়াল সিস্টেমে সর্বোচ্চ আপিল আদালত, যা’ যুক্তরাষ্ট্রের Constitution, Federal Legislation এবং Treaties এর ব্যাখ্যা প্রদান করে।
এখানে বলা হয়েছে, ‘Legislative Makes the Law, Executive Enforces the Law & Judicial Interprets the Law.’ কিন্তু কোনো বিচার কাজেই কোনো বিভাগ সর্বশক্তিমান নয়। প্রত্যেকের ক্ষমতা ও এখতিয়ার সংবিধান ও আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্যে যার যার অবস্থানে সবাই বিচারক, কিন্তু প্রত্যেকে একে অন্যের পরিপূরক।
বাংলাদেশে ক্ষমতা বিভাজিকরণের (Checks and balances) নীতি অনুসরণ করা হয়। বাংলাদেশে সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথককরণের দায়িত্ব রাষ্ট্রের ওপর ন্যস্ত।
কারা বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট ও কারা বিচার করবেন
CRPC তে ম্যাজিস্ট্রেট বলতে একমাত্র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কে বুঝায়। এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট বলে কোন পদ নেই।
বাংলাদেশে নিম্ন আদালতের বিচারক নিয়োগ হয় Bangladesh Judicial Service পরীক্ষার মাধ্যমে। সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নিম্ন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল-নির্ধারণ, পদোন্নতি দান, ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলাবিধান রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত।
বিচারকের এখতিয়ার
১. সিভিল মামলার ক্ষেত্রে সহকারী জজ (Assistant Judge) ২ লাখ টাকা মূল্যমানের মামলার মীমাংসা করতে পারবেন।
২. সিনিয়র সহকারী জজ (Senior Assistant Judge) ৪ লাখ পর্যন্ত মামলার আর্থিক এখতিয়ারে নিতে পারবেন।
৩. যুগ্ম জেলা জজ (Joint District Judge) ৪ লাখ টাকার উপরে আর্থিক এখতিয়ারে মামলা নিতে পারবেন।
ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে বিচারকের এখতিয়ার
১. প্রথমে একজন তৃতীয় শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। উনি সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা জরিমানা ও ২ বছরের কারাদণ্ড দিতে পারবেন।
২. দ্বিতীয় শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা জরিমানা ও ৩ বছরের কারাদণ্ড দিতে পারবেন।
৩. প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট ৫ বছরের কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবেন।
৪. যুগ্ম দায়রা জজ ১০ বছরের বেশি কারাদণ্ড কোন মামলার বিচার করতে পারেন না।
৫. অতিরিক্ত দায়রা জজ ও দায়রা জজ মৃত্যুদন্ড দিতে পারেন। (CRPC section 31, 32)
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কারা
Code of Criminal Procedure, 1898 ধারা ১০ এ বির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। মূলত নির্বাহী বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত এসব ম্যাজিস্ট্রেটদের বিশেষ কাজের জন্য নিয়োগ দেয়া হয়। প্রতিটি জেলায় সরকার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ প্রদান করবেন।কোন বিশেষ বা জরুরি অবস্থায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বিচার করতে পারবেন। তবে তা নিয়মিত বিচারের অংশ হবে না৷
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৪০ লক্ষ মামলা চলমান। এই সংকট থেকে উত্তোরণের জন্য অনেক সময় দরকার। তারপর আমাদের বিচারক সংকটও রয়েছ্ব। এই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার মোবাইল কোর্ট আইন,২০০৯ প্রণয়ন করেছে।
এই আইন অনুযায়ী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বিচারিক ক্ষমতা প্রদান করতে পারবেন।
তবে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ২ বছরের উর্ধ্বে কাউকে সাজা প্রদান করতে পারবেন না।
তারপর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে দুটি শর্ত পূরণ করতে হবে,
১. ম্যাজিস্ট্রেট এর চোখের সামনে অপরাধ সংঘটিত হতে হবে।
২. অভিযুক্ত ব্যক্তি বিনা বল প্রয়োগে দোষ স্বীকার করবেন।
বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৫(৪) ধারায় বলা হয়েছে, “কোন অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাইবে না।”
অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষ স্বীকার না করলে তাকে থানা মারফত জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর প্রেরণ করতে হবে।
মোবাইল কোর্ট ও পপুলার জাস্টিস
কোথাও গিয়ে জরিমানা করা, শাস্তি দেয়া এটা ভাল, কিন্ত মিডিয়ায় এটা নিয়েই মাতামাতি হয়। একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এক/দুইটি জরিমানা, শাস্তি দিয়ে মিডিয়ায় হিরো হয়ে যান। অথচ একজন জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মাসে ৪০/৫০টি রায় দেন। রায় দিলে রায়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে কি না এটা বিষয়।
২০০৭ সালে বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ার পর দেশের প্রয়োজনীয়তার প্রেক্ষাপটে মোবাইল কোর্ট অধ্যাদেশ জারি করা হয়। ২০০৯ সালে এটি আইনে পরিণত হয়। মূলত মামলার জট, দীর্ঘসূত্রতা, আদালতে দীর্ঘমেয়াদী মামলা ঝুলে থাকা, এ পরিপ্রেক্ষিতে মোবাইল কোর্ট যথেষ্ট কার্যকরী হওয়ার কথা ছিল। পরবর্তীতে আইনটির সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলা হয়। মামলাটি এখনো আপিল বিভাগে বিচারাধীন।
আমরা দেখেছি মোবাইল কোর্টে খুব দ্রুত বিচার হয়। আর বিচার দ্রুত হলে সমস্যা না,এটা ইতিবাচক।কিন্ত ন্যায়বিচারের নীতিমালা গুলো মানা হচ্ছে কি না সেটা একটা বিষয়।এক্ষেত্রে হাইকোর্ট একটি মামলায় বলেছেন,”আইনের যথাযথ অনুসরণ না করে নিজেদের খেয়াল খুশিমতো মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে ক্ষমতার অপব্যবহার কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।”
২০২০ সালের মার্চ মাসে কুড়িগ্রামে এক সাংবাদিককে মধ্যরাতে ঘরের দরজা ভেঙে বাসা থেকে ধরে নিয়ে ডিসি অফিসে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে এক বছর কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা।
যেখানে আইনে স্পষ্ট বলা হয়েছে কোন অপরাধ ম্যাজিস্ট্রেট এর সামনে সংগঠিত হলে তার বিচার মতো মোবাইল কোর্টে হবে। কিন্ত এখানে ভিকটিমকে বাসা থেকে ধরে আনা হয়েছে।যেটা এই আইনের সুস্পষ্ট লংঘন। এখানে মোবাইল কোর্ট আইনও মানা হয়নি। দেখা যাচ্ছে আইন থাকার পরও আইনের সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না।
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে লক্ষ্মীপুরের তখনকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) শেখ মুর্শিদুল ইসলাম সাবেক সিভিল সার্জন ডা. সালাহ উদ্দিনের সঙ্গে কথা কাটাকাটির জের ধরে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে তাকে তিন মাসের কারাদণ্ড দেন৷ যে বিচারে ন্যায়বিচারের চেয়ে ব্যক্তিগত ক্ষোভই মূখ্য। আর এখানে ন্যায়বিচারের মূলনীতিগুলোও মানা হয় নি। ন্যায়বিচারের ২য় মূলনীতি “No one can not be judge in his own case” অর্থাৎ কেউ তার নিজের মামলায় বিচারক হতে পারবেন না। এখানে সেই নীতিও মানা হয়নি।
মোবাইল কোর্ট আইন ২০০৯ এর ধারা- ৬ ও ৭ অনুযায়ী, যাকে সাজা দেয়া হবে তাকে অবশ্যই ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে নিজের দোষ স্বীকার করতে হবে। কিন্তু অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি সেচ্ছায় দোষ স্বীকার না করে তাহলে তাকে সাজা দেয়া হবে অবৈধ ও আইন বিরোধী। ঘটনার সময় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে অবশ্যই ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকতে হবে।
অনেক সময় মোবাইল কোর্টে শিশুরাও হেয়প্রতিপন্ন হচ্ছেন। পরবর্তীতে অবশ্য উচ্চ আদালতে শিশুদের দন্ড মওকুফ করা হয়েছে।
গত ১১ মার্চ বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ এবং বিচারপতি মো. মাহমুদ হাসান তালুকদারের ডিভিশন বেঞ্চ একটি রিটের রায় প্রদানকালে বলেন, ম্যাজিসেট্রটদের আইন জ্ঞান কম। তাদের প্রশিক্ষণ দরকার। ১২১ জন শিশুকে ভ্রাম্যমান আদালতে দেয়া শাস্তিকে ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে দেয়া রায়ে হাইকোর্ট উপরোক্ত মন্তব্য করেন।
দ্রুত বিচারের স্বার্থে মোবাইল কোর্ট দরকার। তবে অবশ্যই বিচারককে পরিস্থিতি মেনে বিচার করতে হবে। খেয়াল খুশিমত বিচার করা মানে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
মোবাইল কোর্টে বিচার করার ক্ষমতা জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের হাতে অর্পণ করা উচিত, কেননা তাদের প্রত্যেকেরই আইন বিষয়ে জানাশোনা আছে, (Judicial Mind) প্রয়োগ করে তারাই একমাত্র ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার যথার্থ দাবী রাখে।
লেখক: শিক্ষার্থী; আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা, ৩ রা মার্চ, ২০২০; দৈনিক ইনকিলাব, ১৪ এপ্রিল, ২০২২; বাংলাদেশ সংবিধান; Code of Criminal procedure, 1898; Code of Civil Procedure, 1908